রাজনীতি-অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, কনসেনসাস এবং 'মেইড ইন বাংলাদেশ' by ইমতিয়াজ আহমেদ
এক নজরে চার ফর্মুলা এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার, কিন্তু সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এর প্রধান থাকবেন না। নিরপেক্ষ কাউকে এ পদে বসানো হবে। দুই বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে উভয় দলের পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে সরকার গঠন। প্রধান উপদেষ্টা হবেন বর্তমান শাসক দল থেকে।
তিন
সরকারি ও বিরোধী দলের মনোনীত পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। প্রধান উপদেষ্টা হবেন নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি।
চার
সরকারি ও বিরোধী দলের তিনজন করে সংসদ সদস্য এবং নির্দলীয় চারজন, মোট ১০ জনকে নিয়ে সরকার গঠন। নির্দলীয়দের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা।
দেশে রাজনৈতিক সমস্যা-সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং এর অন্যতম বড় কারণ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা_ এ নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ কম। প্রবল গণআন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। এর ১১ বছর পর সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদ এ বিধান বাতিল করে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতাসীন দল বিএনপি নির্বাচনকালীন এ ব্যবস্থা মেনে নিতে আদৌ রাজি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রবল আন্দোলনের চাপে তারা সংবিধানে এ ব্যবস্থা সংযোজন করতে বাধ্য হয়। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বিএনপি চাইছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনর্বহাল এবং আওয়ামী লীগ চলতে চাইছে ভিন্ন পথে। এখন বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ বাড়িয়ে চলেছে। সমাজের বিভিন্ন অংশও এ বিষয়ে সরব। বিভিন্ন ফর্মুলাও আসছে। 'সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন' বক্তব্য নিয়ে মাঠে রয়েছেন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও। তাদেরও ফর্মুলা রয়েছে, তবে হয়তো প্রকাশ্যে তা বলা হয় না। এর মধ্যেই ৫ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছেন, দুই প্রধান নেত্রীকে এক টেবিলে আলোচনায় বসালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধান সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকতে পারে; কিন্তু সমাধানও থাকে। মতবিনিময়ের মাধ্যমে আমাদেরকেই সম্ভাব্য পথ খুঁজতে হবে। এ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে পারি না। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিদেশি কূটনীতিকদের ফর্মুলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাইরের কোনো ফর্মুলায় নয়, আমি 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সমাধান চাই।
মেইড ইন বাংলাদেশ_ এ প্রশ্নে আমার মনে হয় না যে, বিশ্বে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কেউ হারাতে পারবে। কয়েকটি উদাহরণ দেই। এক. গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম ও আত্মদানের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু নির্বাচনকেন্ত্রিক গণতন্ত্রের বাইরে আমরা এখনও যেতে পারিনি। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু জয়ী কিংবা পরাজিত কোনো দলের অভ্যন্তরেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই। আন্তঃদলীয় সম্পর্কেও গণতন্ত্রের ছাপ নেই। দলের তহবিল ব্যবস্থাপনাতে নেই স্বচ্ছতা। নির্বাচনের সময় মনোনয়ন প্রক্রিয়াও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মনোনয়ন কেনা যায়_ এটা ওপেন সিক্রেট। এসবই তো 'মেইড ইন বাংলাদেশ'। তারপরও, নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশে এবং ভোটের মাধ্যমেই গঠিত হয় সরকার। কিন্তু গণতন্ত্রের অনুশীলন নেই, যা অন্য অনেক দেশে রয়েছে।
দুই. ২০০৭ সালে বাংলাদেশে ঘটেছে 'ওয়ান ইলেভেন'। সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই। তারা দুই বছরে যেসব কাজ করেছে, তার নজিরও মিলবে না। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন থেকে শুরু করে 'দুর্নীতি দমন অভিযান'_ সবকিছুতেই অভিনবত্ব।
তিন. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের ব্যবস্থাও অভিনব। জ্ঞানের আলো যিনি ছড়াতে পারেন এবং অন্যদেরও এ কাজে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রাখেন_ এমন কারোর জন্যই এ পদ সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে নিজস্ব পথ।
চার. সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজিত হয়েছিল, সেটাও কোথাও দেখা যাবে না। যারা এর রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এমন ব্যবস্থায় ক্ষমতা ধরে রাখা নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে বিরোধীদের ধারণা ছিল যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন ব্যবস্থাই সঠিক কৌশল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। বিএনপি এসেছে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাদের মনে হয়েছে, নতুন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে তার মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা নিশ্চিত নয়। এ কারণে তারা সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতি পদের জন্য বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেয়, যাতে নিজেদের পছন্দের একজন সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারেন। কিন্তু বিরোধীরা এটাকে ইস্যু করে। পরিণতিতে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতা চলে যায় ভিন্নধর্মী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে, তার রূপরেখা তৈরি করেছিল ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপি। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, ওই সংসদ গঠিত হয়েছিল বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির (১৯৯৬) নির্বাচনের মাধ্যমে; বেশিরভাগ ভোটার যা বয়কট করেছিল। ওই সংসদ মাত্র কয়েকদিন স্থায়ী হয় এবং আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল না। এ ব্যবস্থার দুটি ধারা গুরুত্বপূর্ণ_ এক. কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন সে বিষয়ে পাঁচটি বিকল্প রাখা হয়েছে। প্রথম পছন্দ হবেন সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি। আর সর্বশেষ পছন্দ_ কনসেনসাসের মাধ্যমে কাউকে এ পদের জন্য বেছে নেওয়া। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এ সাংবিধানিক ব্যবস্থাতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু উভয় সময়েই ক্ষমতাসীনরা হেরে যায়। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রধান দুই দলের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারভীতি কাজ করে এবং নানা রকম ম্যানিপুলেশন করে ফল নিজের অনুকূলে রাখায় তারা সচেষ্ট থাকে। এ ব্যবস্থার কারণে বিচার বিভাগের রাজনীতিকীকরণের পথ খুলে যায়। কার্যত আমরা দেখছি যে, সর্বোচ্চ আদালতে এখন রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রকটভাবে ধরা পড়ে। আরেকটি দিকও উপেক্ষা করার নয়। নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ও ভারসাম্য বজায় রাখা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সদ্য অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি যখন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন তখন নির্বাহী কর্তৃত্ব ন্যস্ত হয় তার ওপর। এ সময়ে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত থাকে। বিচার বিভাগ সচল থাকলেও যেহেতু নির্বাহী কর্তৃত্ব সদ্য অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতির হাতে চলে যায়, সে কারণে নির্বাচনকালীন সরকার ও বিচার বিভাগের জন্য কিছু অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হতেই পারে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে সরকারের মেয়াদ। সংবিধানে যে ব্যবস্থা ছিল তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের বেশি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় শক্তির ভূমিকা হয় মুখ্য। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি গঠিত সরকার এ সুযোগ নিয়েছিল।
অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধানে উপরোক্ত দুটি ধারার সংশোধন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এটা না করে 'বাথটাবের ব্যবহার করা পানির সঙ্গে শিশুটিকেও ছুড়ে ফেলে দেওয়া' হয়েছে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে আদালতের রায়ের যুক্তি দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো, এখন পর্যন্ত তার পূর্ণ বিবরণই প্রকাশ করা হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সাংবিধানিক যে বিধান ছিল, তা থেকে প্রথম সমস্যার সমাধান আদৌ কঠিন ছিল না। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচার বিভাগের বাইরে থেকে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় যে সমস্যা তা হচ্ছে মেয়াদ সংক্রান্ত। তৃতীয় শক্তির সহায়তায় ওই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এখন প্রধান দুই দল সমঝোতায় এলে তৃতীয় শক্তির ভূমিকা কমিয়ে আনা সম্ভব। তারা উদ্যোগী হলে অন্যান্য দলও এ অবস্থান গ্রহণ করবে বলেই মনে হয়।
রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে টেবিলে কয়েকটি ফর্মুলা রয়েছে। এর মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য সেটা নির্ধারণ করতে পারেন রাজনৈতিক নেতারাই। বিচারপতি হাবিবুর রহমান স্পষ্ট করেই বলেছেন, 'মতবিনিময়ের মাধ্যমেই আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে'। এজন্য প্রয়োজন প্রচণ্ড উদ্ভাবনী শক্তি, প্রচেষ্টা ও উদ্যম। এখানে আমরা বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, কিন্তু সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এর প্রধান থাকবেন না। নিরপেক্ষ কাউকে এ পদে বসানো হবে। এর ফলে বিচার বিভাগকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলার ধারায় ছেদ পড়বে। কিন্তু বর্তমান শাসক দলের মধ্যে এ পদ্ধতি মেনে নেওয়ায় অনীহা লক্ষণীয়।
দুই. বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে উভয় দলের পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে সরকার গঠন। প্রধান উপদেষ্টা হবেন বর্তমান শাসক দল থেকে। এর ফলে 'অনির্বাচিত সরকার' অভিযোগ আর থাকবে না। এ ফর্মুলায় বিরোধীদের আপত্তি।
তিন. সরকারি ও বিরোধী দল মনোনীত পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা হবেন নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি। এ ফর্মুলার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যিনি দুই দলকে নিয়ে কাজ করতে রাজি হবেন।
চার. চতুর্থ ফর্মুলা হচ্ছে, সরকারি ও বিরোধী দলের তিনজন করে সংসদ সদস্য এবং নির্দলীয় চারজন, মোট ১০ জনকে নিয়ে সরকার গঠন। নির্দলীয়দের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। এ সরকার হবে নির্বাচিত ও অনির্বাচিত_ এই দুই মতের মধ্যে এক ধরনের আপস। শেখ হাসিনা চাইছেন, নির্বাচিতদের নিয়ে সরকার। এ ফর্মুলায় নির্বাচিতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবেন। কিন্তু একক দলের প্রাধান্য থাকবে না। অন্যদিকে নির্দলীয়দের মধ্য থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ চারজনকে নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে শর্ত হবে, ১০ জন উপদেষ্টার কেউই পরের দুই টার্ম নির্বাচন করতে পারবেন না। অন্তত ১০ বছরের জন্য তারা কোনো পাবলিক অফিসেও নিয়োগ পাবেন না। বলা যায়, তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিতে হবে। তবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের এ ধরনের ত্যাগ অবশ্য মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে এবং ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমাদের দেশে দলীয় লোকদের মধ্যেও উদার ও পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তির সন্ধান লাভ অসম্ভব নয়। রাজনীতি করেও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব। কিন্তু আমরা তাদের সুযোগ করে দিতে পারছি না।
এ ধরনের আরও ফর্মুলা থাকতে পারে এবং আশা করব যে, সেগুলোও আলোচনার টেবিলে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হবে। এ থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা অবশ্যই মিলতে পারে।
মানুষকে বলা হয় থিঙ্কিং বিয়িং। তার চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে। একই সঙ্গে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতাও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। বাংলাদেশের জনগণ তাদের
চিন্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দ্বারা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তিলাভের পথ অবশ্যই খুঁজে পাবেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ :রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সরকারি ও বিরোধী দলের মনোনীত পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। প্রধান উপদেষ্টা হবেন নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি।
চার
সরকারি ও বিরোধী দলের তিনজন করে সংসদ সদস্য এবং নির্দলীয় চারজন, মোট ১০ জনকে নিয়ে সরকার গঠন। নির্দলীয়দের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা।
দেশে রাজনৈতিক সমস্যা-সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং এর অন্যতম বড় কারণ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা_ এ নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ কম। প্রবল গণআন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। এর ১১ বছর পর সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদ এ বিধান বাতিল করে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ক্ষমতাসীন দল বিএনপি নির্বাচনকালীন এ ব্যবস্থা মেনে নিতে আদৌ রাজি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রবল আন্দোলনের চাপে তারা সংবিধানে এ ব্যবস্থা সংযোজন করতে বাধ্য হয়। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। বিএনপি চাইছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনর্বহাল এবং আওয়ামী লীগ চলতে চাইছে ভিন্ন পথে। এখন বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ বাড়িয়ে চলেছে। সমাজের বিভিন্ন অংশও এ বিষয়ে সরব। বিভিন্ন ফর্মুলাও আসছে। 'সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন' বক্তব্য নিয়ে মাঠে রয়েছেন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও। তাদেরও ফর্মুলা রয়েছে, তবে হয়তো প্রকাশ্যে তা বলা হয় না। এর মধ্যেই ৫ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছেন, দুই প্রধান নেত্রীকে এক টেবিলে আলোচনায় বসালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধান সম্ভব নয়। গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকতে পারে; কিন্তু সমাধানও থাকে। মতবিনিময়ের মাধ্যমে আমাদেরকেই সম্ভাব্য পথ খুঁজতে হবে। এ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে পারি না। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিদেশি কূটনীতিকদের ফর্মুলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাইরের কোনো ফর্মুলায় নয়, আমি 'মেইড ইন বাংলাদেশ' সমাধান চাই।
মেইড ইন বাংলাদেশ_ এ প্রশ্নে আমার মনে হয় না যে, বিশ্বে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কেউ হারাতে পারবে। কয়েকটি উদাহরণ দেই। এক. গণতন্ত্রের জন্য অনেক সংগ্রাম ও আত্মদানের দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু নির্বাচনকেন্ত্রিক গণতন্ত্রের বাইরে আমরা এখনও যেতে পারিনি। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু জয়ী কিংবা পরাজিত কোনো দলের অভ্যন্তরেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই। আন্তঃদলীয় সম্পর্কেও গণতন্ত্রের ছাপ নেই। দলের তহবিল ব্যবস্থাপনাতে নেই স্বচ্ছতা। নির্বাচনের সময় মনোনয়ন প্রক্রিয়াও দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। মনোনয়ন কেনা যায়_ এটা ওপেন সিক্রেট। এসবই তো 'মেইড ইন বাংলাদেশ'। তারপরও, নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশে এবং ভোটের মাধ্যমেই গঠিত হয় সরকার। কিন্তু গণতন্ত্রের অনুশীলন নেই, যা অন্য অনেক দেশে রয়েছে।
দুই. ২০০৭ সালে বাংলাদেশে ঘটেছে 'ওয়ান ইলেভেন'। সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই। তারা দুই বছরে যেসব কাজ করেছে, তার নজিরও মিলবে না। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন থেকে শুরু করে 'দুর্নীতি দমন অভিযান'_ সবকিছুতেই অভিনবত্ব।
তিন. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের ব্যবস্থাও অভিনব। জ্ঞানের আলো যিনি ছড়াতে পারেন এবং অন্যদেরও এ কাজে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রাখেন_ এমন কারোর জন্যই এ পদ সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে নিজস্ব পথ।
চার. সংবিধানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজিত হয়েছিল, সেটাও কোথাও দেখা যাবে না। যারা এর রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এমন ব্যবস্থায় ক্ষমতা ধরে রাখা নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে বিরোধীদের ধারণা ছিল যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন ব্যবস্থাই সঠিক কৌশল। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। বিএনপি এসেছে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাদের মনে হয়েছে, নতুন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে তার মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা নিশ্চিত নয়। এ কারণে তারা সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতি পদের জন্য বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেয়, যাতে নিজেদের পছন্দের একজন সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারেন। কিন্তু বিরোধীরা এটাকে ইস্যু করে। পরিণতিতে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতা চলে যায় ভিন্নধর্মী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে, তার রূপরেখা তৈরি করেছিল ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপি। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, ওই সংসদ গঠিত হয়েছিল বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির (১৯৯৬) নির্বাচনের মাধ্যমে; বেশিরভাগ ভোটার যা বয়কট করেছিল। ওই সংসদ মাত্র কয়েকদিন স্থায়ী হয় এবং আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল না। এ ব্যবস্থার দুটি ধারা গুরুত্বপূর্ণ_ এক. কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন সে বিষয়ে পাঁচটি বিকল্প রাখা হয়েছে। প্রথম পছন্দ হবেন সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি। আর সর্বশেষ পছন্দ_ কনসেনসাসের মাধ্যমে কাউকে এ পদের জন্য বেছে নেওয়া। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এ সাংবিধানিক ব্যবস্থাতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু উভয় সময়েই ক্ষমতাসীনরা হেরে যায়। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই প্রধান দুই দলের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারভীতি কাজ করে এবং নানা রকম ম্যানিপুলেশন করে ফল নিজের অনুকূলে রাখায় তারা সচেষ্ট থাকে। এ ব্যবস্থার কারণে বিচার বিভাগের রাজনীতিকীকরণের পথ খুলে যায়। কার্যত আমরা দেখছি যে, সর্বোচ্চ আদালতে এখন রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রকটভাবে ধরা পড়ে। আরেকটি দিকও উপেক্ষা করার নয়। নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ও ভারসাম্য বজায় রাখা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সদ্য অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি যখন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন তখন নির্বাহী কর্তৃত্ব ন্যস্ত হয় তার ওপর। এ সময়ে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত থাকে। বিচার বিভাগ সচল থাকলেও যেহেতু নির্বাহী কর্তৃত্ব সদ্য অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতির হাতে চলে যায়, সে কারণে নির্বাচনকালীন সরকার ও বিচার বিভাগের জন্য কিছু অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হতেই পারে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে সরকারের মেয়াদ। সংবিধানে যে ব্যবস্থা ছিল তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের বেশি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় শক্তির ভূমিকা হয় মুখ্য। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি গঠিত সরকার এ সুযোগ নিয়েছিল।
অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধানে উপরোক্ত দুটি ধারার সংশোধন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এটা না করে 'বাথটাবের ব্যবহার করা পানির সঙ্গে শিশুটিকেও ছুড়ে ফেলে দেওয়া' হয়েছে। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে আদালতের রায়ের যুক্তি দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলো, এখন পর্যন্ত তার পূর্ণ বিবরণই প্রকাশ করা হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সাংবিধানিক যে বিধান ছিল, তা থেকে প্রথম সমস্যার সমাধান আদৌ কঠিন ছিল না। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচার বিভাগের বাইরে থেকে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় যে সমস্যা তা হচ্ছে মেয়াদ সংক্রান্ত। তৃতীয় শক্তির সহায়তায় ওই সরকারের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়েছিল। এখন প্রধান দুই দল সমঝোতায় এলে তৃতীয় শক্তির ভূমিকা কমিয়ে আনা সম্ভব। তারা উদ্যোগী হলে অন্যান্য দলও এ অবস্থান গ্রহণ করবে বলেই মনে হয়।
রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে টেবিলে কয়েকটি ফর্মুলা রয়েছে। এর মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য সেটা নির্ধারণ করতে পারেন রাজনৈতিক নেতারাই। বিচারপতি হাবিবুর রহমান স্পষ্ট করেই বলেছেন, 'মতবিনিময়ের মাধ্যমেই আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে'। এজন্য প্রয়োজন প্রচণ্ড উদ্ভাবনী শক্তি, প্রচেষ্টা ও উদ্যম। এখানে আমরা বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে, কিন্তু সর্বশেষ বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এর প্রধান থাকবেন না। নিরপেক্ষ কাউকে এ পদে বসানো হবে। এর ফলে বিচার বিভাগকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলার ধারায় ছেদ পড়বে। কিন্তু বর্তমান শাসক দলের মধ্যে এ পদ্ধতি মেনে নেওয়ায় অনীহা লক্ষণীয়।
দুই. বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে উভয় দলের পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে সরকার গঠন। প্রধান উপদেষ্টা হবেন বর্তমান শাসক দল থেকে। এর ফলে 'অনির্বাচিত সরকার' অভিযোগ আর থাকবে না। এ ফর্মুলায় বিরোধীদের আপত্তি।
তিন. সরকারি ও বিরোধী দল মনোনীত পাঁচজন করে সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা হবেন নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি। এ ফর্মুলার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যিনি দুই দলকে নিয়ে কাজ করতে রাজি হবেন।
চার. চতুর্থ ফর্মুলা হচ্ছে, সরকারি ও বিরোধী দলের তিনজন করে সংসদ সদস্য এবং নির্দলীয় চারজন, মোট ১০ জনকে নিয়ে সরকার গঠন। নির্দলীয়দের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। এ সরকার হবে নির্বাচিত ও অনির্বাচিত_ এই দুই মতের মধ্যে এক ধরনের আপস। শেখ হাসিনা চাইছেন, নির্বাচিতদের নিয়ে সরকার। এ ফর্মুলায় নির্বাচিতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবেন। কিন্তু একক দলের প্রাধান্য থাকবে না। অন্যদিকে নির্দলীয়দের মধ্য থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ চারজনকে নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে শর্ত হবে, ১০ জন উপদেষ্টার কেউই পরের দুই টার্ম নির্বাচন করতে পারবেন না। অন্তত ১০ বছরের জন্য তারা কোনো পাবলিক অফিসেও নিয়োগ পাবেন না। বলা যায়, তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিতে হবে। তবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের এ ধরনের ত্যাগ অবশ্য মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে এবং ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমাদের দেশে দলীয় লোকদের মধ্যেও উদার ও পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তির সন্ধান লাভ অসম্ভব নয়। রাজনীতি করেও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব। কিন্তু আমরা তাদের সুযোগ করে দিতে পারছি না।
এ ধরনের আরও ফর্মুলা থাকতে পারে এবং আশা করব যে, সেগুলোও আলোচনার টেবিলে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হবে। এ থেকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা অবশ্যই মিলতে পারে।
মানুষকে বলা হয় থিঙ্কিং বিয়িং। তার চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে। একই সঙ্গে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতাও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। বাংলাদেশের জনগণ তাদের
চিন্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দ্বারা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তিলাভের পথ অবশ্যই খুঁজে পাবেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ :রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments