এবারের শীত by এবনে গোলাম সামাদ
এবারের শীতে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে (Warsaw) অনেক লোক মারা গেল। মারা যাওয়ার কারণ, ওয়ারশ শহরের তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের নিচে ২৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। কিন্তু এরকম শীতেও লোকগুলো হয়তো মারা যেত না, যদি তাদের গায়ে দেয়ার মতো থাকত শীতবস্ত্র। রাশিয়াতেও অনেক জায়গায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের যথেষ্ট নিচে নেমে গিয়েছে।
কিন্তু সেখানে শীতে জমে মরেনি লোক। কারণ তাদের গায়ে দেয়ার মতো শীতবস্ত্র আছে। পোল্যান্ডের মানুষ গণতন্ত্র অর্জন করেছে। পোল্যান্ড এখন একটি গণতন্ত্রী দেশ। কিন্তু পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর। শীতবস্ত্রের অভাবে তাই এবারের শীতে বেশকিছু লোককে মরতে হলো শীতে জমে, শীত বেশি পড়েছে বলে নয়। শীতে মানুষ মরার খবর পাওয়া গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধনী দেশ। কিন্তু সেখানে আছে ধন বৈষম্য। আর তাই দরিদ্র জনসমষ্টিকে পেতে দেখা যায় শীতে দারুণ কষ্ট। তাদের কেউ কেউ প্রতিবছর জমে মরে শীতে। এবার উত্তর চীনেও যথেষ্ট ঠাণ্ডা পড়েছে। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল হিমাঙ্কের নিচে ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে। বেইজিং-এ ঘটেছে প্রচুর তুষারপাত, যা জনজীবনকে করে তুলেছিল অচল। এসব শীতের খবরের পাশে ছাপা হয়েছে আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায় এদেশের শীতের খবর। কিন্তু শীত যে এবার এদেশে বেশি পড়েছে তা কিন্তু নয়। কারণ তাপমাত্রা গড়পরতা অন্য বছরের মতোই আছে। এবার তাপমাত্রা যশোরে নেমেছিল ৬ ডিগ্রি সে.-এর কাছে। কিন্তু এরকম তাপমাত্রা রেকর্ড এদেশে বিরল নয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শীতকালে রাতে অনেক সময় তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সে. হওয়ার রেকর্ড আছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সাধারণত শীত পড়ে বেশি। মানুষের শীত লাগাটা কেবলমাত্র তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে না। শীত লাগাটা অনেক পরিমাণে হলো আপেক্ষিক। কেউ যদি গরম পানির মধ্যে হাত ডুবিয়ে রেখে পরে সেই হাত পানি থেকে তুলে সাধারণ তাপমাত্রার পানির মধ্যে ডুবায়, তবে সেই সাধারণ তাপমাত্রার পানিই মনে হতে পারে ঠাণ্ডা। এটাকে বলা যায় আপেক্ষিক ঠাণ্ডা। তাপমাত্রাজনিত কারণে ঠাণ্ডা নয়। উত্তর গোলার্ধে সবচেয়ে ঠাণ্ডা মাস হচ্ছে জানুয়ারি। আর সবচেয়ে গরম মাস হচ্ছে জুলাই। বাংলাদেশে জানুয়ারি মাসে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা থাকে ৯ থেকে ১৩ ডিগ্রি সে.-এর মধ্যে। আর জুলাই মাসে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা থাকে ২৬-২৭ ডিগ্রি সে.-এর মধ্যে। শীত আর গ্রীষ্মের এই সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা তুলনা করলে আমরা খুঁজে পেতে পারি, শীতকালে তুলনামূলকভাবে আমাদের অত শীত লাগার কারণ। আমরা গরম দেশের মানুষ। তাই এদেশে সর্বকালীন শীতকালে তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সে.-এর কাছাকাছি নেমে এলেই শীত লাগতে থাকে খুব বেশি।
রাজশাহী শহরের কাছে পদ্মায় পানি নেই। ধু ধু করছে বালুচর। ক’দিন আগে আমাদের দেশে কিছু বিশেষজ্ঞকে বলতে শোনা গেল, শীতের মৌসুমে পদ্মায় এভাবে বালুরচর সৃষ্টি হতে পারছে বিশ্বজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। অথচ এটা হতে পারছে, ফারাক্কা ব্যারেজের জন্য। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো যোগাযোগ নেই। জানি না আমাদের দেশের কিছু বিশেষজ্ঞ কেন বলেছেন পদ্মা নদী রাজশাহী শহর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে; পদ্মা নদীতে শীতের মৌসুমে পড়ছে বিশাল বালুচর, বিশ্বজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। তারা কি এই বিষয়ে বিশেষ কোনো গবেষণা করেছেন? আমরা এদের গবেষণা সম্পর্কে এখনও অবগত হতে পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, হাসিনা-দেব গৌড়া চুক্তি অনুসারে ভারত শীতকালে আমাদের যতটা পানি দিতে রাজি হয়েছিল, তা যদি দিত, তবে পদ্মা নদীর এরকম দশা হতে পারত না। কিন্তু আমাদের কিছু কথিত বিশেষজ্ঞ পদ্মা নদীর বর্তমান অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য টেনে আনছেন বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের তত্ত্বকে। অনেক পরিবর্তনই আমরা হতে দেখলাম আমাদের জীবনে। ফারাক্কা ব্যারেজ হওয়ার আগে রাজশাহীতে জেলেরা পদ্মায় ধরেছে প্রচুর ইলিশ মাছ। কিন্তু রাজশাহীর কাছে পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরা এখন হয়ে পড়েছে বিরল ঘটনা। ইলিশ লোনা পানির মাছ, বঙ্গোপসাগর থেকে নদীর মোহনা দিয়ে ঢুকত, উজান বেয়ে আসত পদ্মায়। তারা উজানে ছাড়ত ডিম। ডিম ফোটা বাচ্চারা ফিরে যেত বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু এখন আর এটা হতে পারছে না। তাই পদ্মার ইলিশ এখন হয়ে উঠেছে প্রায় গল্পকথা।
এক সময় এ দেশে প্রতি শীতে সাইবেরিয়া থেকে আসত ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো হাঁস। কিন্তু এখন আর তারা আগের মতো আসছে না। এর কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন নয়। এর কারণ আমাদের দেশে আর আগের মতো খাল-বিল না থাকা। নাটোরের বিখ্যাত চলন বিলে এখন শীতকালে করা হচ্ছে ধান চাষ। আগে এখানে এসে শীতকালে বাসা বাঁধত অনেক বিদেশি পাখি। তারা এখানে ডিম পাড়ত, ডিমে তা দিয়ে তুলত বাচ্চা। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। চলন বিল অঞ্চলে শীতকালে জাল পেতে অনেকে এসব পাখি ধরে বিক্রি করেছে বাজারে। কিন্তু এখন এ ঘটনা কেবলই বিগত দিনের স্মৃতি। আমার মনে পড়ে, আকাশে দেখা যেত, সার বেঁধে বুনো হাঁসদের উড়ে যেতে। মাটি থেকে শোনা যেত তাদের উড়ে চলার শব্দ। শীতকালে আমাদের দেশে বৃষ্টি হয় না। কখনও কখনও হলেও, হয় খুব কম। আগে এ সময় তাই আমাদের দেশে হতো বড় বড় মেলা। মেলার সঙ্গে হতো যাত্রা। এখন আর যাত্রা আগের মতো হয় না। আমাদের দেশে কিছু লোক ছিল, যারা শীতকালে বলত রূপকথার কাহিনী। রূপকথা বলে তারা উপার্জন করত তাদের জীবিকা। এখন এরকম রূপকথা বলার রেওয়াজ আর নেই। আমাদের সনাতন সংস্কৃতির অনেক কিছুই চলেছে বিলুপ্তির পথে। আমাদের অর্থনীতিতেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। শীতের মৌসুমে আমাদের দেশে অনেক অঞ্চলেই চাষাবাদ হতো না। কিন্তু এখন মানুষ শীতকালেও করছে ধানের আবাদ, গম ও গোল আলুর চাষ। শীতকালে বেড়েছে মানুষের কর্মসংস্থান। আগের মতো অত বেশি সংখ্যায় মানুষ এখন শীত সহ্য করে কষ্ট হলেও কাজ করছে মাঠে। এটা একটা বড় ধরনের পরিবর্তন বলে গণ্য হওয়া উচিত। এবারে রাজশাহী অঞ্চলে শীতকালে পড়েছে বেশি কুয়াশা। এরকম কুয়াশা গোল আলু ও পান চাষের ক্ষতি করে। এবারে কুয়াশার জন্য এই অঞ্চলে বোরো চাষের বীজতলায় কৃষক বোরধানের চারা সেভাবে করতে পারেনি। ফলে এবার বোরো ধানের উত্পাদন কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। তবে এরকম কুয়াশা পড়া এই অঞ্চলে বিরল ঘটনা নয়। একটা অঞ্চলের জলবায়ু হিসাব করতে গেলে সাধারণত ৩৫ বছরের তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণের গড় হিসাব করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে বুঝতে হয়, এই হিসাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ঘটাকে।
বিশ্বের জলবায়ু আগামীতে কেমন দাঁড়াবে, তা নিয়ে এদেশে বুদ্ধিজীবী মহলে সৃষ্টি হতে পেরেছে অনেক বিভ্রান্তি। একটি হিসাব অনুসারে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ১ সে.। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। শিল্প বিপ্লব ঘটার পর থেকে কলকারখানায় পোড়ানো হচ্ছে কার্বন (অঙ্গার) সমৃদ্ধ জ্বালানি। যেমন— পাথুরে কয়লা, পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্য, এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। যাতে বাতাসে বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে, বাড়বে পৃথিবীর তাপমাত্রা। কিন্তু এবারের শীতে আমাদের দেশে শীত পড়ল প্রায় অন্য বছরের মতোই। আর পৃথিবীর বহু দেশে তুষারপাত ঘটল অন্য অনেক বছরের তুলনায় বেশি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির তথ্যের সঙ্গে এই বাস্তবতা খাপ খাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
ভূ-তত্ত্ববিদদের গবেষণা থেকে এ কথা এখন সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, পৃথিবীর জলবায়ু বহুবার বদলেছে। যাকে বলা হয় শেষ হিম যুগ (ওপব অমব). যেসময় বরফে ঢাকা পড়েছিল উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিরাট অংশ। তারপর বরফ গলেছে। আমরা এখন চলেছি, বলতে গেলে একটা শীতল অবস্থারই মধ্য দিয়ে। শেষ হিম যুগের সাক্ষ্য এখনও বহন করছে গ্রিনল্যান্ড ও দক্ষিণ মেরু মহাদেশের অহঃবত্ঃরপধ’র বর্তমান বরফের আচ্ছাদন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, তাও থাকবে না, গলে যাবে ধীরে ধীরে। তবে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার কারণে নয়, অন্য প্রাকৃতিক কারণে। যেমন কারণে অতীতে গলেছে বরফ, শেষ হতে পেরেছে হিম যুগ। ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, অতীতে পৃথিবী প্রায়ই থেকেছে সম্পূর্ণ বরফমুক্তভাবে। বরফ জমাটাকে তাই পৃথিবীর ইতিহাসে ধরতে হয় ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে।
No comments