গ্যাস খাতে ৩ বছরের বেশি সময়ে অর্জন শূন্যঃ বক্তৃতা দিয়ে সমস্যা মেটানো যায় না
কথায় চিড়ে ভেজে না বলে একটা প্রবাদ বাংলাভাষায় বহুদিন ধরে চালু আছে। তারপরও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকার গত এক বছরে কাজের কাজ কিছু না করে শুধু বাগাড়ম্বরের সাহায্যে কিস্তি মাতের চেষ্টায় আছে। কিন্তু তাতে যে চিড়ে ভেজেনি তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণ গ্যাস সেক্টরের অব্যাহত স্থবিরতা।
২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেয়ার পর তিন বছর তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গ্যাসের উত্পাদন ও সরবরাহ এক ঘনফুটও বাড়েনি। ২০০১ সালে জোট সরকার যখন যাত্রা শুরু করে তখন দেশে গ্যাসের উত্পাদন ছিল দৈনিক ১০৫ কোটি ঘনফুট। ২০০৬-এর অক্টোবর পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার ফলে বর্তমানে দৈনিক ১৯৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন সম্ভব হচ্ছে। বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে দৈনিক ৬৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হওয়ায় মোট উত্পাদন ২০০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনটি গ্যাসক্ষেত্রের উত্পাদন জোট সরকারের আমলের তুলনায় কমে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে উত্পাদন না বাড়লেও চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা ২৩০ কোটি ঘনফুটের বেশি। ফলে প্রতিদিন ঘাটতির পরিমাণ ৩২ থেকে ৩৩ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের এই ঘাটতির কারণে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়েছেন শিল্প, বাণিজ্য ও আবাসিক গ্রাহকরা। গ্যাসের সব রকম নতুন সংযোগ নজিরবিহীনভাবে বন্ধ রাখা সত্ত্বেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুত্ উত্পাদন খাতে গ্যাসের সরবরাহ আরও কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এমনিতে গ্যাসের অভাবে দৈনিক প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কম উত্পাদন হচ্ছে। বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোতে যদি গ্যাস সরবরাহ আরও কমিয়ে দেয়া হয় তবে লোডশেডিংয়ের মাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। এর প্রভাবে যদি সেচ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয় তবে বোরোর বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা ভণ্ডুল হয়ে যেতে বাধ্য। এরই মধ্যে গ্যাস সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় কমে গেছে ইউরিয়া উত্পাদন। গ্যাসের অভাবে শিল্প উত্পাদনেও ধস নেমেছে। সংযোগ না পেয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে হাজার কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ। আবাসিক গ্রাহকরা অতীতে কখনও এত তীব্র গ্যাস সঙ্কটের কবলে পড়েনি। চুলা জ্বলছে না দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়।
প্রতি বছরই দেশে গ্যাসের চাহিদা ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তাই এখন যদি দেশে গ্যাসের চাহিদার কোনো ঘাটতি না থাকে এবং সে আনন্দে আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি, তবে সামনের বছরই আমাদের আবার ঘাটতির কবলে পড়তে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকা সচল থাকলে গ্যাসের চাহিদা বাড়বেই। অতএব, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চাহিদার হিসাব মাথায় রেখে বিরামহীনভাবে চালিয়ে যেতে হবে গ্যাস উত্পাদন বাড়ানোর চেষ্টা। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, গ্যাসের মজুদের সীমাবদ্ধতা আছে। অতএব, নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের দিকেও নজর দিতে হবে। জ্বালানির তিনটি প্রধান উত্স হচ্ছে গ্যাস, খনিজ তেল এবং কয়লা। খনিজ তেলের সন্ধান আমাদের দেশে পাওয়া যায়নি। পাওয়া যাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে, তেমন আশ্বাসও মেলেনি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। তদুপরি খনিজ তেলের আন্তর্জাতিক বাজার এমন অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে যে, এর ওপর অতিনির্ভরতা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। চরম অব্যবস্থাপনা এবং অদূরদর্শিতার কারণে গ্যাস নিয়ে আমরা এখন ভালোরকম খাবি খাচ্ছি। আমাদের মাটির নিচে কয়লার যে বিপুল মজুদ এরই মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে আগামী ৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কিন্তু কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহার নিয়ে আমরা নিজেরাই যে তালগোল পাকানো পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছি, তাতে কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায় তা বলা মুশকিল। বড়পুকুরিয়ায় চীনের সহায়তায় সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে খনি থেকে কয়লা তোলা হচ্ছে। এই কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য সেখানে বড় দুটি প্লান্ট বসানোর কথা। কিন্তু সে কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। ফুলবাড়ীর অতিউন্নত মানের কয়লা কোন পদ্ধতিতে তোলা হবে, সেই সিদ্ধান্তও আমরা নিতে পারছি না। এসবের জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমানতা, অদূরদর্শিতা, অযোগ্যতা ও আত্মসর্বস্বতা দায়ী। যারা সিদ্ধান্ত নেবেন, তারা যদি প্রতি ক্ষেত্রে নিজের লাভ কতটা হবে সেটাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন, তবে জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
আমাদের দেশে আরও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে তো কাজে লাগাতে হবে। নতুন সংযোগ বন্ধ এবং বিদ্যমান সরবরাহ চালু রাখতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থনীতিতে ধস নামতে বাধ্য। অথচ জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর মহাজোট সরকার তিন বছরে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর ব্যাপারে একটা কুটোও ছিঁড়ে দু’টুকরা করতে পারল না, এ কেমন কথা। এখন আমাদের গল্প শোনানো হচ্ছে যে, ২০১২ সালে নাকি গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ভালো কথা! অন্তর্বর্তী সময়টায় কি জাতি শুধু ‘স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি’র বক্তৃতা শুনেই কাটাবে?
No comments