যাত্রাশিল্পেও জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন by মিলন কান্তি দে

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত তারবার্তাটি পেঁৗছে যায় সবখানে। 'সব প্রস্তুত, যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব দরজায়'। জনতা জ্বলছে। যাত্রামঞ্চের ঐকতান থেমে যায়। শত শত যাত্রাশিল্পী পূর্বধলা থানা প্রাঙ্গণে সমবেত হন। সম্মিলিত কণ্ঠের আওয়াজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়_ 'এ দেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।'


থানার বড় দারোগা রমেন দাশ যাত্রাশিল্পীর হাতে অস্ত্র তুলে দেন। তারপর দেশপ্রেমিক সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে যাত্রাশিল্পীদেরও রণাঙ্গনে ছুটে চলা



'৭১-এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি যাত্রাশিল্পীদের মধ্যেও জ্বলে উঠেছিল জাতীয় চেতনার অগি্নস্ফুলিঙ্গ। 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'_ বজ্রকণ্ঠের সেই ছন্দময় ধ্বনি গোটা জাতিকে নিমেষে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। আমজনতার সামনে তখন_ ওই দেখা যায় মুক্তির নতুন সূর্য। ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে যাত্রাশিল্পীরা যাত্রামঞ্চ ছেড়ে 'ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত' স্বাধীনতার রাঙা প্রভাতের জন্য বেরিয়ে পড়েছিল রাজপথে। মার্চ মাসজুড়ে বিদ্রোহের নানা কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যাত্রাঙ্গন। রাতে মঞ্চস্থ হতো গণজাগরণমূলক পালা আর দিনের বেলায় শিল্পীরা লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল বের করত। কখনও নিজেরা দল বেঁধে, কখনও বা স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলেমিশে। যাত্রাশিল্পীদের মিছিল থেকে ভেসে আসত সুকান্তের কবিতা_ 'বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।'
'৭১-এর সেই স্মৃতি, সেই আগুনঝরা দিনগুলো আজও যেন আমার রোজনামচায় জ্বলজ্বল করছে। আমি তখন চট্টগ্রামের বাবুল অপেরায়। জাতীয় জাগরণ এবং যাত্রাশিল্পের সৃজনশীল আন্দোলনে এই দলের অবদান অনেক। অমলেন্দু বিশ্বাস, মঞ্জুশ্রী মুখার্জী, জাহানারা বেগম, এমএ হামিদসহ আরও অনেক স্বনামধন্য যাত্রাশিল্পীর প্রতিভার বিকাশ ঘটে এই দল থেকে। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় দলটি 'একটি পয়সা' নামে এক বিপ্লবী পালা মঞ্চায়ন করেছিল। এই পালার আবেদন '৭১-এ ছড়িয়ে পড়ে শহর-বন্দর-গ্রামে। এর প্রতিটি সংলাপ তির্যক, শাণিত এবং সহজেই গণমানুষকে উজ্জীবিত করার মতো। যেমন স্বৈরশাসক ও পুঁঁজিবাদী চক্রের বিরুদ্ধে পালার প্রতিবাদী নায়কের উচ্চারণ_ 'সেই পুঁঁজিপতি ভগবানদের কাছে আর কোনো আবেদন নয়, কোনো প্রার্থনা নয়, মেহনতি মানুষের সংঘশক্তির প্রচণ্ড আঘাতে তাদের খুশির অট্টালিকা ভেঙেচুরে কায়েম করতে হবে সংগ্রামী জনতার ন্যায্য অধিকার।' একদিকে চলছে অসহযোগ আন্দোলন, আরেক দিকে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের সেই হাঁক_ 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল', সেই উত্তাল সময়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, 'একটি পয়সা' যাত্রাপালার শিল্পীরা মঞ্চে আসামাত্র উত্তেজিত দর্শক মুহুর্মুহু স্লোগান দিয়ে উঠত 'জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু'। ঝিনাইদহ জেলার তদানীন্তন এমএনএ (জাতীয় পরিষদ সদস্য, দুই পুত্রসহ শহীদ) ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম একবার 'একটি পয়সা'র অভিনয় দেখে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছিলেন, 'আমাদের আন্দোলনকে যাত্রাশিল্পীরাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।'
দেশ ও জাতির বিভিন্ন যুগসন্ধিক্ষণে লোকায়ত জনপদের তৃণমূল যাত্রাশিল্পীদেরও যে এক-আধটু ভূমিকা ছিল, তারাও যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এর মূল্যায়ন নেই জাতীয় শিল্প-সংস্কৃতিতে। এ জন্য আমাদের দুঃখ নেই। কারণ পরবর্তী কোনো না কোনো প্রজন্ম সত্য ইতিহাস খুঁজে পাবেই। ৭ মার্চের ভাষণের খবর পরদিন যখন রেডিওতে জানতে পারেন শিল্পীরা, তখন দলে দলে আনন্দ অনুষ্ঠানের জোয়ার বয়ে যায়। বাবুল অপেরার যাত্রা চলছে তখন গাইবান্ধা জেলার ভরতখালী রেলস্টেশন বাজারে। সেই মঞ্চে মঞ্জুশ্রী মুখার্জী, এ দেশের যাত্রার প্রথম নায়িকা বঙ্গবন্ধুকে বন্দনা করেছিলেন গানে গানে_ ধন্য বাংলা, হে বিজয়ী বীর, ধরিয়া তোমায় বক্ষে/কত যে সাজালো কুসুম অর্ঘ্য তোমার চরণ লক্ষ্যে। বিশিষ্ট যাত্রা দম্পতি অমলেন্দু বিশ্বাস-জ্যোৎস্না বিশ্বাস (দু'জনেই একুশে পদকপ্রাপ্ত) তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। খবর পেলাম, তারা সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরার ব্যানারে দেশাত্মবোধক সঙ্গীতানুষ্ঠান করছেন ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল হাইস্কুল মাঠে। ২৫ মার্চের পর পাক হানাদার বাহিনীর হামলা শুরু হলে তারা চলে যান পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জে। সেখানে বাংলাদেশের শরণার্থীদের মনোবল বাড়িয়ে তুলতে তারা কয়েকদিন যুদ্ধ-জাগরণের পালা মঞ্চায়ন করেছিলেন।
এর আগে ২৩ মার্চ একটি ঘটনা ঘটেছিল। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। তিনি যখন ভাষণ দিতে মঞ্চে উঠবেন, সেই সময় অদূরে এক যাত্রা প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছিল গণসঙ্গীতের সুরমূর্ছনা। ভাসানী পরে জানতে পারলেন, চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন যাত্রাশিল্পীরাও। তখন তিনি উৎফুল্ল চিত্তে উচ্চারণ করেন-'সাবাস'! মার্চের শেষদিকে যাত্রাশিল্পীদের জাগরণী অনুষ্ঠানগুলো ভিন্ন মাত্রা পায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ব্যর্থ আলোচনা এবং বারবার জাতীয় পরিষদের তারিখ পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় যাত্রামঞ্চে তখন পরিবেশিত হতে থাকে ইয়াহিয়া-ভুট্টোকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের নাটিকা। পালা শুরুর আগে পাকিস্তানের এ দুই নাটের গুরুর কুশপুত্তলিকাও দাহ করে কোনো কোনো যাত্রার দল। ২৫ মার্চ রাতে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা হাইস্কুল মাঠে বাবুল অপেরার এক বিপ্লবী যাত্রাপালায় অভিনেত্রী জাহানারার সংলাপ ছিল : 'জাঁহাপনা কি বাংলা আক্রমণ করতে চান? কেন আপনার সৈন্যদলকে লেলিয়ে দিয়েছেন নিরীহ জনতার ওপর? কত মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, কত দোকানপাট লুট হয়েছে, খবর রাখেন কিছু?' ঘটনার কী ভয়ানক সমান্তরাল যোগাযোগ! সেই একই রাতে একই সময়ে রাজধানীর রাজপথে ঘুমন্ত নরনারীর ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা।
১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আমার সম্পাদনায় যাত্রাবিষয়ক একটি দেয়াল পত্রিকা বের হতো। নাম 'মঞ্চশ্রী'। মার্চের শেষে পত্রিকার ষষ্ঠ সংখ্যায় সম্পাদকীয় ছিল কবি নজরুল ইসলামের কবিতার উদৃব্দতি_ 'এ দেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।'
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত তারবার্তাটি পেঁৗছে যায় সবখানে। 'সব প্রস্তুত, যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব দরজায়'। জনতা জ্বলছে। যাত্রামঞ্চের ঐকতান থেমে যায়। শত শত যাত্রাশিল্পী পূর্বধলা থানা প্রাঙ্গণে সমবেত হন। সম্মিলিত কণ্ঠের আওয়াজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়_ 'এ দেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।' থানার বড় দারোগা রমেন দাশ যাত্রাশিল্পীর হাতে অস্ত্র তুলে দেন। তারপর দেশপ্রেমিক সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে যাত্রাশিল্পীদেরও রণাঙ্গনে ছুটে চলা। পূর্ব দিগন্তে ওঠে নতুন সূর্য। রক্তবর্ণে লেখা হয় আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। লেখা হয় মুক্তিযুদ্ধের পালা। পালার ঐকতানে শোনা যায় বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ। সে আরেক ইতিহাস, যে ইতিহাসের সূচনা একাত্তরের মার্চে।

স মিলন কান্তি দে : যাত্রা ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.