ধর্ম-তারাবির নামাজ আদায়ের ফজিলত by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
রমজান মাসের রাতে এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, একে তারাবির নামাজ বলা হয়। আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা।
ইসলামের পরিভাষায় মাহে রমজানে তারাবির নামাজ পড়াকালীন প্রতি দুই রাকাত অথবা চার রাকাত পর পর বিশ্রাম করার জন্য একটু বসার নামই ‘তারাবি’। মাহে রমজানে রোজাদার সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে যান। তারপর রাতে এশা ও তারাবির নামাজ দীর্ঘ সময় ধরে পড়তে হয়। সেই কারণে দীর্ঘ নামাজের কঠোর পরিশ্রম লাঘব করার জন্য প্রতি দুই রাকাত, বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করতে হয় এবং দোয়া ও তাসবিহ পাঠ করতে হয়। এ জন্য এই নামাজকে ‘সালাতুত তারাবিহ’ বা তারাবির নামাজ বলা হয়।
রমজান মাসের নির্দিষ্ট নামাজ হচ্ছে সালাতুত তারাবিহ। তারাবির নামাজ হলো রোজার গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। রমজান মাসে তারাবির নামাজ জামাতে পড়া ও সম্পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তারাবির নামাজ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা বেশি সওয়াবের কাজ। তবে ঘরেও আদায় করা যেতে পারে। এ নামাজে কোরআন শরিফ খতম করা অধিক সওয়াবের কাজ। তবে সূরা-কিরাআতের মাধ্যমে আদায় করলেও নামাজের সব সওয়াবই পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তারাবির নামাজের জন্য রাতের কোনো বিশেষ সময়কে নির্দিষ্ট করে দেননি। তবে তারাবির নামাজ অবশ্যই এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের পূর্ববর্তী সময়ের মধ্যে আদায় করতে হবে। নবী করিম (সা.) এ নামাজ বেশির ভাগ সময় রাতের শেষাংশে আদায় করতেন এবং প্রথমাংশে বিশ্রাম নিতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করেছেন। তিনি কখনো ৮ রাকাত, কখনো ১৬ রাকাত, আবার কখনো ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু বিশেষ কারণবশত নিয়মিত ২০ রাকাত পড়তেন না। কেননা নবী করিম (সা.) কোনো কাজ নিয়মিত করলে তা উম্মতের জন্য ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়। এ করুণা দৃষ্টির কারণে তিনি তাঁর আমলে প্রতিনিয়ত ২০ রাকাত পূর্ণ তারাবির জামাত হতে দেননি। যার দরুন সালাতুত তারাবিহ সুন্নত, ওয়াজিব নয়; তবে সুন্নতে মুয়াক্কাদা বা জরুরি সুন্নত। ২০ রাকাত তারাবির নামাজ হওয়ার সপক্ষে সহিহ হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে ‘নবী করিম (সা.) রমজান মাসে বিনা জামাতে (একাকী) ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতেন, অতঃপর বিতর নামাজ পড়তেন।’ (বায়হাকি)
মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর তারাবির নামাজ ওয়াজিব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আর থাকেনি। তাই তারাবির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে কার্যকর হয়। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালেও তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়া হতো। হজরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে সাহাবিদের খণ্ড খণ্ড জামাতে ও একাকী তারাবির নামাজ পড়তে দেখে সবাই মিলে এক জামাতে তারাবি পড়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সাহাবিদের ইজমা দ্বারা মূলত রমজান মাসের মধ্যে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার রীতির প্রচলন হয়।
তারাবির নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রমজানের রাতে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তাঁর অতীতকৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) মাহে রমজানে রোজা, তারাবির নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের দরুন আল্লাহ তাআলা রোজাদার ব্যক্তির আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। এ মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় রোজা রাখেন, তারাবির নামাজ পড়েন এবং কদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁর জীবনের আগের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা তারাবির নামাজ আদায় করতেন। তবে তিনি মাত্র চার রাত তারাবির নামাজ জামাতে পড়েছিলেন আর কখনো তিনি তারাবির নামাজ জামাতে পড়েননি। কারণ নবীজি মনে করেছিলেন যে যদি তিনি সর্বদা জামাতে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তাহলে তাঁর উম্মতেরা ভাববেন যে হয়তো এই তারাবির নামাজ ফরজ। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই রাতে ২০ রাকাত করে তারাবির নামাজ পড়িয়েছেন। তৃতীয় রাতে লোকজন জমা হলেও রাসুলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত হননি। পরদিন সকালে তিনি ইরশাদ করলেন, ‘আমি তোমাদের ওপর তারাবির নামাজ ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছি। তখন তো তা তোমাদের জন্য কষ্টকর হবে।’ তাই ইচ্ছাকৃত ও নিয়মিত নয়, বরং দৈহিক বা মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ২০ রাকাত অথবা ৮ রাকাত তারাবির সুন্নত নামাজ পড়ার সুযোগ আছে।
তারাবির নামাজের কিয়াম হলো আল্লাহর রাস্তায় আরামকে হারাম করে কঠোর পরিশ্রম করার শপথ অনুষ্ঠান। তারাবির নামাজের প্রতিটি মুহূর্ত পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণ ও আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে, জীবনে সফলকাম হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং কঠোর পরিশ্রমের শপথ নিতে হবে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা রমজানের রোজাগুলো ফরজ করেছেন এবং এর রাতে তারাবির নামাজের জন্য দণ্ডায়মান হওয়াকে অশেষ পুণ্যের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
রমজান মাসের নির্দিষ্ট নামাজ হচ্ছে সালাতুত তারাবিহ। তারাবির নামাজ হলো রোজার গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। রমজান মাসে তারাবির নামাজ জামাতে পড়া ও সম্পূর্ণ কোরআন শরিফ একবার খতম করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তারাবির নামাজ নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা বেশি সওয়াবের কাজ। তবে ঘরেও আদায় করা যেতে পারে। এ নামাজে কোরআন শরিফ খতম করা অধিক সওয়াবের কাজ। তবে সূরা-কিরাআতের মাধ্যমে আদায় করলেও নামাজের সব সওয়াবই পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) তারাবির নামাজের জন্য রাতের কোনো বিশেষ সময়কে নির্দিষ্ট করে দেননি। তবে তারাবির নামাজ অবশ্যই এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের পূর্ববর্তী সময়ের মধ্যে আদায় করতে হবে। নবী করিম (সা.) এ নামাজ বেশির ভাগ সময় রাতের শেষাংশে আদায় করতেন এবং প্রথমাংশে বিশ্রাম নিতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করেছেন। তিনি কখনো ৮ রাকাত, কখনো ১৬ রাকাত, আবার কখনো ২০ রাকাত তারাবি নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু বিশেষ কারণবশত নিয়মিত ২০ রাকাত পড়তেন না। কেননা নবী করিম (সা.) কোনো কাজ নিয়মিত করলে তা উম্মতের জন্য ওয়াজিব তথা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়। এ করুণা দৃষ্টির কারণে তিনি তাঁর আমলে প্রতিনিয়ত ২০ রাকাত পূর্ণ তারাবির জামাত হতে দেননি। যার দরুন সালাতুত তারাবিহ সুন্নত, ওয়াজিব নয়; তবে সুন্নতে মুয়াক্কাদা বা জরুরি সুন্নত। ২০ রাকাত তারাবির নামাজ হওয়ার সপক্ষে সহিহ হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে ‘নবী করিম (সা.) রমজান মাসে বিনা জামাতে (একাকী) ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতেন, অতঃপর বিতর নামাজ পড়তেন।’ (বায়হাকি)
মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর তারাবির নামাজ ওয়াজিব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আর থাকেনি। তাই তারাবির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব হজরত ওমর (রা.)-এর আমলে কার্যকর হয়। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ও দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালেও তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়া হতো। হজরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে সাহাবিদের খণ্ড খণ্ড জামাতে ও একাকী তারাবির নামাজ পড়তে দেখে সবাই মিলে এক জামাতে তারাবি পড়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সাহাবিদের ইজমা দ্বারা মূলত রমজান মাসের মধ্যে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার রীতির প্রচলন হয়।
তারাবির নামাজের ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে পুণ্য লাভের আশায় রমজানের রাতে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তাঁর অতীতকৃত পাপগুলো ক্ষমা করা হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) মাহে রমজানে রোজা, তারাবির নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদতের দরুন আল্লাহ তাআলা রোজাদার ব্যক্তির আগের সব গুনাহ মাফ করে দেন। এ মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে সওয়াব প্রাপ্তির আশায় রোজা রাখেন, তারাবির নামাজ পড়েন এবং কদরের রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করেন, তাঁর জীবনের আগের সব গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বদা তারাবির নামাজ আদায় করতেন। তবে তিনি মাত্র চার রাত তারাবির নামাজ জামাতে পড়েছিলেন আর কখনো তিনি তারাবির নামাজ জামাতে পড়েননি। কারণ নবীজি মনে করেছিলেন যে যদি তিনি সর্বদা জামাতে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তাহলে তাঁর উম্মতেরা ভাববেন যে হয়তো এই তারাবির নামাজ ফরজ। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই রাতে ২০ রাকাত করে তারাবির নামাজ পড়িয়েছেন। তৃতীয় রাতে লোকজন জমা হলেও রাসুলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত হননি। পরদিন সকালে তিনি ইরশাদ করলেন, ‘আমি তোমাদের ওপর তারাবির নামাজ ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছি। তখন তো তা তোমাদের জন্য কষ্টকর হবে।’ তাই ইচ্ছাকৃত ও নিয়মিত নয়, বরং দৈহিক বা মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে ২০ রাকাত অথবা ৮ রাকাত তারাবির সুন্নত নামাজ পড়ার সুযোগ আছে।
তারাবির নামাজের কিয়াম হলো আল্লাহর রাস্তায় আরামকে হারাম করে কঠোর পরিশ্রম করার শপথ অনুষ্ঠান। তারাবির নামাজের প্রতিটি মুহূর্ত পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণ ও আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে, জীবনে সফলকাম হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং কঠোর পরিশ্রমের শপথ নিতে হবে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা রমজানের রোজাগুলো ফরজ করেছেন এবং এর রাতে তারাবির নামাজের জন্য দণ্ডায়মান হওয়াকে অশেষ পুণ্যের কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments