আটার বাজার জিম্মি ব্যবসায়ীদের হাতে-দুই মাসে কেজিতে দাম বেড়েছে ১২ টাকা by শফিকুল ইসলাম জুয়েল
সকালে ও রাতে দুটি করে রুটি পেঁয়াজের চাটনি দিয়ে খাইতাম। এখন আটার দাম বাড়ায় সেই রুটিও বোধ হয় আর ভাগ্যে জুটবে না। গরিব মানুষ কেমনে বাঁচবে কইতে পারেন?' গতকাল শনিবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে আটা কিনতে আসা তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তির বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব সুফিয়া বেওয়া অসহায় গলায় বলেন এ কথা। নেত্রকোনার বাসিন্দা
সুফিয়া আরো বলেন, 'ভিক্ষুকের এ জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই দেখেছি। আগে মানুষ চাল ভিক্ষা দিলেও এখন তা আর স্বপ্নেও ভাবা যায় না। সারা দিনের ভিক্ষায় যে টাকা মেলে, তা দিয়ে এখন আধা কেজি আটাও কেনা যায় না। এক নাতনিকে নিয়ে খুবই কষ্টে দিন পার করতে হয়।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি খোলা আটায় পাইকারি ১০-১১ টাকা এবং খুচরা বাজারে ১২-১৩ টাকা দাম বেড়েছে। প্যাকেট আটার কেজিতে বেড়েছে অন্তত ১৫ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, আটার দামে এখন স্মরণকালের রেকর্ড।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের স্টার বেকারিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সব পণ্যেরই দামে ঊর্ধ্বগতি। ম্যানেজার আলমগীর হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, দেড় মাস আগে এক কেজি টোস্ট বিস্কুটের কেজি ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা ছিল। এ ছাড়া হরলিকস, তিল, ফ্রুট বিসু্কটের প্রতি কেজি ২৭০ থেকে এখন ৩০০ টাকা। ১৫০ টাকা কেজির চেরিফুল বিস্কুটও এখন ১৮০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। তিনি জানান, দেড়-দুই মাস ধরে আটা-ময়দার দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে বেকারি সামগ্রীর দামও বাড়াতে হয়েছে।
এই বেকারিতে বিস্কুট কিনতে আসা কাঁঠালবাগান এলাকার তানিয়া মমতাজ বলেন, 'বেকারি সামগ্রী নিয়মিতই কিনতে হয়। এসব পণ্যের দাম অব্যাহত বাড়লেও চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।' এ সময় আরেক ক্রেতা সালমা বেগম বলেন, 'পণ্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বগতিতে কখনো কখনো মনে হয় দেশটি আল্লার ওয়াস্তে চলছে। হাজারো ভোগান্তি-কষ্ট কেউ যেন দেখার নেই। আর যে পণ্যের দাম একবার বাড়ে তা আর কমে না।'
বাজার বিশ্লেষক এবং সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টোস্ট বিস্কুটের কেজিতে পাঁচ-সাত টাকা কিংবা সুস্বাদু বিস্কুটের কেজিতে ৩০ টাকা দাম বৃদ্ধি মধ্য ও উচ্চবিত্ত মানুষের গায়ে তেমন না লাগলেও এক কেজি আটার দাম ১২-১৩ টাকা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব মোকাবিলা করা রিকশাচালক কিংবা দিনমজুরের জন্য খুবই কষ্টকর। তাঁদের অভিযোগ, সরকারের সুষ্ঠু বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা এবং মিল না থাকার সুযোগ নিয়ে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী আটার বাজার জিম্মি করে ফেলেছেন। তাঁরা গরিব মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ লুটে নিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। অথচ এবারই বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ গম উৎপাদিত হয়েছে। এমনকি সরকারের কাছেও রয়েছে যথেষ্ট মজুদ।
তবে আটার দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে হাত নেই বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতির কারণে দাম বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠু হলে দ্রুত এলসি খোলা যাবে এবং আটার দামও কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের খাদ্য বিভাগের সচিব বরুণ দেব মিত্র গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকারের নানামুখী কর্মসূচির কারণে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে আটার দাম। গরিব মানুষের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আটার দাম দ্রুত কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। এরই মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে তাঁদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের মজুদকৃত গম বেসরকারি মিলকে বরাদ্দ দিয়ে আটা করে দ্রুত বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।'
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) হিসাবে, গত বুধবার খোলা আটার কেজি ছিল ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা, যা গত ৭ জানুয়ারিতে বিক্রি হয়েছে ২৫ থেকে ২৬ টাকায়। খাদ্য অধিদপ্তরের বাজার মনিটরিং বিভাগের হিসাবে, গত ৭ মার্চ খোলা আটার কেজি ছিল ৩৩ টাকা ৫০ পয়সা, যা ৭ জানুয়ারি বিক্রি হয়েছে ২৫ টাকায়। অন্যদিকে কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, নিউ মার্কেট, রামপুরা বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, গত দুই মাসে আটার দাম বেড়েছে কেজিতে অন্তত ১২ থেকে ১৩ টাকা।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর লেখা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতেও আটার দামের ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, দেশে গমের আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। গত বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করলেও এ বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত করেছেন মাত্র সাত লাখ ৮৬ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টন; যা আগের এক বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ এবং গত চার বছরের গড় পরিমাণের তুলনায় ৫৪ শতাংশ কম। এ ছাড়া গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে গম আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় তা যথাক্রমে ৮০ ও ৫৭ শতাংশ কম।
ওই চিঠিতে বলা হয়, দ্রুত গম আমদানি করা না গেলে বাজারে আটার দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য গম আমদানিতে দ্রুত এলসি খোলার সুবিধার্থে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে চালের মজুদ ১১ লাখ ৩০ হাজার টন। গমের মজুদ দুই লাখ ৬৯ হাজার টন। খালাসের অপেক্ষায় আছে চার হাজার ২৮৭ টন চাল ও ৩১ হাজার ৫৭২ টন গম। তাদের হিসাবে, গত বছরের ৭ মার্চ চাল ও গম মিলে মজুদ ছিল আট লাখ ৯৫ হাজার ৭৭০ টন। এবারের মজুদ ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫৭ টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, মানুষের খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। এ জন্য প্রতিদিনই বাড়ছে আটার চাহিদা। গত বছর দেশে আটার চাহিদা ছিল ৪০ লাখ টন। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় আট লাখ টন। সরকারি পর্যায়ে আমদানি হয় সাত-আট লাখ টন। অবশিষ্ট বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা আমদানি করে জোগান দেন।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পোস্তগোলায় একটি মিল আটা উৎপাদন করত। রাজনীতির শিকার হয়ে মিলটি বন্ধ হয়ে গেলে গম থেকে আটা করার প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়ে সরকার। ফলে আটার বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে। হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ীর ইচ্ছায় দাম বাড়ে-কমে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক
আটার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ব্যবসায়ী ও সরকারি পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আটার মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করার পর তা সমাধানের সুপারিশ করা হয়।
বৈঠকে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, চলতি বছর বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানি কম হওয়া, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গম তথা আটার দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া অনেক পোলট্রি খামার বন্ধ ও পুকুর শুকিয়ে যাওয়ায় মুরগি ও মাছের অন্যতম খাবারের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় ভুসির দাম কমেছে, যা আটার দামে প্রভাব ফেলেছে।
মেঘনা গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (কম্পানি অ্যাফেয়ার্স) আবদুল করিম বলেন, 'আটার মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য মজুদকৃত গমের বরাদ্দ দ্রুত বাড়িয়ে বাজারে আটার সরবরাহ পর্যাপ্ত করতে হবে।'
সিটি গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'সম্প্রতি ৮২ থেকে ৮৫ টাকা দরে ডলার কিনে এলসি খুলতে হচ্ছে। এ হার আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদের হার কাটছে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। অনেক সময়ই ব্যাংক ফান্ড দিতে না পারায় এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না।'
ইফাদ গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক জামাল রাজ্জাক বলেন, 'ডলার সংকটের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা দ্রুত নেওয়া না হলে আটার মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে না।'
এফপিএমইউয়ের মহাপরিচালক বলেন, 'দুই-তিন সপ্তাহ ধরে ডলারের দাম কমছে। এখন ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে এলসি খুলতে পারবেন। এ ছাড়া আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও ইউক্রেনের নতুন গম বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আবদুল মান্নান বলেন, '২০১০-১১ অর্থবছরে এলসির পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমেছিল। বর্তমানে এ সংকট কেটে যাচ্ছে।' অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব গকুল চাঁদ দাস বলেন, 'ডলার সরবরাহের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করতে পারে না। আর প্রায় ৬০ শতাংশ ডলার জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয়।' তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'বাজারে আটার সরবরাহ বৃদ্ধি করতে ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব নিয়ে এলসি খুলে গম আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।'
ওই সভায় খাদ্যসচিব বরুণ দেব মিত্র বলেন, খাদ্যের জোগান দিতে সরকার ওএমএসের মাধ্যমে চাল (কেজি ২৪ টাকা) ও আটা (১৯ টাকা) অল্প দামে বিক্রি করে যাচ্ছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে আটার মূল্যবৃদ্ধি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি ও সুনামের প্রশ্ন জড়িত। তিনি বলেন, ডলার সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুতগতিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। এ জন্য সরকার বিলাস সামগ্রীর আমদানি কমিয়ে খাদ্যপণ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এলসি খুলতে প্রয়োজনে সার্কুলার জারি করতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত দুই মাসের ব্যবধানে প্রতি কেজি খোলা আটায় পাইকারি ১০-১১ টাকা এবং খুচরা বাজারে ১২-১৩ টাকা দাম বেড়েছে। প্যাকেট আটার কেজিতে বেড়েছে অন্তত ১৫ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, আটার দামে এখন স্মরণকালের রেকর্ড।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের স্টার বেকারিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সব পণ্যেরই দামে ঊর্ধ্বগতি। ম্যানেজার আলমগীর হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, দেড় মাস আগে এক কেজি টোস্ট বিস্কুটের কেজি ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা ছিল। এ ছাড়া হরলিকস, তিল, ফ্রুট বিসু্কটের প্রতি কেজি ২৭০ থেকে এখন ৩০০ টাকা। ১৫০ টাকা কেজির চেরিফুল বিস্কুটও এখন ১৮০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। তিনি জানান, দেড়-দুই মাস ধরে আটা-ময়দার দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে বেকারি সামগ্রীর দামও বাড়াতে হয়েছে।
এই বেকারিতে বিস্কুট কিনতে আসা কাঁঠালবাগান এলাকার তানিয়া মমতাজ বলেন, 'বেকারি সামগ্রী নিয়মিতই কিনতে হয়। এসব পণ্যের দাম অব্যাহত বাড়লেও চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।' এ সময় আরেক ক্রেতা সালমা বেগম বলেন, 'পণ্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বগতিতে কখনো কখনো মনে হয় দেশটি আল্লার ওয়াস্তে চলছে। হাজারো ভোগান্তি-কষ্ট কেউ যেন দেখার নেই। আর যে পণ্যের দাম একবার বাড়ে তা আর কমে না।'
বাজার বিশ্লেষক এবং সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টোস্ট বিস্কুটের কেজিতে পাঁচ-সাত টাকা কিংবা সুস্বাদু বিস্কুটের কেজিতে ৩০ টাকা দাম বৃদ্ধি মধ্য ও উচ্চবিত্ত মানুষের গায়ে তেমন না লাগলেও এক কেজি আটার দাম ১২-১৩ টাকা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব মোকাবিলা করা রিকশাচালক কিংবা দিনমজুরের জন্য খুবই কষ্টকর। তাঁদের অভিযোগ, সরকারের সুষ্ঠু বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা এবং মিল না থাকার সুযোগ নিয়ে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী আটার বাজার জিম্মি করে ফেলেছেন। তাঁরা গরিব মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ লুটে নিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। অথচ এবারই বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ গম উৎপাদিত হয়েছে। এমনকি সরকারের কাছেও রয়েছে যথেষ্ট মজুদ।
তবে আটার দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে হাত নেই বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতির কারণে দাম বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম সুষ্ঠু হলে দ্রুত এলসি খোলা যাবে এবং আটার দামও কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের খাদ্য বিভাগের সচিব বরুণ দেব মিত্র গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকারের নানামুখী কর্মসূচির কারণে চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে আটার দাম। গরিব মানুষের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আটার দাম দ্রুত কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। এরই মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ের আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে তাঁদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের মজুদকৃত গম বেসরকারি মিলকে বরাদ্দ দিয়ে আটা করে দ্রুত বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।'
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) হিসাবে, গত বুধবার খোলা আটার কেজি ছিল ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা, যা গত ৭ জানুয়ারিতে বিক্রি হয়েছে ২৫ থেকে ২৬ টাকায়। খাদ্য অধিদপ্তরের বাজার মনিটরিং বিভাগের হিসাবে, গত ৭ মার্চ খোলা আটার কেজি ছিল ৩৩ টাকা ৫০ পয়সা, যা ৭ জানুয়ারি বিক্রি হয়েছে ২৫ টাকায়। অন্যদিকে কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, নিউ মার্কেট, রামপুরা বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, গত দুই মাসে আটার দাম বেড়েছে কেজিতে অন্তত ১২ থেকে ১৩ টাকা।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর লেখা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতেও আটার দামের ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, দেশে গমের আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। গত বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত এক বছরে বেসরকারি ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানি করলেও এ বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত করেছেন মাত্র সাত লাখ ৮৬ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টন; যা আগের এক বছরের তুলনায় ৪৪ শতাংশ এবং গত চার বছরের গড় পরিমাণের তুলনায় ৫৪ শতাংশ কম। এ ছাড়া গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে গম আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় তা যথাক্রমে ৮০ ও ৫৭ শতাংশ কম।
ওই চিঠিতে বলা হয়, দ্রুত গম আমদানি করা না গেলে বাজারে আটার দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য গম আমদানিতে দ্রুত এলসি খোলার সুবিধার্থে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
এদিকে খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে চালের মজুদ ১১ লাখ ৩০ হাজার টন। গমের মজুদ দুই লাখ ৬৯ হাজার টন। খালাসের অপেক্ষায় আছে চার হাজার ২৮৭ টন চাল ও ৩১ হাজার ৫৭২ টন গম। তাদের হিসাবে, গত বছরের ৭ মার্চ চাল ও গম মিলে মজুদ ছিল আট লাখ ৯৫ হাজার ৭৭০ টন। এবারের মজুদ ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫৫৭ টন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, মানুষের খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। এ জন্য প্রতিদিনই বাড়ছে আটার চাহিদা। গত বছর দেশে আটার চাহিদা ছিল ৪০ লাখ টন। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত হয় আট লাখ টন। সরকারি পর্যায়ে আমদানি হয় সাত-আট লাখ টন। অবশিষ্ট বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা আমদানি করে জোগান দেন।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পোস্তগোলায় একটি মিল আটা উৎপাদন করত। রাজনীতির শিকার হয়ে মিলটি বন্ধ হয়ে গেলে গম থেকে আটা করার প্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়ে সরকার। ফলে আটার বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে। হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ীর ইচ্ছায় দাম বাড়ে-কমে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক
আটার দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ব্যবসায়ী ও সরকারি পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আটার মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করার পর তা সমাধানের সুপারিশ করা হয়।
বৈঠকে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, চলতি বছর বেসরকারি পর্যায়ে গম আমদানি কম হওয়া, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গম তথা আটার দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া অনেক পোলট্রি খামার বন্ধ ও পুকুর শুকিয়ে যাওয়ায় মুরগি ও মাছের অন্যতম খাবারের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় ভুসির দাম কমেছে, যা আটার দামে প্রভাব ফেলেছে।
মেঘনা গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (কম্পানি অ্যাফেয়ার্স) আবদুল করিম বলেন, 'আটার মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য মজুদকৃত গমের বরাদ্দ দ্রুত বাড়িয়ে বাজারে আটার সরবরাহ পর্যাপ্ত করতে হবে।'
সিটি গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, 'সম্প্রতি ৮২ থেকে ৮৫ টাকা দরে ডলার কিনে এলসি খুলতে হচ্ছে। এ হার আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদের হার কাটছে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। অনেক সময়ই ব্যাংক ফান্ড দিতে না পারায় এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না।'
ইফাদ গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক জামাল রাজ্জাক বলেন, 'ডলার সংকটের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা দ্রুত নেওয়া না হলে আটার মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে না।'
এফপিএমইউয়ের মহাপরিচালক বলেন, 'দুই-তিন সপ্তাহ ধরে ডলারের দাম কমছে। এখন ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে এলসি খুলতে পারবেন। এ ছাড়া আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও ইউক্রেনের নতুন গম বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক আবদুল মান্নান বলেন, '২০১০-১১ অর্থবছরে এলসির পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমেছিল। বর্তমানে এ সংকট কেটে যাচ্ছে।' অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব গকুল চাঁদ দাস বলেন, 'ডলার সরবরাহের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করতে পারে না। আর প্রায় ৬০ শতাংশ ডলার জ্বালানি তেল আমদানিতে ব্যয় হয়।' তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'বাজারে আটার সরবরাহ বৃদ্ধি করতে ব্যবসায়ীদের দায়িত্ব নিয়ে এলসি খুলে গম আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।'
ওই সভায় খাদ্যসচিব বরুণ দেব মিত্র বলেন, খাদ্যের জোগান দিতে সরকার ওএমএসের মাধ্যমে চাল (কেজি ২৪ টাকা) ও আটা (১৯ টাকা) অল্প দামে বিক্রি করে যাচ্ছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে আটার মূল্যবৃদ্ধি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি ও সুনামের প্রশ্ন জড়িত। তিনি বলেন, ডলার সংকটের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুতগতিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। এ জন্য সরকার বিলাস সামগ্রীর আমদানি কমিয়ে খাদ্যপণ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে এলসি খুলতে প্রয়োজনে সার্কুলার জারি করতে পারে।
No comments