ক্লাসঘরের কথা : ২-ড. জেকিল ও মি. হাইড by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
(পূর্বপ্রকাশের পর) সুতরাং ইভল ঈশ্বরের বাইরের কিছু নয়। যদি বাইরের হতো তবে ঈশ্বর তো তাকে সৃষ্টি করতে পারতেন না। সৃষ্টি তো চিরকালই স্রষ্টার অংশ। আপাতদৃষ্টে ঈশ্বর ও শয়তানকে বৈরী মনে হলেও এদের উৎস এক। তবে শয়তানের একটা দুর্বল জায়গা আছে।
সৃষ্টি ইতিধর্মী বলে শক্তিমান হয়েও শয়তান শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। সে জন্যেই সব ধর্মে এর স্বীকৃতি। অবশ্য মানুষের মধ্যে এই অশুভের একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। ক্রমবিকাশের একটা পর্বে মানুষ ছিল ৎবঢ়ঃরষব বা সরীসৃপ। সে ছিল বীভৎস, নিষ্ঠুর, ভয়ংকর। বহু কোটি বছর আগে মানুষ পেরিয়ে এসেছে সেই পর্ব। পরবর্তীতে এই স্তর পিছে ফেলে মানুষ এক সময় সভ্য ও উন্নত হয়েছে। অনেক কল্যাণ আর মঙ্গলের চিন্তা সে তখন করেছে। তার মস্তিষ্কও অনেক মহৎ আর শ্রেয়ধর্মী হয়ে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু তার মস্তিষ্কের গভীরে সেই সরীসৃপ স্তরটি এখনো রয়ে গেছে যা বিকৃত, নিষ্ঠুর, ধ্বংসাত্মক। মানুষের প্রতিটি শুভ উদ্যোগের তল থেকে এখনো সে সারাক্ষণ তার অশুভ মুখ জাগায়। আমাদের প্রতিদিনের প্রতিটি শুভ উদ্যোগকে সে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে। সভ্যতার ইতিহাসে গৌতমবুদ্ধ, খ্রিস্ট, মোহাম্মদ পেরিয়েও তাই থেকে থেকেই হিটলার-চেঙ্গিসেরা ভয়াল মুখব্যাদান করে দেখা দেয়।
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, খারাপ কী, উত্তরে বলা যাবে, সবার জন্যে না হলেও অধিকাংশের জন্যে যা দুঃখের তাই খারাপ। এখন প্রশ্ন, সবার জন্যে কেন নয়? কেন অধিকাংশের? খারাপ আবার কারো জন্যে আনন্দের হতে পারে নাকি? একটা উদাহরণ দিয়ে উত্তরটা দিই। ধরা যাক, ঘুষ খাওয়া। অধিকাংশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করে মানুষ ঘুষ নেয়। তাই জনজীবনে এ দুঃখ নিয়ে আসে। কিন্তু যারা ওটা নিচ্ছে, তাদের জন্যে এ তো মহা আনন্দের ব্যাপার। তাদের জন্য এ খারাপ হতে যাবে কেন? তাই সবার নয়, অধিকাংশের জন্যে যা দুঃখের তাকেই আমরা খারাপ বলি।
আমাদের দেশে ঘুষ খাওয়া লোকের সংখ্যা যে কত তা সত্যিই হাতে গুণে শেষ করা যাবে না। একবার এক সভায় আমাকে এক যুবক প্রশ্ন করেছিল : এ দেশে ঘুষ খাওয়া মানুষ এত কেন? এরা কী আগে থেকেই ছিল নাকি কোনো একটা সময় থেকে শুরু হয়েছে? আমি বললাম, একটা গল্প বললে ব্যাপারটা বুঝবে। গল্পটা ব্রিটিশ আমলের। এক তরুণ আইসিএস অফিসার, বয়স বাইশ-তেইশ, ইংল্যান্ড থেকে সবে এসেছেন এ দেশে চাকরি করতে। তখন এ দেশে চাকরি করতে হলে অফিসারদের বাংলা শিখতে হতো। না হলে বিচার বা প্রশাসন চালাবেন কেমন করে? তো, সেই আইসিএস অফিসারও কিছুটা বাংলা শিখেছেন। কিন্তু এখনো ঠিকমতো শেখা হয়নি। অনেক বাংলা শব্দই বুঝতে পারেন না। তো উনি একদিন অফিসে বসে কাজ করছেন, এমন সময় তাঁর চাপরাশি দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে ঢুকে বলল: স্যার, মিস্টার নাজির ইজ ইটিং ঘুষ। উনি বাংলা শিখেছেন কিন্তু 'ঘুষ' শব্দটার অর্থ তখনও শেখা হয়নি। তবে নাজির সাহেব সেটা খাচ্ছেন শুনে ধরে নিলেন ঘুষ জিনিসটা খাবার জাতেরই কিছু হবে। বললেন, হোয়ার ইজ ঘুষ? চাপরাশি বলল, কাম স্যার। বলে নাজিরের ঘরে তাঁকে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন, কেদারায় নাজির সাহেব বসে আছেন, পাশে সদ্যপ্রাপ্ত ঘুষ_ এককাঁদি পাকা কলা। সাহেব বললেন, হোয়ার ইজ ঘুষ? চাপরাশি কলার কাঁদি দেখিয়ে বলল, দিস ইজ ঘুষ স্যার। সাহেব এর মধ্যে বেশ কবার কলা খেয়েছেন। ভালোও লেগেছে খুব। ফলটার পুষ্টিগুণও তিনি জানেন। ফলে নাজিরের পাশে কলা দেখে তিনি আনন্দে নেচে উঠলেন। বললেন, ইজ দিস ঘুষ? দেন এভরিবডি মাস্ট ইট ঘুষ। ঘুষ ইজ ভেরি গুড ফর হেলথ। গল্প বলে বললাম_ নাজিরের ঘরে যখন সাহেব কথাগুলো বলছিলেন, তখন আমার ধারণা, চৌদ্দ কোটি বাঙালি ওই ঘরটার ভেতর দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনেছিল। না হলে এমন দরজা-জানালা ছাড়া ঘুষ বাঙালি শিখল কী করে? আর ওই যে বিদ্যাটা একবার বাঙালি শিখেছে, আর কখনো ভোলার চেষ্টা করেনি।
আগেই বলেছি, বিত্ত-সম্পদ মানুষের স্বপ্ন। কিন্তু এই বিত্তের সঙ্গে সব সময়ই জড়িয়ে আছে পাপ, অবৈধতা আর অন্যায়। এ ব্যাপারে বাইবেলে একটা অসাধারণ কথা আছে। বলা হয়েছে: একটি সুচের ছিদ্র দিয়ে একটা উটের এদিক থেকে ওদিকে যাওয়া যতটা সোজা, ঠিক ততটাই সোজা একজন বড়লোকের পক্ষে বেহেশতের দরজা দিয়ে প্রবেশ করা। কেন যিশু বলেছিলেন কথাটা? নিশ্চয়ই উনি টের পেয়েছিলেন, সম্পদ ওতপ্রোতভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এদের একটা থাকলে আরেকটার উপস্থিতি থাকবেই। তাই বলা যায়, পুণ্য থেকে পাপ আলাদা কিছু নয়। পুণ্যেরই ভেতরের জিনিস এটা। সোনার ভেতরকার খাদের মতো পুণ্যকে এটি খাঁটি করে রাখে। দূর নির্জন দ্বীপে যে মানুষ একা বাস করছে তার মধ্যে কিন্তু পাপ বা পাপবোধ নেই। কিন্তু যেখানেই অর্থ, যেখানেই সমাজ, যেখানেই ব্যক্তিগত সম্পদ, সেখানেই পাপ। পাপ সে অর্থে ব্যক্তিগত সম্পদের সমবয়সী। একটা উদাহরণ দিই। ধরো, ছোট্ট একটা বাচ্চা পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একটা চমৎকার রঙিন খেলনা দেখতে পেল। খেলনাটা তার ভালো লেগে যাওয়ায় হাতে করে সেটা সে নিয়ে এসেছে। (একটা ছাগল, ভেড়া বা গরু যেভাবে পরের বাগানে ঢুকে নিশ্চিন্ত নিষ্পাপ মনে ফুলগাছ খায় সেভাবে। কেন তারা অমন নির্বিকারে খেতে পারে? পারে এ জন্যে যে, ঐ বাগান যে অন্যের সম্পত্তি, ওতে তার হাত দেওয়া মানা, মানুষের সমাজের এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাটা তার মধ্যে নেই।) অবোধ শিশুটিরই তাই। কিন্তু আমরা ক িকরি তখন শিশুটিকে? দুই গালে দুই চড় মেরে চ্যাঁচাতে থাকি : 'চোর কোথাকার? না বলে অন্যের জিনিস নিয়ে এসেছিস! দিয়ে আয় যা, এক্ষুণি দিয়ে আয়।' একটা সরল শিশু তো নিষ্পাপ ফুলের মতো, সে তো জগতের স্বার্থ বা দ্বন্দ্বের কুটিল প্যাঁচঘোঁচ জানে না, অথচ আমরা তার ভেতর পাপ ঢুকিয়ে তাকে একজন অপরাধী বানিয়ে ফেললাম।
সমাজে ব্যক্তিগত সম্পদ যত বেড়েছে, সম্পদকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য মানুষ তত মুখিয়ে উঠেছে। এরই ফলে সমাজের সবাইকে একটা অলিখিত চুক্তিতে আসতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, আমরা সবাই সবার সম্পত্তি রক্ষা করব, কারও সম্পত্তির দিকে কোনোমতেই হাত বাড়াব না।
(চলবে)
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, খারাপ কী, উত্তরে বলা যাবে, সবার জন্যে না হলেও অধিকাংশের জন্যে যা দুঃখের তাই খারাপ। এখন প্রশ্ন, সবার জন্যে কেন নয়? কেন অধিকাংশের? খারাপ আবার কারো জন্যে আনন্দের হতে পারে নাকি? একটা উদাহরণ দিয়ে উত্তরটা দিই। ধরা যাক, ঘুষ খাওয়া। অধিকাংশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করে মানুষ ঘুষ নেয়। তাই জনজীবনে এ দুঃখ নিয়ে আসে। কিন্তু যারা ওটা নিচ্ছে, তাদের জন্যে এ তো মহা আনন্দের ব্যাপার। তাদের জন্য এ খারাপ হতে যাবে কেন? তাই সবার নয়, অধিকাংশের জন্যে যা দুঃখের তাকেই আমরা খারাপ বলি।
আমাদের দেশে ঘুষ খাওয়া লোকের সংখ্যা যে কত তা সত্যিই হাতে গুণে শেষ করা যাবে না। একবার এক সভায় আমাকে এক যুবক প্রশ্ন করেছিল : এ দেশে ঘুষ খাওয়া মানুষ এত কেন? এরা কী আগে থেকেই ছিল নাকি কোনো একটা সময় থেকে শুরু হয়েছে? আমি বললাম, একটা গল্প বললে ব্যাপারটা বুঝবে। গল্পটা ব্রিটিশ আমলের। এক তরুণ আইসিএস অফিসার, বয়স বাইশ-তেইশ, ইংল্যান্ড থেকে সবে এসেছেন এ দেশে চাকরি করতে। তখন এ দেশে চাকরি করতে হলে অফিসারদের বাংলা শিখতে হতো। না হলে বিচার বা প্রশাসন চালাবেন কেমন করে? তো, সেই আইসিএস অফিসারও কিছুটা বাংলা শিখেছেন। কিন্তু এখনো ঠিকমতো শেখা হয়নি। অনেক বাংলা শব্দই বুঝতে পারেন না। তো উনি একদিন অফিসে বসে কাজ করছেন, এমন সময় তাঁর চাপরাশি দৌড়াতে দৌড়াতে ঘরে ঢুকে বলল: স্যার, মিস্টার নাজির ইজ ইটিং ঘুষ। উনি বাংলা শিখেছেন কিন্তু 'ঘুষ' শব্দটার অর্থ তখনও শেখা হয়নি। তবে নাজির সাহেব সেটা খাচ্ছেন শুনে ধরে নিলেন ঘুষ জিনিসটা খাবার জাতেরই কিছু হবে। বললেন, হোয়ার ইজ ঘুষ? চাপরাশি বলল, কাম স্যার। বলে নাজিরের ঘরে তাঁকে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন, কেদারায় নাজির সাহেব বসে আছেন, পাশে সদ্যপ্রাপ্ত ঘুষ_ এককাঁদি পাকা কলা। সাহেব বললেন, হোয়ার ইজ ঘুষ? চাপরাশি কলার কাঁদি দেখিয়ে বলল, দিস ইজ ঘুষ স্যার। সাহেব এর মধ্যে বেশ কবার কলা খেয়েছেন। ভালোও লেগেছে খুব। ফলটার পুষ্টিগুণও তিনি জানেন। ফলে নাজিরের পাশে কলা দেখে তিনি আনন্দে নেচে উঠলেন। বললেন, ইজ দিস ঘুষ? দেন এভরিবডি মাস্ট ইট ঘুষ। ঘুষ ইজ ভেরি গুড ফর হেলথ। গল্প বলে বললাম_ নাজিরের ঘরে যখন সাহেব কথাগুলো বলছিলেন, তখন আমার ধারণা, চৌদ্দ কোটি বাঙালি ওই ঘরটার ভেতর দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনেছিল। না হলে এমন দরজা-জানালা ছাড়া ঘুষ বাঙালি শিখল কী করে? আর ওই যে বিদ্যাটা একবার বাঙালি শিখেছে, আর কখনো ভোলার চেষ্টা করেনি।
আগেই বলেছি, বিত্ত-সম্পদ মানুষের স্বপ্ন। কিন্তু এই বিত্তের সঙ্গে সব সময়ই জড়িয়ে আছে পাপ, অবৈধতা আর অন্যায়। এ ব্যাপারে বাইবেলে একটা অসাধারণ কথা আছে। বলা হয়েছে: একটি সুচের ছিদ্র দিয়ে একটা উটের এদিক থেকে ওদিকে যাওয়া যতটা সোজা, ঠিক ততটাই সোজা একজন বড়লোকের পক্ষে বেহেশতের দরজা দিয়ে প্রবেশ করা। কেন যিশু বলেছিলেন কথাটা? নিশ্চয়ই উনি টের পেয়েছিলেন, সম্পদ ওতপ্রোতভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এদের একটা থাকলে আরেকটার উপস্থিতি থাকবেই। তাই বলা যায়, পুণ্য থেকে পাপ আলাদা কিছু নয়। পুণ্যেরই ভেতরের জিনিস এটা। সোনার ভেতরকার খাদের মতো পুণ্যকে এটি খাঁটি করে রাখে। দূর নির্জন দ্বীপে যে মানুষ একা বাস করছে তার মধ্যে কিন্তু পাপ বা পাপবোধ নেই। কিন্তু যেখানেই অর্থ, যেখানেই সমাজ, যেখানেই ব্যক্তিগত সম্পদ, সেখানেই পাপ। পাপ সে অর্থে ব্যক্তিগত সম্পদের সমবয়সী। একটা উদাহরণ দিই। ধরো, ছোট্ট একটা বাচ্চা পাশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একটা চমৎকার রঙিন খেলনা দেখতে পেল। খেলনাটা তার ভালো লেগে যাওয়ায় হাতে করে সেটা সে নিয়ে এসেছে। (একটা ছাগল, ভেড়া বা গরু যেভাবে পরের বাগানে ঢুকে নিশ্চিন্ত নিষ্পাপ মনে ফুলগাছ খায় সেভাবে। কেন তারা অমন নির্বিকারে খেতে পারে? পারে এ জন্যে যে, ঐ বাগান যে অন্যের সম্পত্তি, ওতে তার হাত দেওয়া মানা, মানুষের সমাজের এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাটা তার মধ্যে নেই।) অবোধ শিশুটিরই তাই। কিন্তু আমরা ক িকরি তখন শিশুটিকে? দুই গালে দুই চড় মেরে চ্যাঁচাতে থাকি : 'চোর কোথাকার? না বলে অন্যের জিনিস নিয়ে এসেছিস! দিয়ে আয় যা, এক্ষুণি দিয়ে আয়।' একটা সরল শিশু তো নিষ্পাপ ফুলের মতো, সে তো জগতের স্বার্থ বা দ্বন্দ্বের কুটিল প্যাঁচঘোঁচ জানে না, অথচ আমরা তার ভেতর পাপ ঢুকিয়ে তাকে একজন অপরাধী বানিয়ে ফেললাম।
সমাজে ব্যক্তিগত সম্পদ যত বেড়েছে, সম্পদকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য মানুষ তত মুখিয়ে উঠেছে। এরই ফলে সমাজের সবাইকে একটা অলিখিত চুক্তিতে আসতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, আমরা সবাই সবার সম্পত্তি রক্ষা করব, কারও সম্পত্তির দিকে কোনোমতেই হাত বাড়াব না।
(চলবে)
No comments