সুনামির এক বছর-জাপানে এক নদীর পাগল হয়ে যাওয়া by মনজুরুল হক
নদী যেখানে সাগরে গিয়ে মেলে, মোহনার সেই দৃশ্য সাধারণত হয়ে থাকে মন ভোলানো আর প্রাণ কেড়ে নেওয়া। জাপানের মূল দ্বীপ হোনশুর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদী কিতাকামির বেলায়ও ঠিক তেমনটাই চোখে পড়ে। কিতাকামি নামের অর্থ হলো উত্তরের দেবতা।
নদীর এই নামকরণের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় উত্তরের বিভিন্ন জনপদের জন্য এর গুরুত্ব। উত্তর থেকে বয়ে আসা সেই নদী ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পথে ধাবিত হয়ে যেখানে মিশে গেছে সমুদ্রের বিশালতায়, মিয়াগি জেলার ইশিনোমাকি শহরের মনোরম সেই জায়গাটিও নদীর নামেই পরিচিত। শহরের এই কিতাকামি এলাকাটি এর মন কেড়ে নেওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য মাত্র কিছুদিন আগেও ওই অঞ্চলের অনেকের কাছেই ছিল প্রিয় এক আপন ভুবন এবং বাইরের লোকজনের কাছে ছিল কাঙ্ক্ষিত এক গন্তব্য। তবে গত বছরের ১১ মার্চ জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলের ওপর আঘাত হানা প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের পর এখন আর সে কথা বলার উপায় নেই। মানুষের মনে যে স্মৃতি এখন চিরস্থায়ী হয়ে গেঁথে গেছে তা হলো, প্রিয় এক নদীর হঠাৎ করেই উন্মাদ হয়ে যাওয়া এবং জলের দেবতার সেই খামখেয়ালি পাগলামির শিকার হয়ে প্রিয়জনদের পাশাপাশি আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা মানব বসতির চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাওয়া।
কিতাকামি নদীর মুখের দিকে, সমুদ্র থেকে অল্প দূরে একসময় দূর থেকে চোখে পড়ত ইশিনোমাকি নগর প্রশাসনের কিতাকামি শাখা কার্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ভবনটি, যার ঠিক পাশেই আছে মাধ্যমিক স্কুলের পুরোনো ভবন এবং এর থেকে অল্প দূরে ওকাওয়া প্রাইমারি স্কুল। নগর প্রশাসনের শাখা কার্যালয়ের সেই ভবনটি কংক্রিটের শক্ত গাঁথুনিতে তৈরি হওয়ায় একই সঙ্গে দুর্যোগকালে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও সেটা ছিল নির্ধারিত। কিতাকামির মোহনার চার হাজার জনবসতির মনোরম সেই জায়গাটির সঙ্গে মানানসই নগর প্রশাসন ভবন নিয়ে স্থানীয় লোকজন ছিলেন গর্বিত এবং কখনো ঘুণাক্ষরেও তাদের মনে দেখা দেয়নি সে রকম কোনো আশঙ্কা যে তাদের সেই গর্বের শহর প্রশাসন কার্যালয় হয়ে উঠতে পারে দুঃসহ এক স্মৃতির বেদনাকে জাগিয়ে তোলার মাইলফলক।
গত বছরের ১১ মার্চ বেলা দুইটা বেজে ৪৬ মিনিটে প্রচণ্ড ভূমিকম্প আঘাত হানলে ভবনের অংশবিশেষ ভেঙে পড়লেও মূল ভবনটি তখনো অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে ভূমিকম্পের ঠিক পর পর সুনামি সতর্কতা প্রচারিত হলেও ভবনে অবস্থানরত নগর প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেখান থেকে সরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। শুধু তাই নয়, আশপাশের বসতি ছেড়ে চলে আসা এলাকাবাসীদের কয়েকজনও কংক্রিটের দ্বিতল কাঠামোকে নিরাপদ ভেবে নিয়ে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে ভূমিকম্পের পর ভবনে অবস্থানরত লোকজনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫০ জনের মতো, যাঁরা সবাই জায়গাটিকে নিরাপদ ভেবে নিয়ে দুর্যোগ কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এর প্রায় ৩০ মিনিট পর যা ঘটে, তার সবটাই ছিল অবিশ্বাস্য, মানুষের কল্পনার শক্তিকে যা সহজেই হার মানায়।
সুনামির ঢেউয়ের আগমনের সঙ্গে নদী হয়ে ওঠে উতলা। যে নদীকে ভালোবেসে মানুষ এর তীর বরাবর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে নিয়েছিল তাদের বাড়িঘর, তাদের ভালোবাসার সেই নদী কোনো এক অজানা আক্রোশে প্রচণ্ড রাগে ফুলে ফেঁপে উঠে লন্ডভন্ড করে দেয় চারপাশের সবকিছু। নদীর সেই প্রচণ্ড ক্রোধের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এমনকি কংক্রিটের শক্ত কাঠামো আর পোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শহর প্রশাসনের দৃষ্টিনন্দন সেই ভবন ও আশপাশের কয়েকটি স্কুল। ফলে নিরাপদ ভেবে নিয়ে নগর প্রশাসন ভবনে অবস্থানরত ৫০ জনের প্রায় অর্ধেক চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান প্রকৃতির সেদিনের সেই প্রচণ্ড ক্রোধের শিকার হয়ে। আর দুটি স্কুল ভবনের মধ্যে যে ওকাওয়া প্রাইমারি স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে ছিল মুখরিত, সেখানে হারিয়ে যায় ৭৮টি কিশোর প্রাণ এবং সেই সঙ্গে স্কুলের আটজন শিক্ষকের মধ্যে সাতজন। বেদনার সেই স্মৃতি নিয়ে দুর্যোগ আঘাত হানার এক বছর পর এখনো দাঁড়িয়ে আছে স্কুল আর শহর প্রশাসনের ভেঙে পড়া সেসব ভবন, সুনামির আঘাত কতটা শক্তিশালী ছিল, যা আঁচ করতে পারার ইঙ্গিত যেসব কাঠামো এখন দিচ্ছে।
কিতাকামির মোহনার চার হাজার জনবসতিকে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাকে খাটো করে দেখার চরম মূল্য সেদিন দিতে হয়। চার হাজার জনবসতির ৭০০ জন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নিহত কিংবা নিখোঁজের তালিকায়। আর আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রায় পুরো জনপদ, যাদের অনেককেই এখনো কাটাতে হচ্ছে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের অনিশ্চিত জীবন। নদীর তীর বরাবর এক বছর আগেও যেখানে ছিল সমৃদ্ধ জনপদ, এর সবটাই এখন পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত ভূমিতে, যে জায়গা দিয়ে হেঁটে গেলে বাড়ির ভিত ছাড়া আর কিছুই এখন আর চোখে পড়ে না। হঠাৎ করেই কখনো হয়তো বা দেখা যায় কোথাও দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে নীরব প্রার্থনায় মগ্ন একটি পরিবার। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, একসময় সেই জায়গায় তারা গড়ে নিয়েছিল সুখের সংসার, ভূমিকম্পের প্রচণ্ড আলোড়নে পাগল হয়ে যাওয়া এক নদী মুহূর্তের থাবায় কেড়ে নিয়ে গেছে যার সবকিছু, হয়তো বা কয়েকটি প্রাণসহ।
জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামির বর্ষপূর্তির ঠিক আগে কিতাকামির সেই জনপদে পদচারণ ছিল যেন দুঃখজাগানিয়া এক স্মৃতির রোমন্থন। তবে এর সবটাই যে বেদনায় ভরা তা তো নয়। বেদনার মধ্যেও মানুষ খুঁজে ফিরছে আশার আলো এবং তা পেয়েও যাচ্ছে। সে কথাই বলছিলেন আমাদের রাত্রিকালীন যাত্রাবিরতির স্থান ওইকাওয়া উষ্ণ প্রস্রবন পান্থশালার মালিক সোইচি ইয়োকোইয়ামা এবং তাঁর স্থপতি বন্ধু ও গায়ক-গীতিকার শুজি শিবুইয়া।
পান্থশালাটি নদী থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ি ঢালের ওপর অবস্থিত হওয়ায় সুনামির আঘাত সেটা পুরপুরি এড়িয়ে যেতে পেরেছে। তবে জনপদের অধিকাংশ মানুষ সেদিন মুহূর্তের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ায় পান্থশালার মালিক তাঁর সেই অবকাশকেন্দ্রের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এলাকাবাসীর জন্য। দুর্যোগ আঘাত হানার শুরুর দিনগুলোয় বিদ্যুৎ না থাকায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যে সবাই মিলে সেখানে কাটিয়েছেন অনিশ্চিত সময়। তবে মানুষের সহানুভূতি আর সহযোগিতা থেকে তারা হননি বঞ্চিত। পান্থশালায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের অসহায় সে রকম দিন যাপনের কথা শুনে এমনকি অনেক দূরের পথ পার হয়েও অনেকেই নিয়মিতভাবে তাদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন খাদ্য, গরম কাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী। আর গায়ক শিবুইয়া প্রতিদিন সেখানে তাদের গেয়ে শুনিয়েছেন তাঁর প্রাণের জনপদ কিতাকামিকে নিয়ে লেখা নিজের সব গান। গানগুলো তিনি লিখেছিলেন দুর্যোগ আঘাত হানার অনেক আগে এবং এর আগে কখনোই বুঝতে পারেননি যে নিজের সেই প্রাণ কেড়ে নেওয়া সৌন্দর্যের শান্ত জনপদের জন্য মনের আকুতিতে ভরা সেসব গান একদিন চোখের জলে ভাসিয়ে দেবে সেই একই জনপদের মানুষকে। প্রতি রাতে গান শেষ করার পর তাঁর মনে হয়েছে, দুঃখী সেসব মানুষকে আরও বেশি দুঃখে ভাসিয়ে দিয়ে মস্ত অন্যায় তিনি করছেন এবং তিনি আর গান গাইবেন না। তবে তার পরও সেসব দুঃখী মানুষের হূদয় থেকে আসা অনুরোধ রক্ষা না করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং আবারও গিটার হাতে নিয়ে তিনি গেয়েছেন তাঁর সেই প্রাণপ্রিয় জনপদের জন্য মনে দেখা দেওয়া আকুতির গান, যেখানে একসময় নিজেও তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের ভুবন, যার ভিতটাই কেবল এখন আছে দাঁড়িয়ে।
ইয়োকোইয়ামা জনপদের বাস্তুহারা হয়ে পড়া মানুষের জন্য পান্থশালার দুয়ার অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খোলা রেখেছিলেন। ওই সময়ের পর সবাই বিদায় নিলে পান্থশালা আবারও ফিরে যায় আগের পরিচিত ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে। তবে দুঃখজাগানিয়া সময়ে ইয়োকোইয়ামা আর শিবুইয়ার বন্ধুত্বে নতুন যে মাত্রা যুক্ত হয়, তা এখনো অব্যাহত আছে। প্রতি সপ্তাহে শিবুইয়া নিয়মিতভাবে উপস্থিত হন বন্ধুর পান্থশালায় এবং অতিথিদের অনুরোধে গেয়ে শোনান সুনামির জলে ভেসে যাওয়া তাঁর ভালোবাসার জনপদের জন্য মনের আকুতিতে ভরা সব গান।
যে রাতে ইয়োকোইয়ামার পান্থশালায় আমরা ছিলাম অতিথি, সেই রাতেও তিনি সেখানে ছিলেন উপস্থিত। প্রাতরাশের পর বন্ধুকে নিয়ে তিনি মঞ্চে এসে উপস্থিত হন এবং গিটারের বাজনার তালে গাইতে শুরু করেন মনের সব রকম আবেগ ঢেলে দেওয়া নিজের লেখা অপূর্ব সেসব গান। একসময় আমরা লক্ষ করি, তাঁর চোখ দিয়ে নামছে জলের ধারা, যেন বা কিতাকামির পাগল হয়ে যাওয়া সেই জলেরই প্রতিফলন সেখানে। আমাদের চোখও অজান্তেই ভিজে যায় অশ্রুতে।
(কিতাকামি থেকে ফিরে, ৮ মার্চ ২০১২)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
কিতাকামি নদীর মুখের দিকে, সমুদ্র থেকে অল্প দূরে একসময় দূর থেকে চোখে পড়ত ইশিনোমাকি নগর প্রশাসনের কিতাকামি শাখা কার্যালয়ের দৃষ্টিনন্দন ভবনটি, যার ঠিক পাশেই আছে মাধ্যমিক স্কুলের পুরোনো ভবন এবং এর থেকে অল্প দূরে ওকাওয়া প্রাইমারি স্কুল। নগর প্রশাসনের শাখা কার্যালয়ের সেই ভবনটি কংক্রিটের শক্ত গাঁথুনিতে তৈরি হওয়ায় একই সঙ্গে দুর্যোগকালে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও সেটা ছিল নির্ধারিত। কিতাকামির মোহনার চার হাজার জনবসতির মনোরম সেই জায়গাটির সঙ্গে মানানসই নগর প্রশাসন ভবন নিয়ে স্থানীয় লোকজন ছিলেন গর্বিত এবং কখনো ঘুণাক্ষরেও তাদের মনে দেখা দেয়নি সে রকম কোনো আশঙ্কা যে তাদের সেই গর্বের শহর প্রশাসন কার্যালয় হয়ে উঠতে পারে দুঃসহ এক স্মৃতির বেদনাকে জাগিয়ে তোলার মাইলফলক।
গত বছরের ১১ মার্চ বেলা দুইটা বেজে ৪৬ মিনিটে প্রচণ্ড ভূমিকম্প আঘাত হানলে ভবনের অংশবিশেষ ভেঙে পড়লেও মূল ভবনটি তখনো অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফলে ভূমিকম্পের ঠিক পর পর সুনামি সতর্কতা প্রচারিত হলেও ভবনে অবস্থানরত নগর প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেখান থেকে সরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। শুধু তাই নয়, আশপাশের বসতি ছেড়ে চলে আসা এলাকাবাসীদের কয়েকজনও কংক্রিটের দ্বিতল কাঠামোকে নিরাপদ ভেবে নিয়ে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে ভূমিকম্পের পর ভবনে অবস্থানরত লোকজনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫০ জনের মতো, যাঁরা সবাই জায়গাটিকে নিরাপদ ভেবে নিয়ে দুর্যোগ কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এর প্রায় ৩০ মিনিট পর যা ঘটে, তার সবটাই ছিল অবিশ্বাস্য, মানুষের কল্পনার শক্তিকে যা সহজেই হার মানায়।
সুনামির ঢেউয়ের আগমনের সঙ্গে নদী হয়ে ওঠে উতলা। যে নদীকে ভালোবেসে মানুষ এর তীর বরাবর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে নিয়েছিল তাদের বাড়িঘর, তাদের ভালোবাসার সেই নদী কোনো এক অজানা আক্রোশে প্রচণ্ড রাগে ফুলে ফেঁপে উঠে লন্ডভন্ড করে দেয় চারপাশের সবকিছু। নদীর সেই প্রচণ্ড ক্রোধের হাত থেকে রক্ষা পায়নি এমনকি কংক্রিটের শক্ত কাঠামো আর পোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শহর প্রশাসনের দৃষ্টিনন্দন সেই ভবন ও আশপাশের কয়েকটি স্কুল। ফলে নিরাপদ ভেবে নিয়ে নগর প্রশাসন ভবনে অবস্থানরত ৫০ জনের প্রায় অর্ধেক চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান প্রকৃতির সেদিনের সেই প্রচণ্ড ক্রোধের শিকার হয়ে। আর দুটি স্কুল ভবনের মধ্যে যে ওকাওয়া প্রাইমারি স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে ছিল মুখরিত, সেখানে হারিয়ে যায় ৭৮টি কিশোর প্রাণ এবং সেই সঙ্গে স্কুলের আটজন শিক্ষকের মধ্যে সাতজন। বেদনার সেই স্মৃতি নিয়ে দুর্যোগ আঘাত হানার এক বছর পর এখনো দাঁড়িয়ে আছে স্কুল আর শহর প্রশাসনের ভেঙে পড়া সেসব ভবন, সুনামির আঘাত কতটা শক্তিশালী ছিল, যা আঁচ করতে পারার ইঙ্গিত যেসব কাঠামো এখন দিচ্ছে।
কিতাকামির মোহনার চার হাজার জনবসতিকে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনাকে খাটো করে দেখার চরম মূল্য সেদিন দিতে হয়। চার হাজার জনবসতির ৭০০ জন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নিহত কিংবা নিখোঁজের তালিকায়। আর আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রায় পুরো জনপদ, যাদের অনেককেই এখনো কাটাতে হচ্ছে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের অনিশ্চিত জীবন। নদীর তীর বরাবর এক বছর আগেও যেখানে ছিল সমৃদ্ধ জনপদ, এর সবটাই এখন পরিণত হয়েছে পরিত্যক্ত ভূমিতে, যে জায়গা দিয়ে হেঁটে গেলে বাড়ির ভিত ছাড়া আর কিছুই এখন আর চোখে পড়ে না। হঠাৎ করেই কখনো হয়তো বা দেখা যায় কোথাও দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে নীরব প্রার্থনায় মগ্ন একটি পরিবার। বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, একসময় সেই জায়গায় তারা গড়ে নিয়েছিল সুখের সংসার, ভূমিকম্পের প্রচণ্ড আলোড়নে পাগল হয়ে যাওয়া এক নদী মুহূর্তের থাবায় কেড়ে নিয়ে গেছে যার সবকিছু, হয়তো বা কয়েকটি প্রাণসহ।
জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামির বর্ষপূর্তির ঠিক আগে কিতাকামির সেই জনপদে পদচারণ ছিল যেন দুঃখজাগানিয়া এক স্মৃতির রোমন্থন। তবে এর সবটাই যে বেদনায় ভরা তা তো নয়। বেদনার মধ্যেও মানুষ খুঁজে ফিরছে আশার আলো এবং তা পেয়েও যাচ্ছে। সে কথাই বলছিলেন আমাদের রাত্রিকালীন যাত্রাবিরতির স্থান ওইকাওয়া উষ্ণ প্রস্রবন পান্থশালার মালিক সোইচি ইয়োকোইয়ামা এবং তাঁর স্থপতি বন্ধু ও গায়ক-গীতিকার শুজি শিবুইয়া।
পান্থশালাটি নদী থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ি ঢালের ওপর অবস্থিত হওয়ায় সুনামির আঘাত সেটা পুরপুরি এড়িয়ে যেতে পেরেছে। তবে জনপদের অধিকাংশ মানুষ সেদিন মুহূর্তের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ায় পান্থশালার মালিক তাঁর সেই অবকাশকেন্দ্রের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এলাকাবাসীর জন্য। দুর্যোগ আঘাত হানার শুরুর দিনগুলোয় বিদ্যুৎ না থাকায় প্রচণ্ড শীতের মধ্যে সবাই মিলে সেখানে কাটিয়েছেন অনিশ্চিত সময়। তবে মানুষের সহানুভূতি আর সহযোগিতা থেকে তারা হননি বঞ্চিত। পান্থশালায় আশ্রয় গ্রহণকারীদের অসহায় সে রকম দিন যাপনের কথা শুনে এমনকি অনেক দূরের পথ পার হয়েও অনেকেই নিয়মিতভাবে তাদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন খাদ্য, গরম কাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী। আর গায়ক শিবুইয়া প্রতিদিন সেখানে তাদের গেয়ে শুনিয়েছেন তাঁর প্রাণের জনপদ কিতাকামিকে নিয়ে লেখা নিজের সব গান। গানগুলো তিনি লিখেছিলেন দুর্যোগ আঘাত হানার অনেক আগে এবং এর আগে কখনোই বুঝতে পারেননি যে নিজের সেই প্রাণ কেড়ে নেওয়া সৌন্দর্যের শান্ত জনপদের জন্য মনের আকুতিতে ভরা সেসব গান একদিন চোখের জলে ভাসিয়ে দেবে সেই একই জনপদের মানুষকে। প্রতি রাতে গান শেষ করার পর তাঁর মনে হয়েছে, দুঃখী সেসব মানুষকে আরও বেশি দুঃখে ভাসিয়ে দিয়ে মস্ত অন্যায় তিনি করছেন এবং তিনি আর গান গাইবেন না। তবে তার পরও সেসব দুঃখী মানুষের হূদয় থেকে আসা অনুরোধ রক্ষা না করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং আবারও গিটার হাতে নিয়ে তিনি গেয়েছেন তাঁর সেই প্রাণপ্রিয় জনপদের জন্য মনে দেখা দেওয়া আকুতির গান, যেখানে একসময় নিজেও তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের ভুবন, যার ভিতটাই কেবল এখন আছে দাঁড়িয়ে।
ইয়োকোইয়ামা জনপদের বাস্তুহারা হয়ে পড়া মানুষের জন্য পান্থশালার দুয়ার অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খোলা রেখেছিলেন। ওই সময়ের পর সবাই বিদায় নিলে পান্থশালা আবারও ফিরে যায় আগের পরিচিত ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে। তবে দুঃখজাগানিয়া সময়ে ইয়োকোইয়ামা আর শিবুইয়ার বন্ধুত্বে নতুন যে মাত্রা যুক্ত হয়, তা এখনো অব্যাহত আছে। প্রতি সপ্তাহে শিবুইয়া নিয়মিতভাবে উপস্থিত হন বন্ধুর পান্থশালায় এবং অতিথিদের অনুরোধে গেয়ে শোনান সুনামির জলে ভেসে যাওয়া তাঁর ভালোবাসার জনপদের জন্য মনের আকুতিতে ভরা সব গান।
যে রাতে ইয়োকোইয়ামার পান্থশালায় আমরা ছিলাম অতিথি, সেই রাতেও তিনি সেখানে ছিলেন উপস্থিত। প্রাতরাশের পর বন্ধুকে নিয়ে তিনি মঞ্চে এসে উপস্থিত হন এবং গিটারের বাজনার তালে গাইতে শুরু করেন মনের সব রকম আবেগ ঢেলে দেওয়া নিজের লেখা অপূর্ব সেসব গান। একসময় আমরা লক্ষ করি, তাঁর চোখ দিয়ে নামছে জলের ধারা, যেন বা কিতাকামির পাগল হয়ে যাওয়া সেই জলেরই প্রতিফলন সেখানে। আমাদের চোখও অজান্তেই ভিজে যায় অশ্রুতে।
(কিতাকামি থেকে ফিরে, ৮ মার্চ ২০১২)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।
No comments