বিনিয়োগে স্থবিরতা by প্রকৌশলী এসএম ফজলে আলী
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে তিন যুগ পেরিয়ে গেল। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দেশটি এরই মধ্যে একটি মধ্যম মানের দেশে উন্নীত হওয়ার কথা। এই দেশটির মতো এরকম একটি সুসংহত দেশ বিশ্বে কমই আছ। এক ভাষা, এক জাতি। তার ওপর প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস, কয়লা, উর্বর জমি, অফুরন্ত পানি, মত্স্য, বনভূমি ইত্যাদিতে পূর্ণ।
সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের শ্রমবাজার অতি সস্তা। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অফুরন্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিনিয়োগ এক যুগ আগে যা ছিল, এখন তার চেয়ে অনেক কমে গেছে। বিশেষ করে ফখরুদ্দীন ও মইনউদ্দিন আহমেদের অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাদের ভ্রান্ত নীতির ফলে দেশি বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশি বিনিয়োগ তখনই আসে যখন দেশে দেশি বিনিয়োগ স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু ফখরুদ্দীনরা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের দুর্নীতির নামে ঢালাওভাবে যে হেনস্থা করেছে, তার ফলে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বিনিয়োগে উদ্যোগ হারিয়ে ফেলে।
এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে মহামন্দা শুরু হয়ে যায়। এতে শিল্পপতিরা আরও ভীত হয়ে পড়েন। তাদের বিনিয়োগ মার খেতে পারে, এ ভয়ে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। তাদের সরকার আশ্বস্ত করতে পারেননি যে তাদের বিনিয়োগে সফলতা আসবে। আমার দেশ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখি, ‘মহামন্দা কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে?’ এটা মে ২০০৮ (১৩.৫.২০০৮) প্রকাশিত হয়। তাতে বলেছিলাম, এই মহামন্দা বাংলাদেশের ওপর তেমন প্রভাব ফেলবে না। কারণ আমাদের ব্যাংক ও রিয়াল এস্টেটে কোনো ফটকাবাজারি ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই মহামন্দার মূল কারণ ছিল ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঋণ দিয়েছে, রিয়েল এস্টেটগুলো তাই করেছে। তারা বাছ-বিচার না করে দেদার দালান-কোঠার ফটকাবাজারি ব্যবসা করে। ক্রেতার কাছ থেকে টাকা তুলতে পারবে কিনা, তার বিধি-বিধান মজবুত ছিল না। আর ব্যাংকের নির্বাহীরা অস্বাভাবিক বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এর কোনোটাই আমাদের অর্থনীতিতে ছিল না। ফলে ওই মহামন্দা আমাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং এটা আমাদের জন্য শাপে বর হয়েছিল। মহামন্দার সময় সব খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যসহ ক্যাপিটাল মেশিনারিজের মূল্য অর্ধেকের নিচে নেমে যায়। এতে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য কমে যায়। তবে যে হারে কমার কথা ছিল সেভাবে কমেনি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের চক্রান্তে। তবে ওই প্রবন্ধে আমার মূল পরামর্শ ছিল শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের প্রতি। তাদের বলেছিলাম, সস্তার সুযোগ নিয়ে অত্যাধুনিক মেশিনারিজ অল্প মূল্যে ক্রয় করার এখনই সময়। কারণ মেশিনারিজ ক্রয় করে স্থাপন করে উত্পাদনে যেতে অন্তত দু’বছর লাগবে। আর এ মহামন্দা আরও দু’বছর স্থায়ী হবে না। এখন আর সেই প্রথম মহাযুদ্ধ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের মহামন্দার মতো দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ নেই। তখন রাষ্ট্রগুলো যার যার মতো এককভাবে মহামন্দা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করত। কিন্তু আজ এই ওঞঈ (Information Technology Commerce)-এর যুগে সারা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিকারে নেমেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এর নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন এবং তার ফলও এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব মহামন্দা এখন কেটে যাওয়ার পথে। আমি যেভাবে চিন্তা করছি, সরকারেরও ওই লাইনে চিন্তা করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে আমাদের অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব দেশের অর্থনীতির হালচাল না বিবেচনা করে তিনি মহামন্দায় আরও ঘাবড়িয়ে গেছেন। তাই শিল্পপতিদেরও কোনো সুপরামর্শ দিতে পারেননি। দেশকে শিল্পায়িত করার একটা বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করলেন। স্থানীয় শিল্পপতিদের শিল্পে বিনিয়োগে উত্সাহিত করতে পারলে এ সময় প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগও আসত।
উন্নত দেশের শিল্পপতিরা স্থানীয় উদ্যোক্তা পেলে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে আসতেন। কারণ ওইসব দেশে মহামন্দায় তারা শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার সাহস করেননি। আমাদের শ্রমবাজার অতি সস্তা। বিদেশিদের বিনিয়োগের এটাও একটা কারণ। কিন্তু তা কার্যকরি করার জন্য সরকারের উদ্যোগ এখনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
বিনিয়োগের জন্য কতগুলো মৌলিক জিনিসের প্রয়োজন। শিল্পের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি, যোগাযোগ ও পরিবেশবান্ধব (আইন-শৃঙ্খলা, শ্রমিক অসন্তোষহীন) অবস্থার প্রয়োজন।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুত্ সরবরাহের যে নাজেহাল অবস্থা তাতে চালু শিল্পগুলোর উত্পাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। বর্তমানে বিদ্যুতের প্রয়োজন প্রায় ৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। যেখানে উত্পাদন হচ্ছে মাত্র ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং চলছে দেশজুড়ে। এরই মধ্যে অনেক শিল্প-কারখানা জ্বালানির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুত্ উত্পাদনের কাঁচামাল হলো গ্যাস। যে গ্যাস প্রয়োজনমত সরবরাহ না করতে পারায় প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ কম উত্পাদন হচ্ছে। বিগত সরকারগুলো কেউই জ্বালানি সেক্টরের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ায় আজ এ বেহাল অবস্থা। দেশে তেল-গ্যাস ও কয়লার যে অভাব আছে তা নয়। কিন্তু বিগত ৩ যুগ যাবত পরিকল্পিতভাবে উত্তোলনের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পরিণতিতে দেশীয় কোনো ভালো কোম্পানি গড়ে ওঠেনি। পেট্রোবাংলাকে শুধু বিতরণেই ব্যস্ত রাখা হয়েছে। তাদের তেল-গ্যাস কোম্পানি হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ কোনো সরকারই করে দেয়নি।
বাপেক্স বলে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে তাকেও স্থবির করে রাখা হয়েছে। আর বিদেশি যে দু’চারটি কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়েছে তাতে ব্যক্তিগত বখরা খাওয়ার জন্য জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। পরিণতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের এই নাজেহাল অবস্থা। মাটির তলায় যে কয়লা আছে তা ভারত-চীনের কয়লার চেয়ে অনেক উন্নত মানের এবং শুধু এই কয়লা দ্বারাই দেশের জ্বালানির চাহিদা ৫০ বছর মেটানো সম্ভব। কিন্তু এত বছরেও তা উত্তোলন করার কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। কয়লা তুলতে সুড়ঙ্গ না খোলা পদ্ধতি হবে, তা নিয়ে চলছে রাজনীতি। অথচ জাতীয় স্বার্থে এনিয়ে রাজনীতির কোনো সুযোগ নেই। দেশের স্বার্থে নিষ্ঠার সঙ্গে চিন্তা ও কাজ করলে কোনো সমস্যা স্থায়ী হওয়ার কথা নয়। একটা কথা আছে, পাগলও তার ভালোটা বোঝে। এ দেশের মানুষ এমন আহম্মক নয় যে তারা তাদের ও দেশের স্বার্থ বোঝে না। দেশের স্বার্থে তারা ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত। কিন্তু বিষয়টি তাদের কাছে সততার সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ তারা প্রতিরোধ করবেই। টেকনিক্যালি যেখানে সুড়ঙ্গপথে কয়লা তোলা সম্ভব, সেখানে তাই করতে হবে। আর যেখানে উন্মুক্ত অবস্থায় তুলতে হবে সেখানে তাই করতে দিতে হবে। চীন-ভারত কয়লার ওপর নির্ভর করে তাদের শিল্পের বিকাশ সমানে ঘটিয়ে যাচ্ছে।
বিনিয়োগের পূর্বশর্ত হলো রাষ্ট্রে আইন-শৃঙ্খলার সুন্দর ও স্বাভাবিক পরিবেশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমরা কি সেই পরিবেশ দেখেছি? রাস্তা-ঘাটে মিছিল-মিটিং, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের পুলিশ বাহিনীকে সরকারদলীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। তারা দলের মাস্তান, সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজ, ভূমি দখলকারীদের প্রতিহত করে না। তাদের ব্যবহার করা হয় বিরোধী দলকে দমন করার জন্য। পরিণতিতে সমাজে সংঘাত লেগেই থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগ বা স্থানীয় বিনিয়োগ কীভাবে আশা করা যায়? এদেশে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক আজও ন্যায়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ মালিকই শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা সময়মত দেয় না। ফলে শ্রমিকরা থাকে অশান্ত। আর সেই সুযোগ স্বার্থান্বেষী মহল কাজে লাগিয়ে কল-কারখানায় হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগও করে থাকে। এতে মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। আমাদের গড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার জন্য আন্তর্জাতিক চক্র ও প্রতিবেশী একটি বৃহত্ রাষ্ট্রও দায়ী। তারা আমাদের বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বহুদিন থেকেই করে আসছে। তারা চায় আমাদের গার্মেন্ট শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য, যাতে তারা আন্তর্জাতিক বাজার একচেটিয়াভাবে দখল করতে পারে। বিগত কয়েকটি ঘটনায় ভারতীয় চর ধরা পড়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার তা চেপে গেছে তাদের অতিরিক্ত ভারতপ্রীতির জন্য। শিল্প খাত থেকে এসব নৈরাজ্য দূর না করতে পারলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কোনোটাই হবে না। আর বিনিয়োগ ছাড়া দেশের উন্নয়নেরও সম্ভাবনা নেই।
বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হলে দ্রুত গ্যাস-বিদ্যুতের উত্পাদন বাড়াতে হবে। সরকারি পর্যায়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুত্ ও কয়লা উত্তোলনের পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। যারা দ্রুত বিদ্যুত্ উত্পাদন করে জাতীয় গ্রিডে দিতে পারবে তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার সরকারের অঙ্গীকার থাকা দরকার। বিদেশি কোম্পানি থেকে টুপাইস কামানোর ধান্ধা বাদ দিয়ে জাতীয় স্বার্থে দ্রুত কয়লা ও গ্যাস উত্তোলনের ক্রাশ প্রোগ্রাম নিতে হবে। সমুদ্রে আমাদের তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল। কিন্তু সেই সুযোগও সরকারগুলোর অদক্ষতার জন্য ভারত ও মিয়ানমারের দখলে চলে যাচ্ছে। শক্ত ও সঠিক পররাষ্ট্রনীতির অভাবেই আজকের এ হাল। এ ব্যাপারে হালে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ। তার নিষ্পত্তি যাতে দ্রুত হয় তার যথাযথ ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে। জাতীয় সম্পদের হেফাজত করা সরকারেরই কাজ। আমাদের মতো একটি দেশের উন্নতি যেখানে দ্রুত হওয়ার কথা ছিল, আজ তা অনেক পিছিয়ে আছে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক ব্যর্থতা। এখানে চলছে ব্লেম-গেম। বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তাদের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে যে বেতার ভাষণ ৬ জানুয়ারি দিয়েছেন, তার বেশি সময় জুড়ে ছিল বিএনপি সরকারের কুত্সা রটনা। যে কোনো সুস্থ রাজনীতিতে বিরোধী দলেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, এটা সর্বজনস্বীকৃত। তাই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উভয়ের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমাধান করতে হবে। নতুন সরকার আসবে আর সবকিছু নতুনভাবে শুরু করবে, তাতে দেশ পিছিয়েই যাবে। বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে তাই। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে জাতিকে।
No comments