দু’শ’ কোটি টাকার রাজস্ব আর এক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান by কাজী জহিরুল ইসলাম


থেমে থেমে তুষারপাত হচ্ছে। মেঘলা আকাশ। ঠক করে একটি শব্দ হলো। কিছু একটা পড়ল ওক কাঠের ফ্লোরে। এই ক’দিনে আমরা এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছি। আমাদের মেইল এসেছে। ব্রিটিশ রয়েল মেইল সার্ভিসের ডাক হরকরা তুষারের তাণ্ডব উপেক্ষা করে বাড়ি বাড়ি মেইল বিলি করে চলেছে।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি। সাদা খামটি খুলি। টিভি লাইসেন্সিং থেকে চিঠি এসেছে। এটি কোনো সরকারি বিভাগ নয়। সরকারের ঠিকাদার, একটি বেসরকারি কোম্পানি। চিঠিটি আদ্যপান্ত পড়লাম। মোলায়েম ভাষা যেমন আছে, আবার আইনের ধমকও আছে। কারও টিভি লাইসেন্স না থাকলে বা সময়মত টিভি লাইসেন্স নবায়ন না করলে জেল-জরিমানার বিধানের উল্লেখ করা আছে বেশ কায়দা করে। এক জায়গায় বেশ বড় হরফে বোল্ড করে লেখা আছে—‘আপনি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু আমরা ভুলব না।’

ইংল্যান্ডে টিভি লাইসেন্স করার নিয়মটা হলো প্রতি হাউসহোল্ডের জন্য একটি করে লাইসেন্স নিতে হয়। বাসায় টিভি যে কয়টাই থাকুক না কেন, লাইসেন্স একটি থাকলেই চলবে। কারো বাসায় টিভি আছে কিন্তু লাইসেন্স নেই—এমন ঘটনা ঘটলে তাকে ৫ হাজার পাউন্ড (ছয় লাখ টাকা) পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রয়েছে। বার্ষিক লাইসেন্স ফিসটাও উল্লেখ করার মতো। কারো বাসায় রঙিন টিভি থাকলে তাকে দিতে হবে ১৪২.৫০ পাউন্ড অর্থাত্ ১৭ হাজার টাকা। আমি বিস্মিত এ কারণে, আমরা যে কালই এ বাড়িতে উঠেছি, তা ওরা টের পেল কী করে? ওরা গাড়ি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চক্কর দেয় নাকি? আসলে তার কোনো প্রয়োজন নেই। ইংল্যান্ডে এমন একটি হাউসহোল্ডও নেই, যা সরকারি ডাটাবেইজে নেই। টিভি লাইসেন্সিং এক অদ্ভুত সুন্দর নিয়ম করে রেখেছে। কেউ যদি বাসা বদল করে তাহলে তাকে নির্ধারিত ফরমে জানাতে হয়, যাতে তার নতুন বাসার ঠিকানায় লাইসেন্স আপডেট করা হয়। আর কেউ যদি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যায়, তাহলে হিসাব করে তার বাড়তি টাকাটা ওরা ফেরত দিয়ে দেয়। সুতরাং সবাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তথ্যটি জানিয়ে দেয়। এই বাসাটি যে খালি হয়েছে, তা তো ওরাই জানে। পুরো বিষয়টি অনলাইনে ওদের ওয়েবসাইটে গিয়েই করা যায়। এখানে লাইসেন্স চেক করতে কোনো পরিদর্শক আসেন না। আর লাইসেন্স মানে ছাপানো রঙিন একটি সার্টিফিকেটও নয়। কেউ চাইলে তাকে প্রিন্ট আউট পাঠানো হয়, তবে অধিকাংশ গ্রাহকই শুধু ই-মেইলে একটি লাইসেন্স নম্বর পান। ডিজিটাল ইংল্যান্ড যাকে বলে!
ভাবছি বাংলাদেশের টিভি লাইসেন্সিংটা যদি এ রকম আউটসোর্সিং করা যায়, তাহলে বছরে সরকার কম কর হলেও দু’শ’ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে পারে। দেশের মোট টিভিদর্শকের সংখ্যা ৪ কোটির ওপর। টিভি আছে এক কোটি পরিবারের। গড়ে যদি প্রতি পরিবার ৫শ’ টাকা করে ফি দেয় তাহলে আসবে ৫শ’ কোটি টাকা। এই টাকা থেকে লজিস্টিক ব্যয় যদি তিনশ’ কোটি ধরি, তাহলে নেট রাজস্ব আসবে দু’শ’ কোটি টাকা। সাদাকালো, রঙিন এবং এলসিডি টিভির জন্য ভিন্ন ভিন্ন হার নির্ধারণ করা হবে। মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে এক রেট আবার এর বাইরে ভিন্ন রেট, এ রকমও করা যায়। শহরের ভেতরেও জোন ভাগ করে বিভিন্ন রেট করা যায়। যেমন গুলশান, ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার রেট বেশি হতে পারে। এমন একটি কোম্পানিকে কাজটা দিতে হবে, যারা ক্রমান্বয়ে সারাদেশের হাউসহোল্ডের একটি ডাটাবেজ তৈরি করার দক্ষতা রাখে। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগটি যেমন সাহায্য করবে, অন্যদিকে সরকারের কোষাগারে একটি ভালো অংকের রাজস্বও জমা হবে। লজিস্টিক ব্যয়টি কারও কাছে খুব বেশি মনে হতে পারে। লজিস্টিক ব্যয় আসলে ঠিকাদারের কমিশন প্যাকেজের মধ্যেই চলে যাবে। প্রথম দুই বছর ঠিকাদার কোম্পানিকে কমিশন বেশি দিতে হবে। কারণ ওরা ডাটাবেজ তৈরি করবে, কম্পিউটার প্রোগ্রাম বানাবে, বিভিন্ন লোকেশনে অফিস নেবে, লোকবল রিক্রুট করবে। তাছাড়া ৩০% টাকা আদায় হবে না, এটাও ধরে রাখতে হবে। তৃতীয় বছর থেকে ঠিকাদারের কমিশন কমিয়ে দেয়া হবে। তখন সরকারি রাজস্ব বেড়ে যাবে। আরও একটি কথা এখানে বলা দরকার, এই প্রকল্পে প্রায় এক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।
বর্তমানে বিটিভির কয়েকজন ইন্সপেক্টর বছরের একটি বিশেষ সময়ে শুধু রামপুরা টিভি ভবনের আশপাশে কয়েকটা চক্কর দিয়েই লাইসেন্স ফি আদায়ের কাজ সম্পন্ন করে। এতে সরকার আসলে যা পায়, তাতে হয়তো ইন্সপেক্টরদের বেতন-ভাতাই হয় না। আউটসোর্সিং করা হলেই কেবল এই ক্ষেত্রে প্রকৃত সাফল্য আসবে। প্রয়োজন হলে ইংল্যান্ডের টিভি লাইসেন্সিং যে কম্পিউটার প্রোগ্রামটি ব্যবহার করে, সেটা আমাদের উপযোগী করে কাস্টমাইজ করে নিতে পারি। যে প্রযুক্তি এর মধ্যেই পৃথিবীর মানুষ ব্যবহার করছে, সেখানে আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে সরাসরি কপি করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
টিভি লাইসেন্সিংয়ের এই বিষয়টি নিয়ে আমি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলি। তারা সবাই ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বিষয়টিকে আমলে নেবেন।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা

No comments

Powered by Blogger.