গদ্যকার্টুন-ভালোবাসার প্রতিযোগিতা by আনিসুল হক
ছেলেটি স্কুলে গিয়ে নতুন শিখেছে, প্রতিটা কাজই মূল্যবান। কোনো কাজই ফেলনা নয়। সব কাজেরই একটা অর্থমূল্য আছে। এ ছাড়া কীভাবে বিল করতে হয়, তা-ও তাকে শেখানো হয়েছে। একদিন সন্ধ্যায় মা রান্নাঘরে কাজ করছেন। ছেলেটি তাঁর কাছে গিয়ে একটা বিল জমা দিল। মায়ের হাত ভেজা।
তিনি কাগজটা রেখে দিলেন একটু পরে পড়বেন বলে। কাজ শেষে তিনি ছেলের দেওয়া চিরকুটটা হাতে নিলেন। ছেলে লিখেছে:
গাছে পানি দেওয়া: ১০ টাকা।
দোকান থেকে এটা-ওটা কিনে দেওয়া (তিনবার): ১৫ টাকা
ছোট ভাইকে কোলে রাখা: ৪০ টাকা
ডাস্টবিনে ময়লা ফেলতে যাওয়া: ২১ টাকা
পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা: ৫০ টাকা
মশারি টানানো: পাঁচ টাকা
মোট: ১৪১ টাকা মাত্র
মা বিলটা পড়লেন। মুচকি হাসলেন। তারপর তাঁর আট বছরের ছেলের মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে জল চলে আসছে। তিনি এক টুকরো কাগজ হাতে নিলেন। তারপর তিনি লিখতে লাগলেন:
তোমাকে ১০ মাস পেটে ধারণ করা:
বিনা পয়সায়
তোমাকে দুগ্ধপান করানো:
বিনা পয়সায়
তোমার জন্য রাতের পর রাত জেগে থাকা:
বিনা পয়সায়
তোমার অসুখ-বিসুখে তোমার জন্য প্রার্থনা করা, শুশ্রূষা করা, ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া, তোমার জন্য চোখের জল ফেলা:
বিনা পয়সায়
তোমাকে গোসল করানো, পরিষ্কার করা:
বিনা পয়সায়
তোমাকে গল্প শোনানো, গান শোনানো, ছড়া শোনানো:
বিনা পয়সায়
তোমার জন্য খেলনা, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী কেনা:
বিনা পয়সায়
তোমার কাঁথা ধোওয়া, শুকানো, বদলে দেওয়া:
বিনা পয়সায়
তোমাকে লেখাপড়া শেখানো:
বিনা পয়সায়
এবং তোমাকে আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসা:
বিনা পয়সায়
ছেলের হাতে মা কাগজটা তুলে দিলেন। ছেলে পড়তে লাগল মায়ের বিল। পড়তে পড়তে তার চোখ জলে ভরে উঠল। সে তখন তার নিজের লেখা চিরকুটটা হাতে তুলে নিয়ে লিখল:
পুরো বিল পরিশোধিত।
ভালোবাসার প্রতিযোগিতা হয় না। কে বেশি ভালোবাসে, আমি না তুমি, এভাবে কথা বলা যায় না। তবে একটাই প্রতিযোগিতা করা যায়। তা হলো, দেবার বেলায় এগিয়ে থাকা। যে দেয়, সে দেওতা, মানে দেবতা। আর যে নেয়, সে কী? সে কি নেতা?
নেতা তিনিই, যিনি দেবেন। নেতার কাজই তো দেওয়া। নেতারা ভালো কাজ করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। আর যা স্বাভাবিক, তা খবর নয়। যা অস্বাভাবিক তা-ই খবর। ছয়টার উড়োজাহাজ ছয়টায় ছেড়ে দিয়ে ঠিক সময়ে ঠিক বন্দরে পৌঁছালে সেটা খবর হয় না। ওই প্লেন ভেঙে পড়লেই সেটা খবর। সেই খবর পত্রিকায় না ছাপানো হলেই পাঠকেরা চিৎকার করে উঠবেন, এত বড় নিউজ ছাপা হলো না কেন? বিমান ঠিক সময়ে পৌঁছালে সে খবর না ছাপালে পাঠক আপত্তি করবে না। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুই উল্টোপাল্টা। এখানে ভালো করাটাই যেহেতু ব্যতিক্রম, তাই ভালো কাজও এখানে খবর।
তবে হ্যাঁ, ভালো কাজকে উৎসাহিত করতে পারতে হবে। এক লোক সবকিছুরই নিন্দা করে। তাকে তার বন্ধু দাওয়াত করে খাওয়াল। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ছিল ব্যাপক, রান্নাও হয়েছে ভালো। পেটপুরে খেয়ে সে বলল, ভালোই হয়েছে, তবে লবণটা একটু কম। এর পরের বার লবণও ঠিকভাবে দেওয়া হলো। এবার আর আয়োজনে কোনো গলদ নেই। এবার মেহমান কী বলবেন? তিনি বললেন, খুব ভালো হয়েছে, তবে এত ভালো ভালো না।
আমরা এই রকম সমালোচনা নিশ্চয়ই চাই না। ভালো কাজের প্রশংসা নিশ্চয়ই করতে হবে। প্রশংসা মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে। এ জন্য সমাজে ভালো কাজের স্বীকৃতি ও পুরস্কার থাকতে হয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর ছোটবেলার স্মৃতিতে লিখেছেন, ছোটবেলায় তিনি উল্টো হাঁটা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়ে একটা চা-চামচ পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই চামচ নিয়ে তিনি সারাক্ষণ গর্বভরে ঘুরে বেড়াতেন। বাড়িতে মেহমান এলে বৈঠকখানায় তিনি চামচটা নিয়ে হাজির হতেন। চামচটা নাড়তেন, যাতে মেহমানেরা জিজ্ঞেস করে, ‘ও খোকা, তুমি চামচ নাড়ো কেন?’ তাহলে তো তিনি বলতে পারবেন, ‘এটা আমি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি।’
শাসকদের ভালো কাজের প্রশংসা তাই অকুণ্ঠভাবেই করা দরকার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভালো কাজ করবেন বলেই তাঁরা ওই পদে আসীন হয়েছেন। সেই কাজে ভুল হলে তাঁরা যত সমালোচিত হবেন, ভুল না করলে ততটা প্রশংসিত হবেন না।
আর গণতন্ত্রে সবাই সমান। রাজার ছেলেরও এক ভোট, ভিখিরির ছেলেরও এক ভোট। কিন্তু, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ রাজার ছেলে কাঙালের ধন চুরি করলে তাকে নিবৃত্ত করবে কে? স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইনের শাসন আর স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। গণতন্ত্র যাতে দুর্বিষহ নিপীড়নতন্ত্রে পরিণত না হয়, তা দেখার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমেরই। সে জন্যই কবি বলেন, ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো।’
এ লেখা শুরু করেছিলাম মায়ের সঙ্গে সন্তানের ভালো কাজের প্রতিযোগিতা দিয়ে। মায়ের কাছে আমাদের যে ঋণ, তা কি শোধাবার মতোন? রবীন্দ্রনাথের এই গান কি আমাদের চোখ ভিজিয়ে দেয় না, ‘অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা—/ তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!/ আমার জনম গেল বৃথা কাজে,/ আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে—’
আমাদের জনম আসলে বৃথা কাজেই যাচ্ছে। আমরা আসলে আমাদের দেশমাতাকে কিছুই দিইনি। জানি না কীভাবে দেশমাতার ঋণ আমরা শোধ করতে পারব। সত্যিই জানি না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
গাছে পানি দেওয়া: ১০ টাকা।
দোকান থেকে এটা-ওটা কিনে দেওয়া (তিনবার): ১৫ টাকা
ছোট ভাইকে কোলে রাখা: ৪০ টাকা
ডাস্টবিনে ময়লা ফেলতে যাওয়া: ২১ টাকা
পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা: ৫০ টাকা
মশারি টানানো: পাঁচ টাকা
মোট: ১৪১ টাকা মাত্র
মা বিলটা পড়লেন। মুচকি হাসলেন। তারপর তাঁর আট বছরের ছেলের মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে জল চলে আসছে। তিনি এক টুকরো কাগজ হাতে নিলেন। তারপর তিনি লিখতে লাগলেন:
তোমাকে ১০ মাস পেটে ধারণ করা:
বিনা পয়সায়
তোমাকে দুগ্ধপান করানো:
বিনা পয়সায়
তোমার জন্য রাতের পর রাত জেগে থাকা:
বিনা পয়সায়
তোমার অসুখ-বিসুখে তোমার জন্য প্রার্থনা করা, শুশ্রূষা করা, ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া, তোমার জন্য চোখের জল ফেলা:
বিনা পয়সায়
তোমাকে গোসল করানো, পরিষ্কার করা:
বিনা পয়সায়
তোমাকে গল্প শোনানো, গান শোনানো, ছড়া শোনানো:
বিনা পয়সায়
তোমার জন্য খেলনা, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী কেনা:
বিনা পয়সায়
তোমার কাঁথা ধোওয়া, শুকানো, বদলে দেওয়া:
বিনা পয়সায়
তোমাকে লেখাপড়া শেখানো:
বিনা পয়সায়
এবং তোমাকে আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসা:
বিনা পয়সায়
ছেলের হাতে মা কাগজটা তুলে দিলেন। ছেলে পড়তে লাগল মায়ের বিল। পড়তে পড়তে তার চোখ জলে ভরে উঠল। সে তখন তার নিজের লেখা চিরকুটটা হাতে তুলে নিয়ে লিখল:
পুরো বিল পরিশোধিত।
ভালোবাসার প্রতিযোগিতা হয় না। কে বেশি ভালোবাসে, আমি না তুমি, এভাবে কথা বলা যায় না। তবে একটাই প্রতিযোগিতা করা যায়। তা হলো, দেবার বেলায় এগিয়ে থাকা। যে দেয়, সে দেওতা, মানে দেবতা। আর যে নেয়, সে কী? সে কি নেতা?
নেতা তিনিই, যিনি দেবেন। নেতার কাজই তো দেওয়া। নেতারা ভালো কাজ করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। আর যা স্বাভাবিক, তা খবর নয়। যা অস্বাভাবিক তা-ই খবর। ছয়টার উড়োজাহাজ ছয়টায় ছেড়ে দিয়ে ঠিক সময়ে ঠিক বন্দরে পৌঁছালে সেটা খবর হয় না। ওই প্লেন ভেঙে পড়লেই সেটা খবর। সেই খবর পত্রিকায় না ছাপানো হলেই পাঠকেরা চিৎকার করে উঠবেন, এত বড় নিউজ ছাপা হলো না কেন? বিমান ঠিক সময়ে পৌঁছালে সে খবর না ছাপালে পাঠক আপত্তি করবে না। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুই উল্টোপাল্টা। এখানে ভালো করাটাই যেহেতু ব্যতিক্রম, তাই ভালো কাজও এখানে খবর।
তবে হ্যাঁ, ভালো কাজকে উৎসাহিত করতে পারতে হবে। এক লোক সবকিছুরই নিন্দা করে। তাকে তার বন্ধু দাওয়াত করে খাওয়াল। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ছিল ব্যাপক, রান্নাও হয়েছে ভালো। পেটপুরে খেয়ে সে বলল, ভালোই হয়েছে, তবে লবণটা একটু কম। এর পরের বার লবণও ঠিকভাবে দেওয়া হলো। এবার আর আয়োজনে কোনো গলদ নেই। এবার মেহমান কী বলবেন? তিনি বললেন, খুব ভালো হয়েছে, তবে এত ভালো ভালো না।
আমরা এই রকম সমালোচনা নিশ্চয়ই চাই না। ভালো কাজের প্রশংসা নিশ্চয়ই করতে হবে। প্রশংসা মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে। এ জন্য সমাজে ভালো কাজের স্বীকৃতি ও পুরস্কার থাকতে হয়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর ছোটবেলার স্মৃতিতে লিখেছেন, ছোটবেলায় তিনি উল্টো হাঁটা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়ে একটা চা-চামচ পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই চামচ নিয়ে তিনি সারাক্ষণ গর্বভরে ঘুরে বেড়াতেন। বাড়িতে মেহমান এলে বৈঠকখানায় তিনি চামচটা নিয়ে হাজির হতেন। চামচটা নাড়তেন, যাতে মেহমানেরা জিজ্ঞেস করে, ‘ও খোকা, তুমি চামচ নাড়ো কেন?’ তাহলে তো তিনি বলতে পারবেন, ‘এটা আমি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি।’
শাসকদের ভালো কাজের প্রশংসা তাই অকুণ্ঠভাবেই করা দরকার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভালো কাজ করবেন বলেই তাঁরা ওই পদে আসীন হয়েছেন। সেই কাজে ভুল হলে তাঁরা যত সমালোচিত হবেন, ভুল না করলে ততটা প্রশংসিত হবেন না।
আর গণতন্ত্রে সবাই সমান। রাজার ছেলেরও এক ভোট, ভিখিরির ছেলেরও এক ভোট। কিন্তু, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ রাজার ছেলে কাঙালের ধন চুরি করলে তাকে নিবৃত্ত করবে কে? স্বাধীন বিচার বিভাগ, আইনের শাসন আর স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। গণতন্ত্র যাতে দুর্বিষহ নিপীড়নতন্ত্রে পরিণত না হয়, তা দেখার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমেরই। সে জন্যই কবি বলেন, ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো।’
এ লেখা শুরু করেছিলাম মায়ের সঙ্গে সন্তানের ভালো কাজের প্রতিযোগিতা দিয়ে। মায়ের কাছে আমাদের যে ঋণ, তা কি শোধাবার মতোন? রবীন্দ্রনাথের এই গান কি আমাদের চোখ ভিজিয়ে দেয় না, ‘অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা—/ তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!/ আমার জনম গেল বৃথা কাজে,/ আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে—’
আমাদের জনম আসলে বৃথা কাজেই যাচ্ছে। আমরা আসলে আমাদের দেশমাতাকে কিছুই দিইনি। জানি না কীভাবে দেশমাতার ঋণ আমরা শোধ করতে পারব। সত্যিই জানি না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments