নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসন by এ এম এম শওকত আলী

এতদিন পর্যন্ত মনে করা হতো যে পল্লী অঞ্চলেই দরিদ্র জনসংখ্যা শহরের তুলনায় অধিক। এ ধারণা এখন পাল্টে যাচ্ছে। দারিদ্র্য নিরসন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বর্তমানে নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ ছাড়া ২০০৭-০৮ সালে গৃহীত জাতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্রেও এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হয়েছিল।


সর্বশেষ চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলেও এ বিষয়টি স্বীকৃত। এতে বলা হয়েছে যে নগরের দরিদ্র পল্লী অঞ্চলের দারিদ্র্যের তুলনায় তীব্রতর ও ভয়ংকর। মার্চের ৯ তারিখে এ বিষয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল : 'নগরের দারিদ্র্যের প্রতি অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন'। একজন দারিদ্র্য নিরসন বিশেষজ্ঞের মতে নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মূলধন পাওয়ার সুযোগসহ স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই মূলত পল্লী অঞ্চলের। জীবিকা অর্জনের জন্য ওই অঞ্চলের দরিদ্ররা শহরে চলে আসেন। তাঁদের বেশির ভাগ বাস করেন বস্তিতে। যাঁরা সে সুযোগ পান না, তাঁরা কোনো রকমে রেললাইনের পাশে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বাস করেন। বস্তি হোক বা রেললাইনের পাশেই হোক, তাঁদের একটি ভীতি হলো উচ্ছেদ-ভীতি। হাইকোর্টসহ মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, উচ্ছেদ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন। পুনর্বাসন না করে উচ্ছেদ করা যাবে না।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে উচ্ছেদের বিষয়টি অনেকটা থেমে গেছে। এ সত্ত্বেও এ অবস্থায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভীতি এখনো রয়ে গেছে। কারণ যে জমিতে তাঁরা বাস করছেন, সে জমির ওপর তাঁদের কোনো মালিকানা নেই। মালিকানা কোনো দিন হবে কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ কারণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বস্তির কোনো উন্নয়নও হয় না। কিছু এনজিও অবশ্য এসব এলাকায় শিক্ষাসহ স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, নগরের বস্তিবাসী ও ভাসমান দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের বা রাষ্ট্রের কি কোনো দায়িত্বই নেই। সংবিধান অনুযায়ী বা মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এ দায়িত্ব অবশ্যই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র কি সে দায়িত্ব পালন করছে?
এ বিষয়ে বলা যায় যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে এবং জুন ২০১২ পর্যন্ত তা চলবে। পরবর্তী পর্যায়ে কী হবে? সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। একই কর্মসূচি জুলাই ২০১২ থেকে আগামী পাঁচ বছর পর্যন্ত চলবে। চলমান প্রকল্পটিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও কয়েকটি দাতা সংস্থা অর্থায়ন করেছে। বাংলাদেশ সরকারও এর অংশীদার। যে কর্মসূচি জুন ২০১২ সালে শেষ হবে, এতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মোট ৯ কোটি ডলার। এ প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত মোট ১১টি বিষয়ে দরিদ্রদের বিনা মূল্যে বা সহনীয় মূল্যে চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হয়। দেশের সবকয়টি সিটি করপোরেশনসহ কয়েকটি নির্বাচিত পৌরসভায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিগত প্রায় পাঁচ বছরে এসব সেবার আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা ছিল মোট ১২ মিলিয়ন। অর্থাৎ এক কোটি ২০ লাখ। এ প্রকল্পের প্রতীক হলো রামধনু। এর পাশাপাশি ব্র্যাকের উদ্যোগে 'মানসী' নামেও সবকয়টি সিটি করপোরেশনে অনেকটা একই সেবা দরিদ্রদের বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে মার্কিন সরকারের সাহায্যপুষ্ট 'সূর্যের হাসি' নামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প।
প্রাথমিক পর্যায়ে সূর্যের হাসি প্রকল্পের দর্শন ছিল ভিন্নতর। এ প্রকল্পের হোতারা দরিদ্রদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। এরা প্রথমে শতকরা ১০০ ভাগ খরচ পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ১০০ ভাগের সীমা শতকরা ৫০ ভাগে হ্রাস করার পরও নির্ধারিত ভাগ অর্জনে সক্ষম ছিল না। এ কারণে প্রশ্ন করা যায় যে একই দেশে পরস্পরবিরোধী কর্মসূচি কেন বাস্তবায়িত হবে। এ প্রশ্নের সুরাহা এখনো হয়নি। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিনা মূল্যে দিলে অবশ্যই দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু চিকিৎসা ব্যয় মোট ব্যয়ের শতকরা ৬৪ ভাগ। অর্থাৎ এরা যদি বিনা মূল্যে বা ক্ষেত্রবিশেষে সহনীয় মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে মোট ব্যয়ের শতকরা ৬৪ ভাগ সাশ্রয় হবে, যা দিয়ে তাঁরা অন্য ব্যয় মেটাতে সক্ষম হবে।
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার নীতি বিভিন্ন সরকার কর্তৃক গৃহীত স্বাস্থ্য নীতিতে একটি স্বীকৃত বিষয়। এ দায়িত্ব সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। বাস্তবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কাঠামো এ মন্ত্রণালয়ের নেই। বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। যা আছে তা হলো জেলা সদরের জেলা হাসপাতালসহ সরকারি মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল। এরা অসংখ্য রোগীর চাপে বিপর্যস্ত। অন্যদিকে রয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এর সংখ্যা সরকারি আওতাধীন হাসপাতাল বা ক্লিনিকের চেয়ে বেশি। তবে এগুলো দরিদ্রদের জন্য নয়। কারণ এগুলোর মাধ্যমে সেবার জন্য অনেক বেশি খরচ হয়, যা দরিদ্রদের সাধ্যের বাইরে। বিভিন্ন নগরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ২৬টি। এর মধ্যে কতগুলো সচল নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ কেন্দ্রগুলোকে বর্তমানে সচল করার উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
প্রশ্ন করা যেতে পারে যে স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কেন করা হবে। এর যুক্তি এ বিভাগের আওতাভুক্ত নগরের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার আইনি কাঠামোতে এ দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি নতুন কিছু নয়। নগরভিত্তিক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান দেড় শ বা ২০০ বছর আগে থেকেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। এখন পর্যন্ত একই বিধান আইনে রয়েছে। সীমিত নিরাময়মূলক (Curative Care) স্বাস্থ্যসেবাও এগুলোর দায়িত্ব পরিধিভুক্ত। অনেক বড় পৌরসভা যা পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশনে রূপান্তরিত হয়েছে। সেগুলো তখন এ দায়িত্ব সীমিত আকারে পালন করত। যেমন ঢাকা ও চট্টগ্রাম। এর পরিধি আর্থিক ও কারিগরিবিষয়ক সীমাবদ্ধতার কারণে বিস্তৃতি লাভ করেনি। ১৯৯৮ সাল থেকে চলমান প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের সহায়তায় এ দায়িত্ব আগের তুলনায় অধিকতর বিস্তৃতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। মূল প্রশ্নটি হলো এ ব্যবস্থা কি স্থায়ী হবে?
এ সমস্যা সমাধানের জন্যও চলমান প্রকল্পে একটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর নাম হলো �Sustainability Fund�. আর্থিক ও কারিগরি সীমাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা হবে। এতে এসব প্রতিষ্ঠান নিজ রাজস্ব বাজেটের শতকরা এক ভাগ জমা করবে প্রতিবছর। অন্যদিকে সহযোগী সেবাদানকারী এনজিওরা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বাড়তি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ এ ফান্ডে জমা দেবে এবং বাকি ২০ ভাগ তাঁরা নিজেরাই নিয়ে নিতে পারবে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বাস্তবে এ ব্যবস্থা এখনো ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ প্রধানত দুটি। এক. চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ছাড়া কোনো সিটি করপোরেশন নিজ রাজস্ব বাজেটের নির্ধারিত শতকরা এক ভাগ জমা দেয়নি। দুই. সহযোগী এনজিওরাও এ কাজটি সঠিকভাবে পালন করছে না। এদের অনেকের যুক্তি, তারা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেনি। যারা কমরছে, তারাও করেনি। শেষোক্ত বিষয়ে বলা যায় যে প্রকল্প বাস্তবায়নবিষয়ক পরিবীক্ষণের দুর্বলতা। স্থানীয় সরকার বিভাগ এদিকে দৃষ্টি দিলে ভালো হবে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রকল্পের ১১টি সেবার মধ্যে বেশির ভাগ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ওষুধও বিনা মূল্যে দরিদ্র রোগীরা পেয়ে থাকে। সিজারিয়ান ডেলিভারির জন্য মাত্র ছয় হাজার টাকা রোগীদের দিতে হয়। পক্ষান্তরে এ ধরনের সেবার জন্য অন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অমনক বেশি রোগীরা দিয়ে থাকেন বা দিতে বাধ্য হন। চোখের ক্যাটারাকট অপারেশনের মূল্য মাত্র এক হাজার ২০০ টাকা। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এর মূল্য দিতে হবে অন্তত ২৫ হাজার টাকা। গরিব শহরবাসীর সেবা গ্রহণের জন্য লাল রঙের কার্ড দেওয়া হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে লাল কার্ড নেই, এমন অনেক রোগী এ প্রকল্পের সেবাকেন্দ্রে আসেন। তাঁদেরও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। তাঁরাও নিয়মমাফিক বিনা মূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পান। এ ছাড়া একটি সিটি করপোরেশনের সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি অভিনব উদ্যোগ। প্রকল্পের কিছু দুর্বলতা অবশ্যই আছে। কিন্তু সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রকল্প নিঃসন্দেহে দরিদ্রবান্ধব। নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের সফল কৌশল এটি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.