২০০৯-এর সাত-পাঁচঃ ২ by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান


২০০৯-এর শুরুতে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে ঠিকমত বসতে না বসতেই যেন ‘পেয়েছিরে’—বলে নানা আবদার নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ঝাঁপিয়ে পড়াটা বড় অপ্রশান্তিকরভাবে দৃষ্টিকটু লেগেছে। ট্রানজিটের নামে ভারত থেকে ভারতে যাওয়ার করিডোর চাই, চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া চাই, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অনাপত্তি চাই—চাওয়ার তালিকা অন্তহীন।
সব চাওয়ার বিপরীতে আমাদের অবস্থা যেন ‘আমার যেসব দিতে হবে সেতো আমি জানি’র মতো প্রশান্তির। ‘প্রশান্তির একটি বছর’-এ আমরা দেখেছি—বাচাল-বেয়াদব ভারতীয় এক সাংবাদিক আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই বাংলাদেশকে ‘বাফার স্টেট’ বলে অভিহিত করেছে বিঘ্নহীন দুঃসাহসে। আর ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক দাদাকে দেখেছি ‘মহামান্য’ ভঙ্গিতে যত্রতত্র দাদাগিরি ফলাতে। ভাবটা এমন, যেন তিনি বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীদের গুরুদেব হয়ে এসেছেন উচিত-অনুচিত বিষয়ে দীক্ষা দিতে। আমাদের বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কে তার অমার্জনীয় উক্তি এ দেশের বহু মানুষকে ভারতবিদ্বেষী করে তুলেছে গত এক বছরেই। অবশ্য এসব আচরণও কারও কারও কাছে ‘প্রশান্তির’ মনে হতে পারে। একটি গ্রাম্য গল্প মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশ নামক গ্রামের মানুষ আমি, শহুরে গল্প কোথায় পাব! যাই হোক, গল্পটি এমন—এক ব্যক্তি হাটের দিক থেকে পড়িমরি করে ছুটতে ছুটতে আসছে। তার পা নগ্ন, জামা-কাপড় ছেঁড়া, চুল এলোমেলো, সারা গায়ে ধুলো-ময়লা। পথে কয়েকজন পরিচিত লোক তাকে দেখে থামাল। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল—‘হাটে তাকে একা পেয়ে, পাশের গায়ের ছেলেরা খুব মেরেছে। কিলঘুষি, চড়-থাপ্পড়, লাথি, এমনকি জুতা দিয়েও পিটিয়েছে। পরিচিত লোকদের একজন বলে উঠল—কী! এতবড় অপমান!!’ সঙ্গে সঙ্গে প্রবল আপত্তি জানালো মার খাওয়া লোকটি—‘না, অপমান করতে পারেনি। তার আগেই পালিয়ে এসেছি।’ মানসম্মানবোধ এমন হলে ‘প্রশান্তি’তে বাধা কোথায়? পিলখানা হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করেছি গত সপ্তাহে। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে। সরকার তখনও ঠিকমত গুছিয়ে বসতে পারেনি। তাই এ কথাটা প্রচার করা সহজ হয়েছিল যে, সরকারকে স্থিতিশীল হতে না দেয়ার জন্যই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। যথারীতি এ জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ইঙ্গিতও শানানো হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির কি এতবড় একটি ঘটনা ঘটানোর মতো শক্তি তখন আদৌ ছিল? দেশি-বিদেশি চক্রান্ত, অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক সব দলকে এলোমেলো করে দেয়া, নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুমে নাস্তানাবুদ করা এবং নির্বাচনে বিশাল পরাজয়ে বিএনপির তো তখন অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন। প্রকৃত সত্য জানার জন্য ঘটনাটির পূর্বাপর একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যা যা খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে জানা যায় যে নির্বাচনের আগে এবং পরে, বর্তমান সরকারের বিশেষ বিশেষ ক্ষমতাধর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে বিডিআর বিদ্রোহীদের। অতএব বিদ্রোহের পূর্বাভাস কারও পক্ষে আদৌ পাওয়া সম্ভব হলে, সেই নেতারাই পেতে পারেন। প্রশ্ন আসে, কি বিষয় নিয়ে বৈঠক হয়েছিল তার কোনো বিবরণ কেন প্রকাশিত হলো না? আবার বিদ্রোহের প্রথম দিন বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা এমনভাবে হলো যে সেদিনের জনসহানুভূতি সম্পূর্ণভাবেই ছিল বিদ্রোহীদের পক্ষে। কেউ জানতেও পারল না কী নৃশংস ঘটনা ঘটে গেছে তার মধ্যেই। বিদ্রোহ দমনে কোনো সামরিক ব্যবস্থাও গৃহীত হলো না। আমরা দেখলাম, সরকারি প্রতিনিধি সাদা রুমাল উড়িয়ে ভেতরে গেলেন। তারপর বিদ্রোহীদের প্রতিনিধি দল গেলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে। তদানীন্তন সেনাপ্রধানের উপস্থিতিতে বিদ্রোহীদের সঙ্গে কী আলোচনা হলো তার পূর্ণবিবরণ অপ্রকাশিত থেকে গেল। শুধু শুনলাম সরকার বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। এবং তারা অস্ত্র সমর্পণ করবে। সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গেলেন অস্ত্র জমা নিতে। তার সদাহাসিমুখ দেখে বাইরের কেউ বুঝলই না কী ঘটেছে ভেতরে। কিন্তু সরকারের প্রতিনিধি কিংবা স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভেতরে ঢুকে ঘরে ঘরে গিয়েও কী জানতে পারেননি কী ঘটেছে? তার অধীন গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে কোনো রিপোর্ট ছাড়াই কি তিনি সেখানে গিয়েছিলেন? তাই যদি হয়—তবে তিনিসহ তার পুরো বিভাগই কি প্রশ্নের সম্মুখীন হন না? ২৫ ও ২৬ দু’দিন ধরে একটি নারকীয় ঘটনা অগোচরে থেকে গেল! তাও অরণ্যে পর্বতে নয়, এ ঢাকা শহরের বুকেই!! এতটা ঘটানো, ক্ষমতায় না থাকা ছত্রভঙ্গ কোনো বিরোধী দলের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষত যে দলটি নির্বাচনেই যেতে পারবে কিনা তা নিয়েই সংশয় ছিল অসংগঠিত থাকার কারণে। গণমানুষের মনে গভীর সন্দেহ আছে যে, এর জন্য বিদেশি চক্রান্ত দায়ী। অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দিয়ে বাংলাদেশকে সর্বতোভাবে অস্থিতিশীল করার যে খেলা শুরু হয়েছিল—এটি ছিল তারই অংশ। তাই নির্বাচিত সরকারকে গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ না দিয়েই এ আঘাত হানা হয়েছে। শুধু ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে হত্যা নয়—সেনাবাহিনীর সংহতিতে আঘাত করা হয়েছে এ নারকীয় ঘটনায়। আর বিডিআরকে করা হয়েছে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত। ঐতিহ্যবাহী এ বাহিনীকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। নাম ও পোশাক পরিবর্তিত হলে, পাদুয়া-রৌমারীর সেই বীরদের সহযাত্রীরা কি আর কখনও আস্থা ফিরে পাবেন? তার উপর কথা উঠেছিল যে নতুন সীমান্তরক্ষী বাহিনী তৈরি করা হবে—যাদের প্রশিক্ষণ দেবে ভারতীয় বিএসএফ—যারা নির্বিচারে নারী-শিশুসহ বাংলাদেশীদের হত্যা করে চলেছে সীমান্তে। যাই হোক, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের জন্যই কি একটা বছরকে অভিশপ্ত ভাবা যথেষ্ট নয়?

লেখক : কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.