ঘূর্ণিপাকে বিমান by আশরাফুল হক রাজীব

কর্মচারীদের খাবারের টাকা বাড়ানো নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে। সংস্থাটির সর্বনিম্ন ধাপের কর্মচারীরা সর্বোচ্চ ধাপের কর্মকর্তাদের বেতনের এক ভাগের সমান 'আহার ভাতা' দাবি করেছেন। তাঁদের এই দাবি মেটাতে বছরে বিমানকে অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে বলে জানা গেছে।


পরিচালনা পর্ষদ দাবি নাকচ করায় এখন পর্ষদ বাতিলেরই আলটিমেটাম দিয়েছেন কর্মচারীরা।
সাম্প্রতিক অচলাবস্থার কারণ জানতে চাইলে বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল জামালউদ্দিন আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিষয়গুলো প্রশাসনিক উল্লেখ করে তিনি বিমানের এমডি বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর জাকীউল ইসলাম বলেন, 'আহার ভাতা বাড়ানো কর্মচারীদের অন্যতম একটি দাবি। এ ছাড়া তাঁদের আরো কিছু দাবি রয়েছে।'
বিমানের হিসাব শাখা সূত্রে জানা গেছে, বিমানের কর্মচারীরা বর্তমানে দৈনিক ৫০ টাকা হারে আহার ভাতা পান। প্রথম দফায় সেটা তাঁরা ১৫০ টাকায় উন্নীত করার দাবি জানান। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সিভিল এভিয়েশনের কর্মচারীদের আহার ভাতার নজির টেনে আনেন। বিমানের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, সিভিল এভিয়েশন সরকারের আলাদা একটি সংস্থা। সেটি তাদের নিজস্ব নিয়মে চলে। সিভিল এভিয়েশনের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কম। সে কারণে তাঁদের আহার ভাতা একটু বেশি দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিমানের বেতন-ভাতা সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক গুণ বেশি। সেই হিসাবে আহার ভাতা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কর্মচারীরা বিমানের নির্বাহী পরিচালকদের বেতনের ১ শতাংশ হারে আহার ভাতা দাবি করেন। নির্বাহী পরিচালকদের মূল বেতন ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। এর ১ শতাংশ হারে আহার ভাতা দাঁড়ায় দৈনিক ৩৩৫ টাকা। ৫০ টাকা থেকে আহার ভাতা ৩৩৫ টাকা করতে হলে বিমানকে বছরে অতিরিক্ত ৩৩ কোটি ৫৭ লাখ ৯৬ হাজার ১২০ টাকা ব্যয় করতে হবে। কর্মচারীদের এই দাবির প্রতি একসময় বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান সমর্থন দেন বলে জানা গেছে।
তিনি কর্মচারীদের আহার ভাতা বাড়ানোর জন্য বিমানের এমডিকে নির্দেশ দেন। এমডি বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করেন। পর্ষদ বিমানের আর্থিক সংকটের কথা বিবেচনা করে আহার ভাতা বাড়ানোর বিষয়টি নাকচ করে দেন। এর পরই কর্মচারীরা পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি তোলেন এবং মন্ত্রীকে পর্ষদের প্রধান করার জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমান চরম অর্থিক সংকটে রয়েছে। বোয়িং থেকে দুটো এয়ারক্রাফট কেনায় তার কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এই অবস্থায় বিমানের পক্ষে বেতন-ভাতা পরিশোধ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, 'বিমানের মোট খরচের ৫৫ শতাংশ যায় জ্বালানি তেলের পেছনে। ২০০৯ সালে আমরা দায়িত্ব নেওয়ার সময় জ্বালানির দাম ছিল ৪৪ টাকা লিটার। এখন সেটা বেড়ে ৮৮ টাকা হয়েছে। বিমান পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে ৫০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। সেটা পাওয়া যায়নি। এই সময় বিমান টিকে থাকার চেষ্টা করছে। কর্মচারীদের আহার ভাতার পেছনে বছরে অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় করার সময় এটা নয়।'
বোর্ড থেকে আহার ভাতার দাবি প্রত্যাখ্যাত হলে বিমানের সিবিএ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারা বিমানের নির্বাহী পরিচালকদের বেতনের ১ শতাংশ হারে আহার ভাতা বাড়ানোসহ আরো ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। অন্যান্য দাবির মধ্যে বিমানের সাংগঠনিক কাঠামো প্রকাশ করার বিষয়টিও রয়েছে। বিমানের কর্মচারীরা জানিয়েছেন, এক কোটি টাকা ব্যয়ে সাংগঠনিক কাঠামো করেছে বিমান। সেই সাংগঠনিক কাঠামো কী তাঁরা তা জানতে চান। তাঁরা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন স্থানে জনবল নিয়োগ দেওয়ার এবং পার্সোনাল পে সমন্বয় করার দাবি জানিয়েছেন। প্রথম পর্যায়ে তাঁরা ২৮ দফা দাবি তুলেছিলেন। এসব দাবির মধ্যে ১৫ দিনের পিতৃত্বকালীন ছুটি রয়েছে। যদিও দেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থায় এই ছুটি নেই। বিমান শ্রমিক লীগ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে সব কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের জন্য বছরে দুবার যেকোনো রুটে ৯০ শতাংশ রেয়াতি হারে বিমান টিকিট দাবি করে। তারা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য আমৃত্যু বিনামূল্যে বিমান টিকিট দাবি করেছে। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে শ্রমিক প্রতিনিধি, হজ থেকে পাওয়া টাকা কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনেরও দাবি রয়েছে।
বিমান সূত্র জানিয়েছে, বিমানে বর্তমানে ১০টি ট্রেড ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। এর মধ্যে চারটি শ্রমিক সংগঠন। এগুলো হলো আওয়ামী লীগপন্থী বিমান শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ বিমান এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (বাম ধারা), বাংলাদেশ বিমান শ্রমিক ইউনিয়ন (বাম ধারা) এবং বিমান জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল (বিএনপিপন্থী)। প্রতিটি সংগঠন নিবন্ধিত। এসব সংগঠনের মধ্যে বিমান শ্রমিক লীগ গত জানুয়ারিতে সিবিএ হিসেবে নির্বাচিত হয়। বিমানে কর্মকর্তাদের তিনটি সংগঠন রয়েছে। এগুলো কর্মকর্তাদের সংগঠন হলেও শ্রমিক সংগঠন হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে বলে জানা গেছে। শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মকর্তা পর্যায়ের কোনো সংগঠন শ্রম সংগঠন হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারে না। সংগঠনগুলো হলো ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড নেভিগেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফেনা), বাংলাদেশ বিমান ফ্লাইং সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব কেবিন ক্রু এবং সোসাইট অব এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ার্স অব বিমান (সায়েব)। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা এসব সংগঠনের নিবন্ধন বেআইনি বলে চিহ্নিত করেছে। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে শ্রম মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশন (বাপা), বিমান অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বোয়া), বিমান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নামেও সংগঠন রয়েছে। এদের মধ্যে বাপা আন্তর্জাতিক একটি সংগঠনের অধিভুক্ত হওয়ায় তাদের বৈধতা রয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৮৪ ধারায় তাদের বৈধতা দেওয়া হয়। বিমান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এখনো রেজিস্ট্রেশন পায়নি।
২০০৭ সালে বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কম্পানি করার সময় সরকার চারটি শর্ত দিয়েছিল। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বিমানের ট্রেড ইউনিয়নসমূহের অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা, দিনদিনই ট্রেড ইউনিয়নের দাপট বেড়েছে বিমানে। সামান্য বদলি থেকে শুরু করে হেলপারদের ডিউটি দেওয়ার মতো কাজেও শ্রমিক সংগঠনগুলোর হস্তক্ষেপ, অফিস সময়ে দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করা এবং কাজ না করে ওভারটাইম তুলে নেওয়াসহ তদবির করে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সংস্থাটির মতে, বর্তমানে বিমানে সাতটি সংগঠন নিয়মবহির্ভূতভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
জানা গেছে, বিমানে বর্তমানে চার হাজার ৬১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিন হাজার ২০৮ জন স্থায়ী এবং এক হাজার ৪১০ জন অস্থায়ী। কেবল স্থায়ী সদস্যদেরই ট্রেড ইউনিয়ন করার কথা। কিন্তু বিমানের ট্রেড ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অস্থায়ী কর্মচারীদের দাপটই বেশি। এ দাপট শুধু আন্দোলনে সীমিত নেই। অভিযোগ রয়েছে, ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা দাপ্তরিক কাজে অংশ নেন না। তাঁরা বেশির ভাগ সময় তদবিরসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। কাজ না করেও ওভারটাইম নেন। সরকারি বিধি অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা ওভারটাইম পান না। কিন্তু বিমানে এর ব্যত্যয় হচ্ছে। গত বছর বিমানের এমএলএসএস আবুল কালাম সংস্থার বাণিজ্যিক কর্মকর্তা দিবাকর দেওয়ানজীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন বলে জানা যায়। কালাম তাঁর পছন্দের লোক দিয়ে কার্গো শাখায় কাজ করান। তাঁর দেওয়া তালিকা অনুযায়ী বিমান নৈমিত্তিক কর্মীদের কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়। তাঁর তালিকা না মানায় তিনি কয়েকজন কর্মকর্তার সামনে বাণিজ্যিক কর্মকর্তাকে নাজেহাল করেন। বিষয়টি নিয়ে বিমানের তদন্তে কালামকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
বিমান শ্রমিক লীগ ও সিবিএ সভাপতি মো. মশিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন আমাদের মূল দাবি আহার ভাতা নয়। এখন দাবি একটাই। আর সেটা হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদের বিলুপ্তি। পর্ষদ বিলুপ্ত করে বিমান পরিচালনার দায়িত্ব বিমান ও পর্যটনমন্ত্রীর হাতে দিতে হবে। আমরা সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছি। মানা না হলে কঠিন কর্মসূচি আসবে।'
সিবিএ নেতাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি মেনে নিয়ে মশিকুর রহমান বলেন, বর্তমান সিবিএ এ ধরনের কাজ করবে না। বর্তমান সিবিএ বিমানকে লাভজনক সংস্থায় পরিণত করতে সহায়তা দেবে।

No comments

Powered by Blogger.