চিকিৎসা ব্যবস্থা-মানুষ চিকিৎসা নিতে ‘অমানুষ’দের কাছেই যাবে by মশিউল আলম
হেলথ ওয়াচ নামের এক বেসরকারি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য: বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক গড়ে প্রতিটি রোগীর পেছনে সময় দেন মাত্র ৫৪ সেকেন্ড। হেলথ ওয়াচের সমীক্ষার হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১০ সালে মোট ছয় হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের একজন শিক্ষক ও গবেষক বলেন, এর অর্ধেকটাই, তিন হাজার কোটি টাকার ওষুধ অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয়; ‘ইর্র্যাশনাল ইউজ অব ড্রাগ’ বা ওষুধের অযৌক্তিক ব্যবহার।
কিন্তু এটা কেমন করে ঘটে? কেন ঘটে?
বাংলাদেশে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মোট বিশ হাজারের মতো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ আছেন, তাঁরা নিজ নিজ কোম্পানির ওষুধ বিপণনে চিকিৎসকদের মন জয় করতে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাঁরা অতি উচ্চ মাত্রায় ‘টার্গেট ওরিয়েন্টেড’, টার্গেট পূরণের জন্য চিকিৎসকদের নানা ধরনের ‘প্রণোদনা’ দিয়ে থাকেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের সম্পর্কে তথ্য রাখে, তাঁদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র মনিটর করে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বেপরোয়া বিপণন তৎপরতার ফলে ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ওষুধ বেশি বিক্রি হলে কোম্পানির লাভ, চিকিৎসকেরও লাভ। তাই ওষুধ বিক্রি না বাড়ার কোনোই কারণ নেই।
রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলেই তাঁকে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো চিকিৎসক উল্লেখ করে দেন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষাগুলো করিয়ে আনতে হবে। সাধারণ মানুষের ধারণা, চিকিৎসকেরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছ থেকে ‘কমিশন’ পেয়ে থাকেন। এ বিষয়ে এখনো কোনো গবেষণা-সমীক্ষার খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু মানুষের সাধারণ ধারণার যে কোনো ভিত্তি নেই, তা বলা যায় না।
রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক তাঁকে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাগুলো করতে পাঠান, তখন ভিজিট নেন, তারপর যখন রিপোর্টগুলো দেখেন, তখন আবারও ভিজিট নেন (প্রথমবারের চেয়ে কম)। অস্ত্রোপচারের রোগী অস্ত্রোপচারের পর যতবার ডাক্তারের কাছে যাবেন, ততবার ডাক্তার টাকা নেবেন। হাসপাতাল/ক্লিনিকে ভর্তি থাকলে রোগী ওই ডাক্তারের আর দেখাই পাবেন না, কালেভদ্রে তাঁর জুনিয়র কলিগ বা ছাত্ররা এসে রোগীকে এক নজর দেখে যাবেন। রোগীর মনে হবে, তিনি কাঙাল, টাকা দিয়ে চিকিৎসা কিনতে আসেননি, করুণা ভিক্ষা করতে এসেছেন। তখন তাঁর মনে হবে, ডাক্তার মানুষ না, টাকা বানানোর যন্ত্র। তিনি বলে বেড়াবেন, ‘টাকা দিয়েও চিকিৎসা পাবেন না, এমন জায়গা আমি আপনাকে দেখাতে পারি।’ (এক পাঠকের মন্তব্য)।
সরকারের বেতনভুক চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের চেয়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখায় বেশি আগ্রহী; হাসপাতালের পদ-পদবি তিনি ব্যবহার করেন প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পক্ষে সহায়ক ‘সাইনবোর্ড’ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক সম্পর্কে এমন গুরুতর কিছু অভিযোগ শুনেছি, যা ফৌজদারি অপরাধের শামিল।
ঢাকায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট ফি ৭০০-৮০০ টাকা, গ্রামাঞ্চলে ৪০০-৫০০ টাকা। মানুষ মনে করে, এটা ‘গলাকাটা ফি’। এত টাকা কেন নেওয়া হয়? কে নির্ধারণ করে দিয়েছে ৮০০ টাকা বা ৫০০ টাকা ভিজিট ফি? আর সেটা রাতারাতি ৫০০ টাকা থেকে এক লাফে ৮০০ টাকায় উঠলে কিছু বলার বা করার কেউ কি আছে? তা ছাড়া, চিকিৎসকেরা কি ভিজিটের টাকা নিয়ে রোগীকে রসিদ দেন? যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে বসে এক সন্ধ্যায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন রোগী দেখেন, তাঁর দৈনিক আয় কত? তিনি আয়কর বিভাগকে কী হিসাব দেন?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কক্সবাজার সদর হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ডাক্তাররা অমানুষ, গরিবের রক্তচোষা’। এতে চিকিৎসক সমাজের পক্ষ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হলে মিজানুর রহমান প্রথম আলোয় ‘আমার মন্তব্য দেশের সব চিকিৎসক সম্পর্কে নয়’ শিরোনামে একটা লেখা প্রকাশ করেছেন (৯ মার্চ)। সে লেখায় তিনি বলেছেন, ‘বক্তব্যে কোনো চিকিৎসক আহত হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত’। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে তাঁর এই লেখার পাঠক-প্রতিক্রিয়ায় অনেক পাঠক লিখেছেন, তাঁর দুঃখ প্রকাশের প্রয়োজন ছিল না, কারণ তিনি ভুল বা অন্যায় কিছু বলেননি। এমনকি কেউ কেউ লিখেছেন, তিনি যেন তাঁর ওই বক্তব্য থেকে বিচ্যুত না হন। এর আগে ৬ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ লিখেছিলেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চিকিৎসকদের সমালোচনা করতে গিয়ে ‘যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন’। অনলাইন সংস্করণে ওই লেখার পাঠক-প্রতিক্রিয়াগুলোর অধিকাংশই মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যকে সমর্থন করে, এমনকি কোনো কোনো পাঠক আরও কঠোর ভাষা ব্যবহার করে চিকিৎসকদের সমালোচনা করেছেন। চিকিৎসকদের সম্পর্কে ‘কসাই’, ‘ডাকাত’ ইত্যাদি কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন কেউ কেউ। ডা. আবদুল্লাহর বক্তব্যকে সমর্থন করে যাঁরা প্রতিক্রিয়া লিখেছেন, তাঁদের অধিকাংশই চিকিৎসক বা চিকিৎসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। চিকিৎসক সমাজের সদস্যরা ছাড়া অবশিষ্ট জনগণ চিকিৎসকদের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে—তার একটা মোটা দাগের চিত্র পাওয়া যায় ডা. আবদুল্লাহর ও মিজানুর রহমানের ওই দুটি লেখার পাঠক প্রতিক্রিয়াগুলো থেকে।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যদি তাঁর মন্তব্যের সঙ্গে ‘এক শ্রেণীর ডাক্তার’ বা ‘ডাক্তারের একাংশ’ বা ‘ডাক্তারদের কেউ কেউ’ শব্দবন্ধ জুড়ে দিতেন, তাহলে এ নিয়ে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না, চিকিৎসক সমাজও এতটা ক্ষুব্ধ হতেন না। সে রকম বলাই তাঁর উচিত ছিল। কিন্তু ‘আবেগতাড়িত হয়ে’ উক্তিটি করার সময় কূটনৈতিক ভব্যতার বিষয়টি তাঁর মাথায় আসেনি বলে তিনি বিরাট বড় অন্যায় করে ফেলেছেন তা-ও বলা ঠিক হবে না। কোনো জনগাষ্ঠীর সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ওই গোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য বা আচরণের কারণে। ‘বাংলাদেশের মানুষ গরিব’—এমন কথা বললে এটা বোঝায় না যে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষই গরিব, একজনও ধনী লোক নেই। বা লোকে যখন বলে ‘ব্রিটিশ পুলিশ ভালো’—তখন এটা বোঝায় না যে ব্রিটিশ পুলিশের প্রত্যকটি সদস্যই ভালো। আমাদের চিকিৎসকদের কত শতাংশ ‘অমানুষ’ ও ‘রক্তচোষা’র মতো ব্যবহার করলে চিকিৎসকেরা অমানুষ ও রক্তচোষা, এমন কথা বলা অন্যায় হবে না?
ডা. আবদুল্লাহ ক্ষুব্ধ সুরে লিখেছেন, ‘রোগীরা কি মানবাধিকার কমিশনে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নেবেন?’ একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকের এই কথায় যে অচিকিৎসকসুলভ চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটে, তা বিস্ময়কর ও মর্মান্তিক। ডা. দেবপ্রসাদ অধিকারী নামের এক চিকিৎসক-পাঠকের মন্তব্যেও একই মানসিকতার প্রকাশ: ‘ঈশ্বর না করুন, রাত তিনটায় চেয়ারম্যান সাহেব অসুস্থ হলে তাঁকে কিন্তু কোনো রক্তচোষার কাছেই দৌড়াতে হবে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে অমানুষদের কাছে দৌড়ানো শোভা পায় না।’ মনে প্রশ্ন জাগছে: মানবাধিকার সম্পর্কে, চিকিৎসক পেশার নৈতিক স্বরূপ সম্পর্কে এ রকম চিন্তাধারাই কি চিকিৎসকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে? ডা. আবদুল্লাহর লেখাটির প্রতিক্রিয়ায় আরেক পাঠক লিখেছেন, ‘চিকিৎসক পেশার সাথে অন্য পেশার যে বিশাল তফাৎ তা তো এই লোক নিজেই বোঝে না—ছাত্রদের কি ছাই বোঝাবে?’
অধিকাংশ পাঠকের মতে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান জনগণের মনের কথাই বলেছেন—এটাই আসলে বিবেচনার মূল বিষয়। চিকিৎসকেরা এখন নিজেদের মনকেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘জনসাধারণ আমাদের অমানুষ ও রক্তচোষা মনে করে কেন?’
এই আত্মজিজ্ঞাসা খুব জরুরি, কারণ সমাজে চিকিৎসক পেশার মর্যাদা, অনেকে বলেন, সৃষ্টিকর্তার পরেই: মানুষের প্রাণ ও সুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকের কাজ। চিকিৎসকদের সঙ্গে সমাজের আর কোনো পেশাজীবী গোষ্ঠীরই তুলনা চলে না। চিকিৎসকের ঘুম নেই, খাওয়ার সময় নেই, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য সময় নেই। কারণ মানুষের জীবন বাঁচানো এসবের চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব জেনে-বুঝেই একজন মেধাবী শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি চিকিৎসক হবেন। মানুষের এই ধারণা ও প্রত্যাশা কী মাত্রায় আঘাত পেলে চিকিৎসকদের সম্পর্কে অমানুষ, গরিবের রক্তচোষা, কসাই, ডাকাত ইত্যাদি শব্দ তারা ব্যবহার করতে পারে—এই জিজ্ঞাসা চিকিৎসকদের মনে জাগা উচিত।
চিকিৎসকদের মধ্যে যাঁরা সৎ ও মানবিক, যাঁরা চিকিৎসা পেশার প্রকৃত নৈতিক স্বরূপ আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেন, আমার বিশ্বাস, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মন্তব্যে তাঁরা ক্ষুব্ধ হননি। কারণ, তাঁরা জানেন, মন্তব্যটি তাঁদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এক পরিচিত চিকিৎসক আমাকে টেলিফোন করে বললেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ পৌঁছে দেবেন; তাঁর এই মন্তব্যে যদি অমানুষ ও রক্তচোষাদের একটুখানি হলেও টনক নড়ে।’
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
কিন্তু এটা কেমন করে ঘটে? কেন ঘটে?
বাংলাদেশে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মোট বিশ হাজারের মতো মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ আছেন, তাঁরা নিজ নিজ কোম্পানির ওষুধ বিপণনে চিকিৎসকদের মন জয় করতে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাঁরা অতি উচ্চ মাত্রায় ‘টার্গেট ওরিয়েন্টেড’, টার্গেট পূরণের জন্য চিকিৎসকদের নানা ধরনের ‘প্রণোদনা’ দিয়ে থাকেন। ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের সম্পর্কে তথ্য রাখে, তাঁদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র মনিটর করে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর বেপরোয়া বিপণন তৎপরতার ফলে ১৯৯৪ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ওষুধ বেশি বিক্রি হলে কোম্পানির লাভ, চিকিৎসকেরও লাভ। তাই ওষুধ বিক্রি না বাড়ার কোনোই কারণ নেই।
রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলেই তাঁকে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হয়। কোনো কোনো চিকিৎসক উল্লেখ করে দেন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষাগুলো করিয়ে আনতে হবে। সাধারণ মানুষের ধারণা, চিকিৎসকেরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছ থেকে ‘কমিশন’ পেয়ে থাকেন। এ বিষয়ে এখনো কোনো গবেষণা-সমীক্ষার খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু মানুষের সাধারণ ধারণার যে কোনো ভিত্তি নেই, তা বলা যায় না।
রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক তাঁকে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাগুলো করতে পাঠান, তখন ভিজিট নেন, তারপর যখন রিপোর্টগুলো দেখেন, তখন আবারও ভিজিট নেন (প্রথমবারের চেয়ে কম)। অস্ত্রোপচারের রোগী অস্ত্রোপচারের পর যতবার ডাক্তারের কাছে যাবেন, ততবার ডাক্তার টাকা নেবেন। হাসপাতাল/ক্লিনিকে ভর্তি থাকলে রোগী ওই ডাক্তারের আর দেখাই পাবেন না, কালেভদ্রে তাঁর জুনিয়র কলিগ বা ছাত্ররা এসে রোগীকে এক নজর দেখে যাবেন। রোগীর মনে হবে, তিনি কাঙাল, টাকা দিয়ে চিকিৎসা কিনতে আসেননি, করুণা ভিক্ষা করতে এসেছেন। তখন তাঁর মনে হবে, ডাক্তার মানুষ না, টাকা বানানোর যন্ত্র। তিনি বলে বেড়াবেন, ‘টাকা দিয়েও চিকিৎসা পাবেন না, এমন জায়গা আমি আপনাকে দেখাতে পারি।’ (এক পাঠকের মন্তব্য)।
সরকারের বেতনভুক চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের চেয়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখায় বেশি আগ্রহী; হাসপাতালের পদ-পদবি তিনি ব্যবহার করেন প্রাইভেট প্র্যাকটিসের পক্ষে সহায়ক ‘সাইনবোর্ড’ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক সম্পর্কে এমন গুরুতর কিছু অভিযোগ শুনেছি, যা ফৌজদারি অপরাধের শামিল।
ঢাকায় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট ফি ৭০০-৮০০ টাকা, গ্রামাঞ্চলে ৪০০-৫০০ টাকা। মানুষ মনে করে, এটা ‘গলাকাটা ফি’। এত টাকা কেন নেওয়া হয়? কে নির্ধারণ করে দিয়েছে ৮০০ টাকা বা ৫০০ টাকা ভিজিট ফি? আর সেটা রাতারাতি ৫০০ টাকা থেকে এক লাফে ৮০০ টাকায় উঠলে কিছু বলার বা করার কেউ কি আছে? তা ছাড়া, চিকিৎসকেরা কি ভিজিটের টাকা নিয়ে রোগীকে রসিদ দেন? যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে বসে এক সন্ধ্যায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন রোগী দেখেন, তাঁর দৈনিক আয় কত? তিনি আয়কর বিভাগকে কী হিসাব দেন?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কক্সবাজার সদর হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ডাক্তাররা অমানুষ, গরিবের রক্তচোষা’। এতে চিকিৎসক সমাজের পক্ষ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হলে মিজানুর রহমান প্রথম আলোয় ‘আমার মন্তব্য দেশের সব চিকিৎসক সম্পর্কে নয়’ শিরোনামে একটা লেখা প্রকাশ করেছেন (৯ মার্চ)। সে লেখায় তিনি বলেছেন, ‘বক্তব্যে কোনো চিকিৎসক আহত হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত’। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে তাঁর এই লেখার পাঠক-প্রতিক্রিয়ায় অনেক পাঠক লিখেছেন, তাঁর দুঃখ প্রকাশের প্রয়োজন ছিল না, কারণ তিনি ভুল বা অন্যায় কিছু বলেননি। এমনকি কেউ কেউ লিখেছেন, তিনি যেন তাঁর ওই বক্তব্য থেকে বিচ্যুত না হন। এর আগে ৬ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ লিখেছিলেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চিকিৎসকদের সমালোচনা করতে গিয়ে ‘যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন’। অনলাইন সংস্করণে ওই লেখার পাঠক-প্রতিক্রিয়াগুলোর অধিকাংশই মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যকে সমর্থন করে, এমনকি কোনো কোনো পাঠক আরও কঠোর ভাষা ব্যবহার করে চিকিৎসকদের সমালোচনা করেছেন। চিকিৎসকদের সম্পর্কে ‘কসাই’, ‘ডাকাত’ ইত্যাদি কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন কেউ কেউ। ডা. আবদুল্লাহর বক্তব্যকে সমর্থন করে যাঁরা প্রতিক্রিয়া লিখেছেন, তাঁদের অধিকাংশই চিকিৎসক বা চিকিৎসা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। চিকিৎসক সমাজের সদস্যরা ছাড়া অবশিষ্ট জনগণ চিকিৎসকদের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে—তার একটা মোটা দাগের চিত্র পাওয়া যায় ডা. আবদুল্লাহর ও মিজানুর রহমানের ওই দুটি লেখার পাঠক প্রতিক্রিয়াগুলো থেকে।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যদি তাঁর মন্তব্যের সঙ্গে ‘এক শ্রেণীর ডাক্তার’ বা ‘ডাক্তারের একাংশ’ বা ‘ডাক্তারদের কেউ কেউ’ শব্দবন্ধ জুড়ে দিতেন, তাহলে এ নিয়ে কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হতো না, চিকিৎসক সমাজও এতটা ক্ষুব্ধ হতেন না। সে রকম বলাই তাঁর উচিত ছিল। কিন্তু ‘আবেগতাড়িত হয়ে’ উক্তিটি করার সময় কূটনৈতিক ভব্যতার বিষয়টি তাঁর মাথায় আসেনি বলে তিনি বিরাট বড় অন্যায় করে ফেলেছেন তা-ও বলা ঠিক হবে না। কোনো জনগাষ্ঠীর সুখ্যাতি বা কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ওই গোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য বা আচরণের কারণে। ‘বাংলাদেশের মানুষ গরিব’—এমন কথা বললে এটা বোঝায় না যে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষই গরিব, একজনও ধনী লোক নেই। বা লোকে যখন বলে ‘ব্রিটিশ পুলিশ ভালো’—তখন এটা বোঝায় না যে ব্রিটিশ পুলিশের প্রত্যকটি সদস্যই ভালো। আমাদের চিকিৎসকদের কত শতাংশ ‘অমানুষ’ ও ‘রক্তচোষা’র মতো ব্যবহার করলে চিকিৎসকেরা অমানুষ ও রক্তচোষা, এমন কথা বলা অন্যায় হবে না?
ডা. আবদুল্লাহ ক্ষুব্ধ সুরে লিখেছেন, ‘রোগীরা কি মানবাধিকার কমিশনে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নেবেন?’ একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকের এই কথায় যে অচিকিৎসকসুলভ চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটে, তা বিস্ময়কর ও মর্মান্তিক। ডা. দেবপ্রসাদ অধিকারী নামের এক চিকিৎসক-পাঠকের মন্তব্যেও একই মানসিকতার প্রকাশ: ‘ঈশ্বর না করুন, রাত তিনটায় চেয়ারম্যান সাহেব অসুস্থ হলে তাঁকে কিন্তু কোনো রক্তচোষার কাছেই দৌড়াতে হবে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে অমানুষদের কাছে দৌড়ানো শোভা পায় না।’ মনে প্রশ্ন জাগছে: মানবাধিকার সম্পর্কে, চিকিৎসক পেশার নৈতিক স্বরূপ সম্পর্কে এ রকম চিন্তাধারাই কি চিকিৎসকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে? ডা. আবদুল্লাহর লেখাটির প্রতিক্রিয়ায় আরেক পাঠক লিখেছেন, ‘চিকিৎসক পেশার সাথে অন্য পেশার যে বিশাল তফাৎ তা তো এই লোক নিজেই বোঝে না—ছাত্রদের কি ছাই বোঝাবে?’
অধিকাংশ পাঠকের মতে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান জনগণের মনের কথাই বলেছেন—এটাই আসলে বিবেচনার মূল বিষয়। চিকিৎসকেরা এখন নিজেদের মনকেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘জনসাধারণ আমাদের অমানুষ ও রক্তচোষা মনে করে কেন?’
এই আত্মজিজ্ঞাসা খুব জরুরি, কারণ সমাজে চিকিৎসক পেশার মর্যাদা, অনেকে বলেন, সৃষ্টিকর্তার পরেই: মানুষের প্রাণ ও সুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকের কাজ। চিকিৎসকদের সঙ্গে সমাজের আর কোনো পেশাজীবী গোষ্ঠীরই তুলনা চলে না। চিকিৎসকের ঘুম নেই, খাওয়ার সময় নেই, স্ত্রী-সন্তানদের জন্য সময় নেই। কারণ মানুষের জীবন বাঁচানো এসবের চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব জেনে-বুঝেই একজন মেধাবী শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি চিকিৎসক হবেন। মানুষের এই ধারণা ও প্রত্যাশা কী মাত্রায় আঘাত পেলে চিকিৎসকদের সম্পর্কে অমানুষ, গরিবের রক্তচোষা, কসাই, ডাকাত ইত্যাদি শব্দ তারা ব্যবহার করতে পারে—এই জিজ্ঞাসা চিকিৎসকদের মনে জাগা উচিত।
চিকিৎসকদের মধ্যে যাঁরা সৎ ও মানবিক, যাঁরা চিকিৎসা পেশার প্রকৃত নৈতিক স্বরূপ আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেন, আমার বিশ্বাস, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মন্তব্যে তাঁরা ক্ষুব্ধ হননি। কারণ, তাঁরা জানেন, মন্তব্যটি তাঁদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এক পরিচিত চিকিৎসক আমাকে টেলিফোন করে বললেন, ‘মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ পৌঁছে দেবেন; তাঁর এই মন্তব্যে যদি অমানুষ ও রক্তচোষাদের একটুখানি হলেও টনক নড়ে।’
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
No comments