প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে হাইতি ধ্বংসস্তূপে পরিণতঃ সতর্কতা দরকার আমাদেরও
স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র হাইতি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভূমিকম্পের ফলে দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ায় সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, মৃতের সংখ্যা এক লাখের বেশি ছাড়া কম হবে না।
কয়েক বছর আগে সুনামির নিষ্ঠুর ছোবলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খণ্ড প্রলয় ঘটে গিয়েছিল। ওই ঘটনার পর হাইতির ভূমিকম্পে ঘটল সবচেয়ে মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় অপরাহপ্ত ৪টা ৫৩ মিনিটে রিখটার স্কেলের মাপ অনুযায়ী ৭ দশমিক ৩ মাত্রার এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হাইতিতে আঘাত হানে। ভূকম্পনের কেন্দ্রস্থল ছিল হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সের মাত্র ১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে। এই ভূমিকম্পে ২৫ লাখ বাসিন্দা অধ্যুষিত পোর্ট অব প্রিন্স পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। হাইতির জনসংখ্যা ১ কোটির কিছু বেশি। এর মধ্যে এক লাখের বেশি লোকের মৃত্যু ঘটার অর্থ হচ্ছে ভূমিকম্পের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছে দেশটির এক শতাংশের বেশি মানুষ। প্রেসিডেন্টের সরকারি ভবন বিধ্বস্ত হওয়ায় প্রথমে আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, হাইতির প্রেসিডেন্ট রেনে প্রেভাল বিধ্বস্ত ভবনের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন। পরে এ আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। তিনি সস্ত্রীক বেঁচে গেছেন। রক্ষা পেয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী জাঁ ম্যাক্স বলেলিভ। উভয়ে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতিকে অকল্পনীয় আখ্যা দিয়ে দ্রুত আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।
রাজধানীর কয়েক হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে না বলে কোনো বাড়িই অক্ষত নেই বললে সেটাই সত্যের অনেক কাছাকাছি হয়। প্রেসিডেন্টের ভবন ছাড়াও পার্লামেন্ট ভবন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভবন, গির্জা, হাসপাতাল, জাতিসংঘের কার্যালয় ও বেশ কয়েকটি দূতাবাস ভবন একেবারে ভূপাতিত। জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার দায়িত্ব পালনকারী অনেকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানকার জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের প্রধান তিউনিশিয়ার হেজি আন্নাবিসহ জাতিসংঘের আরও ১৪ জনের মতো কর্মী নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত ৬ বাংলাদেশী পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে সর্বশেষ খবর অনুসারে ২ জন এখনও নিখোঁজ। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ বহু দেশ হাইতিতে সাহায্য পাঠানোর কথা বলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন। ভূমিকম্প-দুর্গতদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন আমাদের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। এসব আশ্বাসবাণী ও সহমর্মিতার ফল কত দ্রুত হাইতিতে গিয়ে পৌঁছে, সেটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হাইতি গরিব দেশ, তদুপরি গৃহযুদ্ধজনিত অশান্তি দীর্ঘদিন ধরে দেশটিকে পীড়িত করে রেখেছে। ক্যারিবীয় অঞ্চল সৃষ্ট হ্যারিকেন প্রায় প্রতি বছরই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে আঘাত হানে। তাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত বিপর্যয় ও মনুষ্যসৃষ্ট অরাজকতা দুটোই হাইতিবাসীর কাছে পরিচিত। কিন্তু এবার যা ঘটে গেল তার সঙ্গে ওই সবের তুলনা চলে না। একটা দেশের রাজধানী যদি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়, তখন সেখানকার মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিতে সেখানে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে উদ্ধারকর্মী, চিকিত্সকসহ ব্যাপক ত্রাণ সাহায্য পাঠানো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি দায়িত্ব।
পৃথিবী নামক গ্রহটাকে আমরা যতটা নিরাপদ মনে করি, বাস্তবতা যে তার চেয়ে ভিন্ন, হাইতির ভূমিকম্প আবার সেটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বাংলাদেশের অস্থান বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায়। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের আশঙ্কা ব্যক্ত করে আসছেন কয়েক বছর ধরে। আড়াই বছর আগে এই উপমহাদেশের পশ্চিমাংশে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে এবং পাকিস্তানের উত্তরাংশে ভূমিকম্প যে তাণ্ডবলীলা চালিয়েছিল তা এখনও অনেকের মনে থাকার কথা। ভূগর্ভস্থ স্তরবিচ্যুতি অথবা সংঘর্ষে ঢাকা যদি ভীষণভাবে কেঁপে ওঠে, তবে মানবিক বিপর্যয় অকল্পনীয় চেহারা নিতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা ভূমিকম্পের বিপদ সম্পর্কে একেবারে উদাসীন। ভূমিকম্পের আগাম বার্তা জানানো সম্ভব না হলেও পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে এবং ভূমিকম্প সহনীয় বাড়িঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুললে এ বিপর্যয় যে অনেকখানি কমানো যায়, ‘ভূমিকম্পের দেশ’ জাপান তা হাতে-কলমে করে দেখিয়েছে। তাই সেদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের তুলনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ একেবারেই কম। এর বিপরীতে ভূমিকম্প সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা ও পূর্বপ্রস্তুতি নেই বললেই চলে। এ অস্থায় বড় ধরনের ভূমিকম্প আমাদের দেশে আঘাত হানলে তার পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। তাই আর কালক্ষেপণ না করে এখনই সক্রিয় সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে সম্ভাব্য বিপদ কিছুটা হলেও কমবে।
No comments