কে এফ রুস্তামজির চোখে ১৯৭১-‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার দরকার নেই’ by সোহরাব হাসান
চতুর্থ পর্ব একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা যে বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল, খ্যাতনামা সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন রুস্তামজির লেখায় তাও ফুটে উঠেছে। বিদেশি সাংবাদিকেরা যেন বাংলাদেশের ভেতরে গিয়ে ঘটনাপ্রবাহ দেখতে পারেন, আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, সে ব্যবস্থাও তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা করে দিয়েছিলেন।
রুস্তামজি লিখেছেন, শিল্প ও সংগীতের বহু খ্যাতনামা মানুষ লন্ডন ও প্যারিসের রাজপথে নেমে আসেন। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও স্পেনের গৃহযুদ্ধের বীর আন্দ্রে মারলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা রক্ষার জন্য লড়াই করছে না, লড়াই করছে তার অস্তিত্ব রক্ষার্থে।’ গীতিকার জোয়ান বায়েজ বাংলাদেশের পক্ষে গান গেয়েছেন।
বিএসএফ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সহায়তা করায় তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার-নির্যাতনের পাশাপাশি রণাঙ্গনের খবর পাঠাতে সক্ষম হন। এই বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন পিটার হাজেল হার্সট, ক্লারা হলিংওর্থ সিডনি, এইচ শানবার্গ, জেমস ক্যামেরন এবং আরও অনেকে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে কে এফ রুস্তামজি লিখেছেন, ‘তারা মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে গিয়ে নিজেরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, সেনানিবাসের বাইরে বের হতে ভয় পেত।’ মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অভিযান তাদের মধ্যে এই ভীতি আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাতে পাকিস্তানি সেনারা নিবৃত্ত না হয়ে আরও নির্দয় হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সেনাসদস্যরা অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করে। প্রথমে তারা গ্রামবাসীকে কোনো সেতু বা কালভার্ট পাহারা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী যখন সেই সেতু বা কালভার্ট উড়িয়ে দেয়, তখন সেনাবাহিনী গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসব ঘটনার উল্লেখ করে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘এর পর থেকে গ্রামবাসী নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মুক্তিবাহিনী এড়িয়ে চলে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে মুক্তিবাহিনীকে কোথাও অপারেশন চালাতেও নিষেধ করে। বিমান হামলা শুরু হলে গ্রামবাসীও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। কোথাও সেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হলে গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।’
কোথাও কোথাও এ রকম ঘটলেও রুস্তামজির এই পর্যবেক্ষণ পুরো সত্য নয়। সেই অনিশ্চিত পরিবেশে মানুষ নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে সহায়তা করেছে, আশ্রয় দিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দুই পরাশক্তির বিপরীতমুখী ভূমিকা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষ নেয়। মার্কিন ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে যাঁরা তখন কলকাতায় ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত। অন্যদিকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা কতিপয় আওয়ামী লীগের নেতা, বিশেষ করে খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে চীনাপন্থীদের যোগাযোগ ছিল।’
একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করলেও তাঁদের মত ও পথের ভিন্নতা ছিল। সেই ভিন্নতা মাঝেমধ্যে পরিস্থিতিকে এতটা নাজুক করে দেয় যে যুদ্ধ পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়ে। রুস্তামজি লিখেছেন, ‘মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মুজিব বাহিনী নামে আরেকটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই। এই গ্রুপটি গড়ে ওঠে ভারতের বামপন্থী(!) নেতাদের সহায়তায় ও গোয়েন্দা সংস্থার অর্থে।’ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পিএন হাকসার ভিন্ন গ্রুপ রাখার পক্ষে যুক্তি দেখান, ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার দরকার নেই।’
অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্র ও ভাতাধারী মুজিব বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় কর্নেল ওসমানী ক্ষুব্ধ হন এবং আবারও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। গোলক মজুমদার বিষয়টি রুস্তামজিকে জানালে তিনি হস্তক্ষেপ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান মানেকশ কলকাতায় এলে গোলক মজুমদার তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এরপর মানেকশ ওসমানীকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে রাজি করান।
এরপর আমরা রুস্তামজির বর্ণনায় পাই, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে ভারতের তিন বাহিনীর প্রধানই মনে করেন, অভিযানের জন্য তাঁদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে তাঁরা জানতেন না প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব কী এবং তিনি কখন সবুজসংকেত দেবেন। প্রধানমন্ত্রী ৩১ আগস্ট শিলিগুড়িতে সেনাবাহিনীর দপ্তরে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এ এল দায়াজ, তাঁর উপদেষ্টা সিদ্ধার্থ শংকর রায়। এরপর প্রধানমন্ত্রী কোচবিহারে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যান। স্বরাষ্ট্রসচিব গোবিন্দ নারায়ণ শিবিরটি একটি বড় নালার অপর পাড়ে বলে প্রধানমন্ত্রীকে নিবৃত্ত করতে চাইছিলেন। তা ছাড়া সে সময় বৃষ্টি পড়ছিল। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আমার কাছে রেইনকোট ও ছাতা আছে।’ বাঁশের সাঁকোতে তিনি নালা পার হন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গেলে তারা তাঁর কাছে কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরেন এবং তিনিও সেগুলো পূরণের আশ্বাস দেন।
নভেম্বরের শুরুতে বিমানবাহিনীর প্রধান মার্শাল পিসি লাল কলকাতা আসেন এবং আইজি, বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদারের সঙ্গে দেখা করে বিএসএফ যাতে পাকিস্তানি বিমানের অবস্থান নির্ণয় করতে পারে, সে ব্যাপারে কী ধরনের সহযোগিতা বিমানবাহিনী করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেন। (চলবে)
বিএসএফ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সহায়তা করায় তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার-নির্যাতনের পাশাপাশি রণাঙ্গনের খবর পাঠাতে সক্ষম হন। এই বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন পিটার হাজেল হার্সট, ক্লারা হলিংওর্থ সিডনি, এইচ শানবার্গ, জেমস ক্যামেরন এবং আরও অনেকে।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে কে এফ রুস্তামজি লিখেছেন, ‘তারা মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে গিয়ে নিজেরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, সেনানিবাসের বাইরে বের হতে ভয় পেত।’ মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অভিযান তাদের মধ্যে এই ভীতি আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তাতে পাকিস্তানি সেনারা নিবৃত্ত না হয়ে আরও নির্দয় হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে সেনাসদস্যরা অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করে। প্রথমে তারা গ্রামবাসীকে কোনো সেতু বা কালভার্ট পাহারা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী যখন সেই সেতু বা কালভার্ট উড়িয়ে দেয়, তখন সেনাবাহিনী গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসব ঘটনার উল্লেখ করে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘এর পর থেকে গ্রামবাসী নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মুক্তিবাহিনী এড়িয়ে চলে। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে মুক্তিবাহিনীকে কোথাও অপারেশন চালাতেও নিষেধ করে। বিমান হামলা শুরু হলে গ্রামবাসীও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা বন্ধ করে দেয়। কোথাও সেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হলে গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।’
কোথাও কোথাও এ রকম ঘটলেও রুস্তামজির এই পর্যবেক্ষণ পুরো সত্য নয়। সেই অনিশ্চিত পরিবেশে মানুষ নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে সহায়তা করেছে, আশ্রয় দিয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দুই পরাশক্তির বিপরীতমুখী ভূমিকা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষ নেয়। মার্কিন ও সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে রুস্তামজি লিখেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে যাঁরা তখন কলকাতায় ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত। অন্যদিকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা কতিপয় আওয়ামী লীগের নেতা, বিশেষ করে খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে চীনাপন্থীদের যোগাযোগ ছিল।’
একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করলেও তাঁদের মত ও পথের ভিন্নতা ছিল। সেই ভিন্নতা মাঝেমধ্যে পরিস্থিতিকে এতটা নাজুক করে দেয় যে যুদ্ধ পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়ে। রুস্তামজি লিখেছেন, ‘মুক্তিবাহিনীর মধ্যে মুজিব বাহিনী নামে আরেকটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই। এই গ্রুপটি গড়ে ওঠে ভারতের বামপন্থী(!) নেতাদের সহায়তায় ও গোয়েন্দা সংস্থার অর্থে।’ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পিএন হাকসার ভিন্ন গ্রুপ রাখার পক্ষে যুক্তি দেখান, ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার দরকার নেই।’
অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্র ও ভাতাধারী মুজিব বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় কর্নেল ওসমানী ক্ষুব্ধ হন এবং আবারও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। গোলক মজুমদার বিষয়টি রুস্তামজিকে জানালে তিনি হস্তক্ষেপ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান মানেকশ কলকাতায় এলে গোলক মজুমদার তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এরপর মানেকশ ওসমানীকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ও মুক্তিবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে রাজি করান।
এরপর আমরা রুস্তামজির বর্ণনায় পাই, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে ভারতের তিন বাহিনীর প্রধানই মনে করেন, অভিযানের জন্য তাঁদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে তাঁরা জানতেন না প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব কী এবং তিনি কখন সবুজসংকেত দেবেন। প্রধানমন্ত্রী ৩১ আগস্ট শিলিগুড়িতে সেনাবাহিনীর দপ্তরে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এ এল দায়াজ, তাঁর উপদেষ্টা সিদ্ধার্থ শংকর রায়। এরপর প্রধানমন্ত্রী কোচবিহারে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যান। স্বরাষ্ট্রসচিব গোবিন্দ নারায়ণ শিবিরটি একটি বড় নালার অপর পাড়ে বলে প্রধানমন্ত্রীকে নিবৃত্ত করতে চাইছিলেন। তা ছাড়া সে সময় বৃষ্টি পড়ছিল। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আমার কাছে রেইনকোট ও ছাতা আছে।’ বাঁশের সাঁকোতে তিনি নালা পার হন। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গেলে তারা তাঁর কাছে কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরেন এবং তিনিও সেগুলো পূরণের আশ্বাস দেন।
নভেম্বরের শুরুতে বিমানবাহিনীর প্রধান মার্শাল পিসি লাল কলকাতা আসেন এবং আইজি, বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গোলক মজুমদারের সঙ্গে দেখা করে বিএসএফ যাতে পাকিস্তানি বিমানের অবস্থান নির্ণয় করতে পারে, সে ব্যাপারে কী ধরনের সহযোগিতা বিমানবাহিনী করতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করেন। (চলবে)
No comments