শেকড়ের ডাক-রেলওয়ে নিয়ে এ ষড়যন্ত্র কেন? by ফরহাদ মাহমুদ
১৯৮২ সালের পর এবারই প্রথম লাভের মুখ দেখেছে বাংলাদেশের পাটকলগুলো। দেশের জন্য এটি অনেক বড় সুসংবাদ। কারণ লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে অতীতে এ দেশের পাটশিল্পকে প্রায় ধ্বংস করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর পর দেশে ৭৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল চালু ছিল।
২০০৬ সালে সেই সংখ্যা নেমে এসেছিল দেড় ডজনে, তাও ছোটখাটো কিছু পাটকল নিয়ে। এই সরকার ক্ষমতায় এসে বন্ধ থাকা সাতটি পাটকল নতুন করে চালু করে এবং এ শিল্পের উন্নয়নে মনোযোগী হয়। ফলে শিল্পটি আবার লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু এ সরকার রেলওয়ের ব্যাপারেও বেশ কিছু আশ্বাস দিয়েছিল, যেগুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে মুখ থুবড়ে পড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে এখনো আগের অবস্থায়ই রয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে যতটা না অবহেলা-অযত্ন দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র শুরু হয় সত্তরের দশকের শেষদিক থেকেই। স্বাধীনতার আগে তো বটেই, স্বাধীনতার পরও কিছুদিন পর্যন্ত এ দেশের রেলওয়ে কারখানায় বগি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষদিকে স্থানীয়ভাবে বগি তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকিস্তান থেকে প্রচুর বগি আমদানি করা হয়। অনেকের মতে, সেগুলোর মান ছিল এখানে তৈরি বগির চেয়েও খারাপ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দেশে যে লোকসংখ্যা ছিল, এখন সে লোকসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। সড়কপথ বেড়েছে কয়েক গুণ। অথচ মোট রেলপথ কমেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রেললাইন ক্রমেই ট্রেন চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক লাইনে ঠিকমতো স্লিপার নেই, পাথর নেই। স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশের খাদ্যগুদাম বা সাইলোগুলোতে রেল যোগাযোগ ছিল, সেই রেল যোগাযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসবই বাংলাদেশ রেলওয়েকে ধ্বংস করার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। কারণ সড়কপথ বাড়লে যে পরিমাণ গাড়ি বিক্রি করা যায়, যে পরিমাণ লাভ করা যায়, রেলপথ থেকে তা পাওয়া যায় না। তাই উন্নত দেশগুলো রেলওয়ের উন্নয়নে তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না। আমাদের সরকারগুলোও উন্নত দেশের আর্থিক সংস্থাগুলোর দাসত্ব এমনভাবে স্বীকার করে নেয় যে দেশের প্রয়োজন তাদের মাথায় খুব একটা আসে না। আবার বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা এ দেশে এমন কিছু 'অতিপণ্ডিত' তৈরি করে রেখেছে, যাদের কাজ হলো, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাওয়া। এদেরই পরামর্শে সারা দেশে প্রায় পৌনে তিন শত কিলোমিটার রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রেলওয়ে সূত্রমতে, আশির দশকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নরসিংদী-মদনগঞ্জ রুট। নব্বইয়ের দশকে পূর্বাঞ্চলের ফেনী-বিলোনিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ-শাল্লা, হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ; পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট-মোগলহাট, রূপসা-বাগেরহাট, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া, ভেড়ামারা-রায়টা ও পাঁচুরিয়া-পুকুরিয়া পথে রেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর কেবল সিরাজগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ তৈরি করা হয়েছে। এটিও যমুনার ওপর সেতু নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল না। পরবর্তীকালে সেখানে রেলপথ কিভাবে যুক্ত হয়েছে এবং তা যোগ করতে কতটা বেগ পেতে হয়েছে, তা অনেকেই জানেন অথবা জানার চেষ্টা করতে পারেন।
১৮৭০ সালে ব্রিটিশরা এ দেশেও কিছু রেল কারখানা বানিয়েছিল, যেগুলোতে তখন রেলগাড়ির ইঞ্জিনও তৈরি হতো। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলেও এখানে রেলগাড়ির বগি তৈরি হয়েছে। ১৯৬৭-৬৮ অর্থবছরে এখানে ২৬৪টি বগি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তাহলে এখন কেন আমরা বগি বানাতে পারব না? বর্তমানে বিদেশ থেকে একটি বগি আমদানিতে খরচ হয় প্রায় চার কোটি টাকা। অথচ রেলওয়ের সূত্রমতে, সৈয়দপুরে মাত্র ৮০ লাখ টাকায় বগি নির্মাণ করা সম্ভব। পাশাপাশি এখানে বগি তৈরি হলে দেশের বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু অতীতের সরকারগুলো তা করেনি। এমনকি ছাতকের কংক্রিট স্লিপার ফ্যাক্টরিতেও উপযুক্ত পরিমাণে স্লিপার বানানো হচ্ছে না। প্রতিদিন এক হাজার ৬০০ স্লিপার তৈরির ক্ষমতা থাকলেও এখানে মাসে তিন-চার হাজারের বেশি স্লিপার তৈরি হয় না। অথচ বিদেশ থেকে স্লিপার আমদানি করা হয়।
এক হিসাবে দেখা যায়, রেলের চেয়ে সড়কপথে যাত্রীপ্রতি জ্বালানি খরচ ৩ দশমিক ৫ গুণ বেশি এবং একই পরিমাণ মালামাল পরিবহনে ৮ দশমিক ৭ গুণ বেশি। তা সত্ত্বেও আমরা রেলকে পঙ্গু করে দিচ্ছি কেন? ১৯৬৯-৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি, আর ২০০০-০১ সালে ছিল ২৭৭টি, যার মধ্যে ১৫৫টি ইঞ্জিনেরই বয়স ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। সাধারণত একটি ইঞ্জিনের ইকোনমিক লাইফ বা সাশ্রয়ী আয়ু ধরা হয় ২০ বছর। একইভাবে কমেছে বগির সংখ্যাও। কমেছে রেলকর্মী ও স্টেশনের সংখ্যা। ১৯৬৯-৭০ সালে রেলে কর্মকর্তা ছিল ২১০ এবং কর্মচারী ছিল ৫৫ হাজার ২০৩ জন। ২০০০-০১ সালে কর্মকর্তা বেড়ে হয়েছে ৫০৪ জন, কিন্তু কর্মচারীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৯৯ জনে। বর্তমানে সে সংখ্যা আরো কমেছে। স্টেশনগুলোর মধ্যে ইন্টারলকিং ব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানাটি যথেষ্ট আধুনিক একটি কারখানা। বলা যায়, এই কারখানাটির বদৌলতেই এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনগুলো কোনো রকমে চালু রাখা সম্ভব হয়েছে। এখানে যে ধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা রয়েছে, তাতে কেবল যন্ত্রাংশ আমদানি করে নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করাও সম্ভব। তাতে খরচও অনেক কম পড়ত। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সরকারই সে উদ্যোগ নেয়নি। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিমাতার আচরণ। স্বাধীনতার পরও যেখানে সড়ক ও রেলপথে বাজেট বরাদ্দ ছিল প্রায় সমান সমান, সেখানে ২০০২ থেকে শুরু করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যে বরাদ্দচিত্র পাওয়া যায়, তাতে রেলের অংশ ছিল মাত্র ১২ শতাংশ এবং সড়ক খাতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ শতাংশ। এসব কারণে রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন মেরামতের জন্য যে ছয়টি কারখানা রয়েছে, তার কোনোটিই সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।
সংস্কারের অভাবে দেশের অধিকাংশ রেল লাইন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে এসেছে। ফলে ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে হয়। পুরনো ইঞ্জিন প্রায়ই রাস্তায় বিকল হয়ে পড়ে। তার পরও কেবল ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ৭৯০ বার। বরাদ্দের অপ্রতুলতার কারণে সময়মতো কোচ বা ওয়াগনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও নবায়ন করা যায় না। ফলে যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এসব কারণে যাত্রীরা রেলপথে চলাচলের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সময় সময় কিছু উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে চলে নানা রকম গড়িমসি, যেখানে আমলারা একটি বড় ভূমিকা পালন করেন। টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত দুই লাইন করার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০১১ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এ রকম বহু প্রকল্প প্রতিনিয়ত নেওয়া হচ্ছে এবং একসময় মারাও যাচ্ছে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। কেবল সংস্কারের অভাবে এ পথে এখন ট্রেন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। হেঁটে চলার মতো গতিতে ট্রেন চালাতে হয়। এতে সময় বেশি লাগে বলে যাত্রীরা ট্রেন ছেড়ে বাসমুখী হয়ে পড়েছে। যে কয়টি ট্রেন চলাচল করে, সেগুলো একরকম ফাঁকাই আসা-যাওয়া করে। অথচ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-ভৈরব রেলপথ সংস্কার ও ডাবল লাইন করে প্রতিঘণ্টায় ট্রেন চালানো হলে প্রচুর লোক এসব জায়গা থেকে ঢাকায় এসে অফিস করতে পারত। এতে ঢাকার ওপর জনসংখ্যা ও যানবাহনের যে চাপ, তাও অনেকটাই কমে যেত।
রেলওয়ের ভূসম্পত্তি নিয়েও চলছে নানা ধরনের তেলেসমাতি। জোট সরকারের আমলে যোগাযোগমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে রেলের জমি লিজ দেওয়া নিয়ে গণমাধ্যমে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছিল। এর আগেও বিভিন্ন সরকারের সময় এ অপকর্মটি বেশ ভালোভাবেই সম্পাদন করা হয়েছে। এ ছাড়া অবৈধ দখল তো আছেই। আমাদের জানা মতে, এসব জমি উদ্ধারে সর্বশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন অবৈধ দখলে থাকা তিন শতাধিক একর ভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। এখনো রেলওয়ের দুই হাজার একরের বেশি জমি অপদখলে আছে বলে জানা যায়।
সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা হিসেবে উন্নত দেশগুলোতেও আজ রেলপথ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আর আমরা চলছি উল্টোপথে। বসবাসযোগ্যতা হারানোর দিক থেকে বিশ্বে ঢাকা আজ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ হাজার লোক মারা যাচ্ছে। অথচ অফুরন্ত সড়ক-যানের কারণে বায়ুদূষণ ক্রমে বেড়েই চলেছে। রেলের প্রসঙ্গ উঠলেই মন্ত্রী, আমলা ও পরিকল্পনাবিদরা আকাশরেল, পাতালরেল, সুপারসনিক ট্রেনের গল্প শুনিয়ে দেন। এসবেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কেবল গল্প শুনতে শুনতে এই গল্পের প্রতি সবারই বিরক্তি এসে গেছে। তাই বর্তমান সরকারের প্রতি অনুরোধ, আকাশ-পাতাল রেখে আপাতত মাটির ওপর যে রেলপথটুকু আছে সেটিকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করুন, বন্ধ রেলপথগুলো চালু করুন, কিছু নতুন ইঞ্জিন দিয়ে রেলওয়েকে আবার গতিশীল করুন। গণমানুষের এই পরিবহনব্যবস্থাটিতে আবার প্রাণের সঞ্চার হোক_এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক
বাংলাদেশ রেলওয়ের এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে যতটা না অবহেলা-অযত্ন দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র শুরু হয় সত্তরের দশকের শেষদিক থেকেই। স্বাধীনতার আগে তো বটেই, স্বাধীনতার পরও কিছুদিন পর্যন্ত এ দেশের রেলওয়ে কারখানায় বগি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষদিকে স্থানীয়ভাবে বগি তৈরি বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকিস্তান থেকে প্রচুর বগি আমদানি করা হয়। অনেকের মতে, সেগুলোর মান ছিল এখানে তৈরি বগির চেয়েও খারাপ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দেশে যে লোকসংখ্যা ছিল, এখন সে লোকসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। সড়কপথ বেড়েছে কয়েক গুণ। অথচ মোট রেলপথ কমেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রেললাইন ক্রমেই ট্রেন চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক লাইনে ঠিকমতো স্লিপার নেই, পাথর নেই। স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশের খাদ্যগুদাম বা সাইলোগুলোতে রেল যোগাযোগ ছিল, সেই রেল যোগাযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসবই বাংলাদেশ রেলওয়েকে ধ্বংস করার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। কারণ সড়কপথ বাড়লে যে পরিমাণ গাড়ি বিক্রি করা যায়, যে পরিমাণ লাভ করা যায়, রেলপথ থেকে তা পাওয়া যায় না। তাই উন্নত দেশগুলো রেলওয়ের উন্নয়নে তেমন একটা আগ্রহ দেখায় না। আমাদের সরকারগুলোও উন্নত দেশের আর্থিক সংস্থাগুলোর দাসত্ব এমনভাবে স্বীকার করে নেয় যে দেশের প্রয়োজন তাদের মাথায় খুব একটা আসে না। আবার বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা এ দেশে এমন কিছু 'অতিপণ্ডিত' তৈরি করে রেখেছে, যাদের কাজ হলো, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাওয়া। এদেরই পরামর্শে সারা দেশে প্রায় পৌনে তিন শত কিলোমিটার রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রেলওয়ে সূত্রমতে, আশির দশকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নরসিংদী-মদনগঞ্জ রুট। নব্বইয়ের দশকে পূর্বাঞ্চলের ফেনী-বিলোনিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ-শাল্লা, হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ; পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট-মোগলহাট, রূপসা-বাগেরহাট, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া, ভেড়ামারা-রায়টা ও পাঁচুরিয়া-পুকুরিয়া পথে রেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর কেবল সিরাজগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার নতুন রেলপথ তৈরি করা হয়েছে। এটিও যমুনার ওপর সেতু নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনায় ছিল না। পরবর্তীকালে সেখানে রেলপথ কিভাবে যুক্ত হয়েছে এবং তা যোগ করতে কতটা বেগ পেতে হয়েছে, তা অনেকেই জানেন অথবা জানার চেষ্টা করতে পারেন।
১৮৭০ সালে ব্রিটিশরা এ দেশেও কিছু রেল কারখানা বানিয়েছিল, যেগুলোতে তখন রেলগাড়ির ইঞ্জিনও তৈরি হতো। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলেও এখানে রেলগাড়ির বগি তৈরি হয়েছে। ১৯৬৭-৬৮ অর্থবছরে এখানে ২৬৪টি বগি নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তাহলে এখন কেন আমরা বগি বানাতে পারব না? বর্তমানে বিদেশ থেকে একটি বগি আমদানিতে খরচ হয় প্রায় চার কোটি টাকা। অথচ রেলওয়ের সূত্রমতে, সৈয়দপুরে মাত্র ৮০ লাখ টাকায় বগি নির্মাণ করা সম্ভব। পাশাপাশি এখানে বগি তৈরি হলে দেশের বহু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু অতীতের সরকারগুলো তা করেনি। এমনকি ছাতকের কংক্রিট স্লিপার ফ্যাক্টরিতেও উপযুক্ত পরিমাণে স্লিপার বানানো হচ্ছে না। প্রতিদিন এক হাজার ৬০০ স্লিপার তৈরির ক্ষমতা থাকলেও এখানে মাসে তিন-চার হাজারের বেশি স্লিপার তৈরি হয় না। অথচ বিদেশ থেকে স্লিপার আমদানি করা হয়।
এক হিসাবে দেখা যায়, রেলের চেয়ে সড়কপথে যাত্রীপ্রতি জ্বালানি খরচ ৩ দশমিক ৫ গুণ বেশি এবং একই পরিমাণ মালামাল পরিবহনে ৮ দশমিক ৭ গুণ বেশি। তা সত্ত্বেও আমরা রেলকে পঙ্গু করে দিচ্ছি কেন? ১৯৬৯-৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে লোকোমোটিভ ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি, আর ২০০০-০১ সালে ছিল ২৭৭টি, যার মধ্যে ১৫৫টি ইঞ্জিনেরই বয়স ৩৫ বছর পেরিয়ে গেছে। সাধারণত একটি ইঞ্জিনের ইকোনমিক লাইফ বা সাশ্রয়ী আয়ু ধরা হয় ২০ বছর। একইভাবে কমেছে বগির সংখ্যাও। কমেছে রেলকর্মী ও স্টেশনের সংখ্যা। ১৯৬৯-৭০ সালে রেলে কর্মকর্তা ছিল ২১০ এবং কর্মচারী ছিল ৫৫ হাজার ২০৩ জন। ২০০০-০১ সালে কর্মকর্তা বেড়ে হয়েছে ৫০৪ জন, কিন্তু কর্মচারীর সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৯৯ জনে। বর্তমানে সে সংখ্যা আরো কমেছে। স্টেশনগুলোর মধ্যে ইন্টারলকিং ব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
পার্বতীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানাটি যথেষ্ট আধুনিক একটি কারখানা। বলা যায়, এই কারখানাটির বদৌলতেই এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনগুলো কোনো রকমে চালু রাখা সম্ভব হয়েছে। এখানে যে ধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা রয়েছে, তাতে কেবল যন্ত্রাংশ আমদানি করে নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করাও সম্ভব। তাতে খরচও অনেক কম পড়ত। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সরকারই সে উদ্যোগ নেয়নি। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিমাতার আচরণ। স্বাধীনতার পরও যেখানে সড়ক ও রেলপথে বাজেট বরাদ্দ ছিল প্রায় সমান সমান, সেখানে ২০০২ থেকে শুরু করে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যে বরাদ্দচিত্র পাওয়া যায়, তাতে রেলের অংশ ছিল মাত্র ১২ শতাংশ এবং সড়ক খাতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ শতাংশ। এসব কারণে রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন মেরামতের জন্য যে ছয়টি কারখানা রয়েছে, তার কোনোটিই সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।
সংস্কারের অভাবে দেশের অধিকাংশ রেল লাইন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে এসেছে। ফলে ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে হয়। পুরনো ইঞ্জিন প্রায়ই রাস্তায় বিকল হয়ে পড়ে। তার পরও কেবল ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ৭৯০ বার। বরাদ্দের অপ্রতুলতার কারণে সময়মতো কোচ বা ওয়াগনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও নবায়ন করা যায় না। ফলে যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এসব কারণে যাত্রীরা রেলপথে চলাচলের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সময় সময় কিছু উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে চলে নানা রকম গড়িমসি, যেখানে আমলারা একটি বড় ভূমিকা পালন করেন। টঙ্গী থেকে ভৈরব পর্যন্ত দুই লাইন করার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০১১ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এ রকম বহু প্রকল্প প্রতিনিয়ত নেওয়া হচ্ছে এবং একসময় মারাও যাচ্ছে।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথটি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। কেবল সংস্কারের অভাবে এ পথে এখন ট্রেন চালানোই দায় হয়ে পড়েছে। হেঁটে চলার মতো গতিতে ট্রেন চালাতে হয়। এতে সময় বেশি লাগে বলে যাত্রীরা ট্রেন ছেড়ে বাসমুখী হয়ে পড়েছে। যে কয়টি ট্রেন চলাচল করে, সেগুলো একরকম ফাঁকাই আসা-যাওয়া করে। অথচ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-ভৈরব রেলপথ সংস্কার ও ডাবল লাইন করে প্রতিঘণ্টায় ট্রেন চালানো হলে প্রচুর লোক এসব জায়গা থেকে ঢাকায় এসে অফিস করতে পারত। এতে ঢাকার ওপর জনসংখ্যা ও যানবাহনের যে চাপ, তাও অনেকটাই কমে যেত।
রেলওয়ের ভূসম্পত্তি নিয়েও চলছে নানা ধরনের তেলেসমাতি। জোট সরকারের আমলে যোগাযোগমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে রেলের জমি লিজ দেওয়া নিয়ে গণমাধ্যমে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছিল। এর আগেও বিভিন্ন সরকারের সময় এ অপকর্মটি বেশ ভালোভাবেই সম্পাদন করা হয়েছে। এ ছাড়া অবৈধ দখল তো আছেই। আমাদের জানা মতে, এসব জমি উদ্ধারে সর্বশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন অবৈধ দখলে থাকা তিন শতাধিক একর ভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। এখনো রেলওয়ের দুই হাজার একরের বেশি জমি অপদখলে আছে বলে জানা যায়।
সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা হিসেবে উন্নত দেশগুলোতেও আজ রেলপথ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আর আমরা চলছি উল্টোপথে। বসবাসযোগ্যতা হারানোর দিক থেকে বিশ্বে ঢাকা আজ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ থেকে ২৫ হাজার লোক মারা যাচ্ছে। অথচ অফুরন্ত সড়ক-যানের কারণে বায়ুদূষণ ক্রমে বেড়েই চলেছে। রেলের প্রসঙ্গ উঠলেই মন্ত্রী, আমলা ও পরিকল্পনাবিদরা আকাশরেল, পাতালরেল, সুপারসনিক ট্রেনের গল্প শুনিয়ে দেন। এসবেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কেবল গল্প শুনতে শুনতে এই গল্পের প্রতি সবারই বিরক্তি এসে গেছে। তাই বর্তমান সরকারের প্রতি অনুরোধ, আকাশ-পাতাল রেখে আপাতত মাটির ওপর যে রেলপথটুকু আছে সেটিকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করুন, বন্ধ রেলপথগুলো চালু করুন, কিছু নতুন ইঞ্জিন দিয়ে রেলওয়েকে আবার গতিশীল করুন। গণমানুষের এই পরিবহনব্যবস্থাটিতে আবার প্রাণের সঞ্চার হোক_এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক
No comments