বস্ত্র দুর্ভিক্ষের কবলে বাংলাদেশের গরিব by বদরুদ্দীন উমর
শীত মৌসুমে শীত পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এটা না হলে ফসলের হানি থেকে নিয়ে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব সমাজে দেখা যায়। অবশ্য পরিবেশ দুর্যোগের কারণে এ বছর দুনিয়াজুড়ে শীতের প্রকোপ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চীন, জাপান, কোরিয়া থেকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ অধিকাংশ অঞ্চলে তুষারপাত এক মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশেও এবার শীত শুধু বেশিই নয়, অন্যান্য বছরের তুলনায় স্থায়ীও বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। এসবই ধরিত্রীর পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এ বছর শীতের প্রকোপ বেশি হলেও প্রত্যেক শীত মৌসুমেই গরম কাপড়ের অভাবে গরিব মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। বিশেষত, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনগণের অবস্থা দাঁড়ায় সহ্যসীমার অতীত। এর ফলে অনেকের মৃত্যু হয় এবং অন্যদের জীবনযন্ত্রণার শেষ থাকে না। এ অবস্থায় শীত মৌসুমে গরম কাপড় বা শীত বস্ত্রের জন্য তাদের মধ্যে দেখা যায় হাহাকার। দু-তিন বছর আগে এক পত্রিকার সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছিল, রংপুর অঞ্চলের ক্রন্দনরত এক বৃদ্ধার ছবি, যাতে তিনি তার আঞ্চলিক ভাষায় বলছেন—‘হামাক ভাত চাই না, হামাক গায় কাপড় দাও।’ সে সময়ে সেখানে খাদ্যের অভাবও ছিল প্রকট। কিন্তু শীতের প্রকোপ ও শীতের যন্ত্রণা এমনই ছিল, যাতে সেই বৃদ্ধার কাছে খাদ্য থেকে শীতবস্ত্রের প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি। এবারের অবস্থা আরও অনেক খারাপ। কাজেই শীতবস্ত্রের জন্য হাহাকার গরিব মানুষের মধ্যে প্রায় সর্বত্র।
শীতবস্ত্রের এই প্রকাণ্ড অভাবকে প্রকৃতপক্ষে বস্ত্র দুর্ভিক্ষই বলা চলে। দুর্ভিক্ষে যেমন খাদ্যের অভাবে মানুষের মৃত্যু হয়, মৃত্যু না হলেও অপুষ্টির কারণে স্বাস্থ্যহানি হয়, ঠিক সেভাবেই বর্ধিত শীতের প্রকোপে বস্ত্রের অভাবে মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যু না হলেও তারা আক্রান্ত হয় নানা রোগের দ্বারা। এটাই এখন বাংলাদেশজুড়ে হচ্ছে।
শুধু এটা হচ্ছে বললে এ ক্ষেত্রে সবটুকু বলা হয় না। এটা হচ্ছে নীরবে। খাদ্য দুর্ভিক্ষের সময় যেমন দেখা যায় নীরব মৃত্যু, তেমনি শীতবস্ত্রের অভাবেও দেখা যায় নীরবতর মৃত্যু। কারণ খাদ্য দুর্ভিক্ষ সমাজ ও সরকারের যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এমনকি দুর্ভিক্ষ বড় আকারে হলে তা বিশ্বের অনেক দেশের দৃষ্টিও আকর্ষণ করে, শীতবস্ত্রের দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে সেরকম ঘটে না। এই জীবন সঙ্কট খাদ্য দুর্ভিক্ষ সঙ্কটের মতো মানুষকে আলোড়িত করে না।
উত্তর বাংলার রংপুর, দিনাজপুর ইত্যাদি অঞ্চলে প্রত্যেক বছরই শীত মৌসুমে গরম কাপড়ের অভাবে মানুষের দুর্দশার শেষ থাকে না। এ অঞ্চলের অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও গরম কাপড়ের অভাব শীতের মৌসুমে গরিবদের জীবন-যন্ত্রণা বৃদ্ধির এক বড় কারণ। কিন্তু এটা কোনো সমস্যা হিসেবে সমাজ ও সরকারের দ্বারা স্বীকৃত নয়। খাদ্যাভাবজনিত দুর্ভিক্ষ হলে জনগণের মধ্যে তার কিছু প্রতিক্রিয়া হয়, সরকারেরও কিছু টনক নড়ে। কিন্তু বস্ত্র দুর্ভিক্ষ সমাজ ও সরকারের কাছে তেমন কোনো মানবিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয় না।
২০০৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা অঞ্চলে সামুদ্রিক ঝড় আইলা আঘাত হানে। সে সময় এসব অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বাড়িঘর, ক্ষেত-খামার বিধ্বস্ত হয়ে লাখ লাখ লোক গৃহহীন, কর্মহীন হয়। সাতক্ষীরা-বাগেরহাটের আইলা আক্রান্ত এলাকার লোকজন এখনও পর্যন্ত গৃহহীন হয়ে ছাপড়ার ঘরে বাস করে এবং অভুক্ত-অর্ধভুক্ত থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের পুনর্বাসনের জন্য তত্কালীন বেনামি সামরিক সরকার তেমন কিছুই করেনি, তেমনি জনগণের বিপুল ভোট পাওয়া বর্তমান সরকারও এ পর্যন্ত কিছুই করছে না। এ কাজকে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের কোনো ধরনের কর্তব্য মনে না করায় এদের কোনো ‘দিনবদল’ হয়নি। এদের মধ্যে আবার অনেকে এনজিওদের ঋণ নেয়ার কারণে সুদি কারবারের কবলে পড়ায় এদের দুর্দশা আরও বেড়েছে। সরকার থেকে রিলিফ দেয়ার নামে সামান্য যা কিছু দেয়া হয় তার একটা অংশ সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের লোকদের দ্বারা লুটপাট হয়।
সাতক্ষীরার দাকোপ ও কয়রা থানায় আইলাকবলিত এলাকার লোকদের অবস্থার ওপর যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার থেকে মর্মান্তিক ব্যাপার কমই আছে। তারা যে শুধু কাজ ও খাদ্যের অভাবেই জর্জরিত তাই নয়, এই ভরা শীত মৌসুমে, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তাদের প্রায় কারও শীতবস্ত্র নেই। অনেক গৃহহীনকে এ অবস্থায় গাছতলায় বা কোনো খোলা জায়গায় রাতযাপন করতে হচ্ছে। এর যন্ত্রণা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না।
কিন্তু এসব অঞ্চলসহ সারা দেশে শীতবস্ত্রের দুর্ভিক্ষ যে অবস্থার সৃষ্টি করেছে সেদিকে সমাজ ও সরকারের কোনো দৃষ্টি নেই। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনো আগ্রহ বা চেষ্টা নেই। এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। কিন্তু সাধারণ দৃষ্টিতে এটা বিস্ময়কর মনে হলেও বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর চরিত্রের দিকে তাকিয়ে যদি এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা যায় তাহলে এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। নিজেদের স্বার্থ ছাড়া পরস্বার্থের, বিশেষত গরিবের স্বার্থের কথা চিন্তা করার কোনো চেতনা যাদের নেই, তাদের কাছে ‘দিনবদলের’ আওয়াজের প্রকৃত অর্থ যে তাদের নিজেদের দিনবদল এতে আর সন্দেহ কী। এই দিনবদলের কাজে তারা এখন নিযুক্ত আছে।
শীতবস্ত্রের দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা থাকলে সরকার অন্তত দুই-এক কোটি লোকের জন্য এই বস্ত্রের ব্যবস্থা অনায়াসেই করতে পারে। শুধু সরকারি কোষাগার থেকেই এর সম্পূর্ণ ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজন হয় না। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী খাদ্য দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার জন্য কখনও কখনও যেমন বিশেষ তহবিল গঠন করেন, তেমনি শীতবস্ত্র বিতরণের জন্যও বিশেষ তহবিল গঠন করা যায়। এ তহবিলে সাহায্যের জন্য তারা দেশের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের কাছে অনায়াসে আহ্বান জানাতে পারেন। তারা শুধু অর্থ দিয়েই নয়, বস্ত্র দিয়েও সরকারি তহবিলে সাহায্য করতে পারেন। কম্বল থেকে নিয়ে নানা ধরনের শীতবস্ত্র এভাবে গরিবদের জন্য দেশের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম থেকে রাজধানী ঢাকা শহরেও বিতরণ করা যায়।
মাঝে মাঝে দেখা যায় কোনো কোনো দলের নেতানেত্রী গরিবদের মধ্যে নিজহাতে শীতবস্ত্র বিতরণ করছেন। এ কাজ করার সময় তারা সংবাদ মাধ্যমকে খবর দেন। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এর সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে গরিবের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করে তাদের যন্ত্রণামুক্ত করা থেকে তাদের আসল উদ্দেশ্য হয় নিজেদের ব্যক্তিগত ও দলীয় প্রচারণা। এর পরিবর্তে তারা যদি সারা দেশে, অন্যদের সঙ্গে যৌথভাবে না হলেও, দলীয়ভাবে রিলিফ কমিটি গঠন করে অন্যদের কাছে সাহায্যের আবেদন করতেন তাহলে বিরোধীদল হওয়া সত্ত্বেও তহবিল গঠনে অনেক শিল্পপতি-ব্যবসায়ী এগিয়ে আসতেন। কিন্তু না, সে রকম কোনো চিন্তা-ভাবনা তাদের নেই। সে দৃষ্টিভঙ্গি ও দেশের মানুষের প্রতি দরদও তাঁদের নেই। এদিক দিয়ে সরকারের অবস্থা যেমন, শাসক শ্রেণীর সরকারবিরোধী অংশের অবস্থাও সে রকমই।
শুধু সরকারি ও সরকারবিরোধী দলই নয়; সরকারের অন্য অংশের লোকদের, বিশেষত ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের অবস্থাও এদিক দিয়ে অভিন্ন। আগেকার দিনে খাদ্য দুর্ভিক্ষ ও বস্ত্র দুর্ভিক্ষের সময় তাদের মধ্যে এ সঙ্কট মোকাবিলার যে সংগঠিত প্রচেষ্টা দেখা যেত তার কোনো দেখা এখন পাওয়া যায় না বললেই চলে। তারাও এখন ‘দিনবদলের’ নেশায় মশগুল। এই দিনবদলের হিসেবে দেশের গরিব ও জনগণের কোনো স্থান নেই। ‘দিনবদল’ বলতে তারা নিজেদের দিবা বদল, নিজেদের ভবিষ্যত্ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।
এর থেকে দুর্দিন কোনো দেশের ও সমাজের জীবনে আর কতভাবেই বা আসা সম্ভব?
No comments