ফুটপাতে মোটরসাইকেল by রেজোয়ান সিদ্দিকী
ট্রাফিক জ্যাম এখন এই নগরীর নিয়তি। পনের মিনিটের পথ ২ ঘণ্টায়ও পৌঁছানো যাবে কিনা, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জ্যাম নিরসনের জন্য ভিআইপি রোডে তিন লেনে চলাচলের জন্য পুলিশ অনেক কোশেশ করেছে। কিন্তু একদিনের জন্যও তারা সফল হয়নি।
ইলেকট্রনিক সিগনাল কঠোরভাবে মান্য করার নীতিও যে জ্যাম নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারছে, এমন নয়।
ফলে নগরীতে জ্যাম যেন প্রতিদিন বাড়ছে। তার ওপর জোট সরকারের আমলে যেসব পথে ধীরগামী রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সেসব পথে আবার রিকশা চলাচল করতে শুরু করেছে। ফলে জ্যাম আরও বাড়ছে। রিকশা চলাচল বন্ধ করার লক্ষ্যও ভণ্ডুল হয়ে গেছে। এখন ব্যস্ত রাজপথে গাড়ি পার্কিং একটা নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। রাস্তার তিন লেনের দুই লেনই গাড়ি পার্কিংয়ের দখলে চলে গেছে। এই অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এই গাড়ি যে কোনো প্রভাবশালীর তা কে জানে। ফলে এদিকে হাত বাড়িয়ে পুলিশ কেন অহেতুক নিজের বিপদ ডেকে আনতে যাবে। রিকশা ধীরগতির হলেও সেটি সচল ছিল। কিন্তু গাড়ি দ্রুতগতির হলেও অবৈধ পার্কিংয়ের মাধ্যমে রাস্তা দখলে নিয়ে যানজট বাড়িয়ে দিয়েছে।
এরকম ভয়াবহ জ্যামের কারণে মানুষ যানবাহন ছেড়ে বেশি সংখ্যায় হাঁটতে শুরু করেছে। ফলে ফুটপাতেও ভিড় বেড়েছে। ২ ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকার চেয়ে ১৫-২০ মিনিটের পথ হেঁটে যাওয়াই ভালো। এখন শীতকাল বলে হাঁটতে পারছে মানুষ। গরমকালে যে কী হবে, কে জানে! ফুটপাতে হেঁটে চলাও আবার খুব সহজ কাজ নয়। ফুটপাতের দু’পাশে দোকানপাট। নানা রকম ফলফলারি, ফচকা, গুগিন, গরুর পায়ার স্যুপ, ডিম, আয়না-চিরুনিসহ অন্যান্য মনিহারি পণ্যের দোকান সাজিয়ে বসেছে হকাররা। তাদের মাঝখান দিয়ে সরু পথ। একজন কোনো মতে হাঁটা যায়। দু’জন পার হতে হলে একজনকে দাঁড়াতে হয়। ফলে হেঁটে চলার জন্য লোকজনকে নামতে হয় রাস্তায়। আবার নতুন জ্যাম বাড়ে। গাড়ির গতি ধীর করতে হয়। এমন এক চক্রের ভেতরে চলছে নগরী।
এর ওপর ফুটপাতে নতুন আপদ সৃষ্টি হয়েছে। সেটি মোটরসাইকেল। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, পেছনে মোটরসাইকেল হর্ন বাজাতে থাকে। তারাও বোধকরি জ্যামের মধ্যে নিরুপায় হয়েই ফুটপাত ধরে খানিকটা পথ সংক্ষেপে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে। কখনও কখনও ফুটপাতে পথ করে নিতে গিয়ে ফুটপাতকারীদের ধাক্কা দেয়। কখনও ফুটপাত ফসকে পড়ে নিচে। পথচারীদের জন্য এটিও এখন নিয়মিত বিড়ম্বনা।
কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যায় শাহবাগ মোড়ে এ নিয়ে এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। শাহবাগ থেকে কাঁটাবনের দিকে যাওয়ার পথে কাউন্টার বাসের স্ট্যান্ড। সেখানে নানা বাসের টিকিট সংগ্রহ ও বাসে ওঠার জন্য শত শত লোকের প্রতিযোগিতা। ফুটপাত দিয়ে ওই রাস্তাটুকু পেরোনোর কোনো উপায় নেই। এর মধ্যে পথ সংক্ষেপ করতে ফুটপাত ধরে এগিয়ে এলো তিন মোটরসাইকেল। তারা হর্ন বাজায়। কিন্তু কে শোনে কার হর্ন। সবাই ব্যস্ত টিকিট কাটতে ও বাসে উঠতে। এর মধ্যে এক মোটরসাইকেল চালক একজনের দু’পায়ের মাঝখান দিয়ে চালিয়ে দিল মোটরসাইকেল। সে লোক এক ঝটকায় গলা চেপে ধরল মোটরসাইকেল চালকের। বললেন, ‘এই কুত্তার বাচ্চা, ফুটপাতে উঠছিস ক্যান?’ চালক কী যেন বলার চেষ্টা করছিল। তাকে কথা বলার কোনো সুযোগই দেয়া হলো না। মুহূর্তের মধ্যে জনা পঞ্চাশেক লোক একযোগে বলতে শুরু করল, ‘ফুটপাত হাঁটার পথ। মোটরসাইকেল নিয়ে উঠছেন কেন? এই দৃশ্য দেখে বাকি দুই মোটরসাইকেলের যাত্রীরা ধরাধরি করে তাদের মোটরসাইকেল ফুটপাত থেকে রাস্তায় নামিয়ে নিল। কেউ কেউ এসে বলল, ‘ধরেন ধরেন, রাস্তায় নামিয়ে দেই মোটরসাইকেলটা। কেউ কেউ মোটরসাইকেলে অবিরাম লাথি মারতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত বেচারা মোটরসাইকেলওলার বাইকটি নামিয়ে দেয়া হলো রাস্তায়। জনগণের লাথিতে ভেঙে গেছে তার গিয়ারের লিভার। ফলে সাইকেলটি সে আর চালু করতে পারছিল না।
তবে ধারণা করা যায়, ট্র্যাফিক জ্যাম এ অবস্থায় থাকলে এরকম বা এর চেয়েও অপ্রীতিকর ঘটনা রাজপথে ঘটতেই থাকবে। এই যানজটের কি কোনো সুরাহা হবে না?
বিজ্ঞাপনে নারী
এখন দেশজুড়ে শৈত্যপ্রবাহ। প্রতিদিনই প্রচণ্ড শীতে ডজন ডজন মানুষের মৃত্যু ঘটছে। শ্রীমঙ্গলে শীত পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। ঢাকায় দশ-বারো ডিগ্রি। হাত বের করলে শীত বিঁধে যায়। সকালের শীত যেন আরও বেশি। এর মধ্যে কনকনে হিমেল হাওয়া। দেশজুড়ে রাতভর যেন শীতের সঞ্চয় ঘটে। রাতে শীত প্রতিরোধের সব আয়োজন নিয়ে নাগরিকরা ঘুমায়। সকালে জমাট শীত তাই আরও বেশি করে অনুভূত হয়।
এরকম এক সকালে লেপ-কম্বলের নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে খবরের কাগজগুলো নিলাম। একটি খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় দৃষ্টি আটকে গেল। একটি ফ্যাশন হাউসের বিজ্ঞাপন। সে বিজ্ঞাপনে একজন নারীর ছবি। ফিনফিনে পাতলা এক সাদা শাড়ি। শাড়িটি নাভির অনেক নিচে পরা। গায়ে ব্রা-কাট একটি সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ। বিচিত্র ভঙ্গিমায় এই নারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিজ্ঞাপনে ছাপা হয়েছে। ওই দোকানে সব কিছুই ৫০ শতাংশ মূল্য হ্রাস। এই ছিল বিজ্ঞাপনটির বক্তব্য। বিজ্ঞাপনে নারীর ছবি বহু পুরনো দিনের ঘটনা। এ নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। অনেক রচনা পড়েছি। নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে অনেক নারীরই উত্থিত মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখেছি। কিন্তু বিজ্ঞাপনচিত্রে নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা কখনোই খুব একটা চোখে পড়েনি। না প্রাচ্যে, না প্রতীচ্যে।
কিন্তু প্রতীচ্যে যদি এই শীত ঋতুতে নারীর ছবি দিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো, তা হলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সে বিজ্ঞাপনটি হতো কোনো গরম কাপড়ের। কিংবা গরম কাপড়ের মূল্য হ্রাসের। আর বিজ্ঞাপনটিতে নারীর গায়ে থাকত বিচিত্র সব গরম কাপড়। তাকে প্রায় বস্ত্রহীন করে বিজ্ঞাপন চিত্রটি প্রচার করা হতো না। যে ফ্যাশন হাউস এই বিজ্ঞাপনটি প্রচার করেছে, তারা যে শুধু নারী-পোশাকের ফ্যাশন করেন, তা নয়। তাদের দোকানে পুরুষের পোশাক-পরিচ্ছদও বিক্রি হয়। তাহলে মূল্য হ্রাসের বিজ্ঞাপনে প্রায় নগ্ন নারী কেন?
এর ফলে এ সময়ে অবধারিতভাবেই মনে হতে বাধ্য যে, এখানে নারীকে, নারীর শরীরকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ওই বিজ্ঞাপন দেখে একজন নাগরিক হয়ত এখন ফ্যাশন হাউসের দিকে ছুটবে না। বরং মায়া হবে। আহা, এই শীতেও মেয়েটির পরার যথেষ্ট কাপড় নেই।
আমাদের জীবনে নগর এই পাপগুলো তৈরি করেছে। নারীকে পণ্য করার এ পাপ বুঝি আমাদের চেতনায় ঢুকে গেছে। নারীকে শরীরী হিসেবে দেখতে চাই আমরা। তাকে বুঝি মানুষ হিসেবে দেখতে কুণ্ঠা বোধ করি। এই চেতনা থেকে নাগরিকদের দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বর্তমান প্রজন্মের এই পাপ ভবিষ্যতের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হতে থাকবে। মেধাহীন, মূল্যবোধহীন নতুন এক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটবে। যাদের কাছে শরীরই হবে প্রধান বিবেচ্য বিষয়, হৃদয় কিংবা মনন নয়। আমরা কী সবাই মিলে সেই সর্বনাশা পথ থেকে নিজেদের ফেরাতে পারি না।
প্রকৃতির কাজ প্রকৃতি করছে
পৌষ মাস শেষ হয়ে গেছে। মাসটাই পুরো শীত। এই পৌষ মাসে কারও পাতে পিঠেপুলি, নপেন গুড়, খেজুরের গুড়ের সন্দেশ—প্রভৃতি উপাদেয় খাবার উঠে এসেছে। পত্রিকায় পত্রিকায় পৌষের খাবারের রেসিপি দেখি, কিন্তু পৌষ মাসের শীতে এরই মধ্যে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বহু পরিবারে সর্বনাশ ডেকে এনেছে। মাঘেও প্রথম সপ্তাহ ঘোর শীতে কাটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গোটা উত্তর গোলার্ধে এখন তীব্র শীত।
তবু দিন গড়িয়ে মাঘ শুরু হয়ে গেছে। মাঘের শীতে বাঘও নাকি কাঁপে। তারপর এক সময় মাঘও পেরিয়ে যাবে। ফাল্গুন ছুঁয়ে বসন্ত আসবে। এখন শীতে যারা জবুথবু হয়ে গেছি তারা শরীর থেকে কাপড়ের ভার নামাব। বসন্তের হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে জীবনের চঞ্চলতা বাড়াব। মন কেমন করা হাওয়ায় পাখির মতো উড়াল দিতে ইচ্ছে করবে। হঠাত্ সামান্য বাতাসে ঝরে যাবে শুকনো পাতারা।
সে কথা যাক। বসন্তের কথা বসন্তকালে বলব। এই যে প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ তার ভেতরেও প্রকৃতি আপন নিয়মে কাজ করে চলছে। মানুষের কাছে শীতটাই এখন প্রধান। কিন্তু শীতের অর্ধেক তো পেরিয়ে গেছে। প্রকৃতিকে তো বসন্তের আয়োজন করতে হবে। ফলে সে চলছে তার নিয়মমাফিক। এখন আম গাছের ডালে ডালে দুই-একটা করে মুকুলের উদগম শুরু হয়েছে। সজনে গাছের ডাল ভেদ করে দুই-একটা দুই-একটা মুকুল মাথা বের করছে। কাঁঠাল গাছ ফুঁড়ে বের হয়ে আসছে দুটি কুশি পাতা। ধারণা করা যায়, এখানেই আসবে কাঁঠালের মোচা। গুচ্ছ গুচ্ছ কাঁঠাল ধরবে। সে আয়োজনের প্রারম্ভিক পর্যায় এখন। তবুও প্রকৃতি ব্যস্ত তার নিজস্ব কর্মে। মাঘের শেষাশেষি আম, জাম, কাঁঠাল, সজনে প্রভৃতি গাছগুলো ফুলে-মুকুলে ছেয়ে যাবে। মৌমাছির অবিরাম আনাগোনা চোখে পড়বে। কিন্তু তার আগে শীতের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে প্রকৃতির নানা আয়োজন। সে আয়োজন কোনো কোনো নাগরিকের দৃষ্টিতে পড়বে। কারও কারও দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। প্রাণের রহস্য এরকমই।
ফুটনোট
এক সামাজিক অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছে পঞ্চাশোর্ধ্ব বেশকিছু বন্ধু-বান্ধব, নারী-পুরুষ। কেউ কেউ কলেজে সহপাঠী ছিল। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বেশি বুড়িয়ে গেছে। কাউকে কাউকে ৪২-৪৪ মনে হয়। দু’একজন আছে সেলিব্রিটি। এরকম একজন তরুণ-দর্শন সেলিব্রিটিকে ঘিরে ধরল সবাই। প্রত্যেকেরই একই প্রশ্ন, ‘তুমি এমন তরুণ রয়ে গেলে কেমন করে?’ সে এটা-ওটা জবাব দেয়ার চেষ্টা করে। এর মধ্যে এক বান্ধবী ছুটে এসে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই ফরমালিন খেয়েছ। তা না হলে বুড়ো তুমি হতেই।’
No comments