পিতৃহীন পৃথিবী by কে জি মোস্তফা
জানুয়ারি মাস। শীতের মাস। শীতের পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়া হয়ে যাওয়া একটি গাছের ডালে কিচিরমিচির একঝাঁক সুরেলা চড়ুই পাখির ডাক কানে আসে। পেছনে ডালপালার আড়ালে ক্ষীণতেজ সূর্য। দৃশ্যটা সম্মোহনী। গাছের ওই শূন্য পাতায় আমার অনেক কথা আছে।
তাতে কোনো লেখা নেই, রেখা নেই, একটা আঁচড়ও নেই। কিন্তু অতিসাধারণ একটি স্মৃতিকথা কোনো এক অদৃশ্য কালিতে আজও লেখা রয়েছে ব্যক্তিগত গদ্যে।
২৩ জানুয়ারি আমার দ্বিতীয় সন্তান খোন্দকার মাসুদুল হাসান মানুর জন্মদিন। সাল ১৯৬৭। সরস্বতীর সঙ্গে অভিমান করে এক সময় ঢাকা ছেড়ে ছোটখাটো ব্যবসা নিয়ে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে অবস্থান করেছিলাম। গোলাবাড়িয়া মাদ্রাসা রোডে ছোট একটি বাসায় ভাড়া থাকতাম। সে বছর জানুয়ারিতেই ছিল রমজান এবং ২৩ জানুয়ারি ঈদুল ফিতর। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। একমাত্র ছেলে ও কাজের মেয়েসহ বাসায় মাত্র ৪ জন লোক। নির্ধারিত তারিখের আগে ঈদের রাতেই হঠাত্ আমার স্ত্রীর প্রসব বেদনা দেখা দিল। দিশেহারা আমি এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলাম। স্বজন বলতে কাছাকাছি কেউ নেই। বাধ্য হয়ে পাশের বাসার ভদ্রমহিলাকে ডেকে পাঠালাম। আমাদের বাসায় প্রতিদিনই তার যাতায়াত ছিল। স্বামী স্থানীয় কৃষি ব্যাংকে কর্মরত। বাড়ি কুমিল্লায়। আমার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে দুজনই বেরিয়ে এলেন। সবকিছু শুনে আমাকে যথাসম্ভব অভয় দিয়ে দুজনই অতিদ্রুত সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তখন আমার কীই-বা বয়স! সাংসারিক দায়-দায়িত্ব কতটুকুই আর বুঝি! আমার এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ওই দম্পতি তাদের যাবতীয় ঈদ-উত্সবের আয়োজন বাদ দিয়ে সার্বিক সাহায্যে তত্পর হলেন। এমন সহমর্মিতা, প্রাণের দিকে প্রাণের টান অবিস্মরণীয় হয়ে রইল।
প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। আমাদের চেতনা থেকে সামাজিকতা রক্ষার দায়বোধ যখন লুপ্ত হয়ে গেছে, মনের অন্তঃস্থল থেকে মাঝেমাঝে ভেসে ওঠে ওই দম্পতির মুখ। প্রতি বছর ২৩ জানুয়ারি এলেই হারিয়ে যাওয়া ওই দম্পতির মহানুভবতার কথা মনে পড়ে। যদিও হাজারো মানুষের কথায়-নিঃশ্বাসে তার বর্ণ-গন্ধ হারিয়ে গেছে। আজ সেটা যেন এক স্বপ্নময় বিষাদ। গভীর দুঃখই কি আসল সম্পর্কের কষ্টিপাথর!
অধুনা শহরের কৃত্রিম পরিবেশে নানা নামে নানা মোড়কে তৈরি আকাশচুম্বী আবাসন। বনরাজি নীল আকাশের দেখা বুঝি পায় না বাসিন্দারা। হাইরাইজ সংস্কৃতিতে কেউ নাকি কারোর খবর রাখে না। প্রয়োজনও বোধ করে না। দিনদুপুরে ডাকাতি কিংবা খুন হয়ে গেলেও সামনের ঘরের লোক টের পায় না। চেনা-চেনা মানুষ আজীবন অচেনাই থেকে যায়। নানা বিধিনিষেধের প্রাচীর ও শৃঙ্খলার চাপে হারিয়ে যায় মানুষ, তার জীবন, জীবনের স্বাভাবিক আবেগ। সুখী জীবনের ধারণাও ভীষণভাবে গেছে পাল্টে।
আসলে জীবন যেভাবে জটিল ও সঙ্কটময় হয়ে উঠছে, এক বোধহীন আত্মকেন্দ্রিকতায় মানুষ ছুটছে নিজের অজান্তেই। অধিকাংশ মানুষই নিজস্ব পরিমণ্ডল আর কাছাকাছি বর্তমান নিয়েই বাঁচতে চায়। ভোগসর্বস্ব সমাজের দ্রুত আবর্তনশীল আকর্ষণ ও বিকর্ষণের চাপ মনকে এ অবস্থায় এনে ফেলেছে। সময়ের ভঙ্গুরতা যতই বাড়ছে, অনুভূত হচ্ছে সামাজিক মাত্রার তত বাস্তবতা।
আগেকার যূথবদ্ধ পরিবার, সংঘবদ্ধ মহল্লা, সামাজিক দায়বব্ধতা ইত্যাদি প্রাচীন সংস্কৃতি তথা মানবিক মূল্যবোধগুলো অনেক আগেই জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। জীবনে জীবন যোগ করতে-করতে এখন পরকে করছে আপন, আপনকে করছে পর।
কালচক্রে আবার ঘুরে আসছে আমার সেই ছেলের জন্মদিন, ২৩ জানুয়ারি ২০১০। শীতের এ প্রার্থনা হয়তো বসন্তে থাকবে না বেঁচে। হে পুত্র আমার, যে কোনো উপায়ে যতটা সম্ভব আখের গুছিয়ে নাও। বহুকাল আগে পৃথিবীটা ছিল পিতৃবত্সল। ছিল মায়া-মমতায় ক্ষুদ্র জীবনের কান্তি। এখন ক্রমশ অবান্তর সেই সব প্রাচীন উত্তাপ।
পিতৃহীন এই পৃথিবীতে হে পুত্র আমার, বসন্তের উত্তাপ যতদিন থাকবে তোমার শিরায় শিরায়, চোখে রবে দীপ্তি—তুমি আছ, সবই আছে। তারপর কালের প্রবাহে একদিন হয়তো চিনতে পারবে না পুত্রকে তোমার। আণবিক জতুগৃহে তুমি যে তখন পিতা নও আর, দিকভ্রান্ত এই পৃথিবীর এক আহত মানুষ!
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক
No comments