মাথার খুলির মালা, সেই দিনের কথা কেমনেভুলি
লোমহর্ষক সেই দিনের কথা আমি কেমনে ভুলি, বিশেষ করে যেদিন ক্যামেরাবন্দি করেছিলাম নিহত পাক সেনা ও রাজাকারদের ওইসব মাথার খুলি।” এভাবেই ১৯৭১ সনের যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করছিলেন রণাঙ্গনের কলম সৈনিক জন বোস।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সুন্দরদী গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা জন বোস জানান, দেশের মধ্যে সর্বশেষ বিজয় পতাকা উড়েছিল গৌরনদী। ৭১’র ২২ ডিসেম্বর গৌরনদীকে পাক হানাদারমুক্ত করার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সময়ে নিহত রাজাকার, আলবদর ও পাক সেনাদের মাথার খুলি দিয়ে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদীর বাটাজোর বাজারে একটি ‘খুলির মালা’ তৈরি করেছিলেন। সূত্রমতে, যুদ্ধচলাকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে জন বোস কলম সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি লিখিতভাবে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় অবস্থান করা পাক সেনাদের খবরাখবর পৌঁছে দিতেন। ওইসময় তিনি নিজস্ব ক্যামেরায় অতিগোপনে বন্দি করেছিলেন কিছুসংখ্যক ছবি। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘খুলির মালা।’এতদঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু জানান, ৭১’র ২৫ এপ্রিল পাক সেনারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে এ জনপদে প্রবেশের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাদের প্রবেশের খবর শুনে গৌরনদীর স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা সাউদেরখালপাড় নামক স্থানে পাক সেনাদের প্রতিহত করার জন্য অবস্থান নেয়। হানাদাররা সেখানে পৌঁছলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সেদিন (২৫ এপ্রিল) পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন গৌরনদীর নাঠৈ গ্রামের সৈয়দ আবুল হাসেম, চাঁদশীর পরিমল ম-ল, গৈলার আলাউদ্দিন ওরফে আলা বক্স ও বাটাজোরের মোক্তার হোসেন হাওলাদার। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে সেদিন আটজন পাক সেনা নিহত হয়েছিল। এটাই ছিল বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে স্থলপথে প্রথম যুদ্ধ এবং এরাই হচ্ছেন প্রথম শহীদ। পাক সেনারা গৌরনদীতে প্রবেশের দ্বার মুখ খাঞ্জাপুর নামস্থানে মোস্তান নামক এক পাগলকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ২৫ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটজন পাকসেনা নিহত হবার পর তারা ক্ষিপ্ত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ওই নরপশুদের গুলিতে সেইদিন দু’শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী মারা যায়। হানাদাররা গৌরনদী বন্দরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। মে মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্পে ছিল আড়াই শতাধিক সৈন্য ও স্থানীয় অর্ধশত রাজাকার-আলবদর।
গৌরনদীর বাটাজোর, ভুরঘাটা, মাহিলাড়া, আশোকাঠী, কসবাসহ প্রতিটি ব্রিজে পাক মিলিটারিদের ব্যাংকার ছিল। উত্তরে ভুরঘাটা, দক্ষিণে উজিরপুরের শিকারপুর, পশ্চিমে আগৈলঝাড়ার পয়সারহাট, পূর্বে মুলাদী পর্যন্ত গৌরনদী কলেজ ক্যাম্পের পাক সেনাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাদের দোসর ছিল এলাকার রাজাকার, আলবদর ও পিচ কমিটির সদস্যরা। হত্যাকা-, লুটতরাজ, নারী ধর্ষণসহ নানা কাজে এরা পাকসেনাদের সহযোগিতা করত। পাক সেনারা গৌরনদী কলেজের উত্তর পার্শ্বে একটি কূপ তৈরি করে সেখানে লাশ ফেলত। কলেজের উত্তর পার্শ্বে হাতেম পিয়নের বাড়ির খালপাড়ের ঘাটলায় মানুষ জবাই করে খালের পানিতে শত শত লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। পাক সেনারা গৌরনদী গার্লস হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী পুল ও গয়নাঘাটা ব্রিজের ওপর বসে শত শত লোক ধরে এনে হত্যা করে লাশগুলো খালে ফেলত।
সেইদিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা গেছে, গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার ইতিহাসে সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল ’৭১ সনের ১৫ মে। ১৪ মে দোনারকান্দিতে চিত্ত বল্লভের নেতৃত্বে স্থানীয় লোকজন ঢাল সড়কি নিয়ে পাক হানাদারদের মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং ৪ জন পাক সেনাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় শতাধিক পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে কসবার হযরত মল্লিক দূত কুমার পীর সাহেবের মাজার সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চাঁদশী হয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে জনতার ওপর এলএমজির ব্রাশ মারে এবং গুলি করে পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। পাক সেনাদের ভয়ে আশে পাশের ৭/৮টি গ্রামের ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ সেদিন এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। রাংতার উত্তর পাশের সুবিশাল কেতনার বিলের ধান ও পাট ক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নিতে এসে পাক বাহিনীর গুলিতে ওইদিন ৫ শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসী প্রান হারায়। নরপশুদের কবল থেকে সেদিন পশুরাও রেহাই পায়নি। শত শত ঘর বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ফলে বহু গরু-ছাগল ও হাঁস মুরগি মারা যায়। ওই বছরের ২ আষাঢ় আগৈলঝাড়ার কোদালধোয়া নামকস্থানে দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাসের মালিক লক্ষণ দাস ও তার একটি পোষা হাতিকে পাকসেনারা এক সাথে গুলি করে হত্যা করে। পাক সেনারা এই এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ সহস্রাধিক নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা ও তিন শতাধিক মা-বোনের ইজ্জত হরণ করে। জুলাই মাসে ৯ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন আকন ও তার বাহিনীর নেতৃত্বে গৌরনদীর বাটাজোরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা মারা যায় এবং ৪ জন ধরা পড়ে। পাকসেনাদের গতিরোধ করার জন্য গ্রুপ কমান্ডার নিজামের নেতৃত্বে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের আশোকাঠী বাসস্ট্যান্ডের ব্রিজটি মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙ্গে দিয়েছিল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে। এর কিছুদিন পর নিজামের নেতৃত্বে হোসনাবাদে পাক বাহিনীর অস্ত্র ও মালবাহী বোটে হামলা চালিয়ে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিল মুক্তিবাহিনীরা। ওইদিন যুদ্ধে প্রায় ২৫ জন পাকসেনা মারা যায়। ৯ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত নিজাম বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন বাদশা হাওলাদার, কুতুব উদ্দিন, তাহের কমান্ডার, হামেদ কমান্ডার ও আলাউদ্দিন মিয়া। নিজাম উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৯ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
গৌরনদীর কসবায় আল্লাহর মসজিদের নিকট ২৭ নবেম্বর পাক বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে মোঃ ছাত্তার কমান্ডার গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পরেরদিন একইস্থানে দক্ষিণ চাঁদশীর আলতাফ হোসেন শহীদ হন। গৌরনদী-আগৈলঝাড়া এলাকার কৃষক শ্রমিক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (সাবেক মন্ত্রী) ও আঃ করিম সরদার (সাবেক এমএলএ) সর্বপ্রথম স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। ওইদলের প্রধান ছিলেন গৈলার মতি তালুকদার। তার সহযোগী ছিলেন পতিহারের নুরু“ গোমস্তা। কোটালীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় হেমায়েত বাহিনী। ওই বাহিনীর নেতৃত্বে আগৈলঝাড়ার শিকির বাজার, রামশীল ও পয়সারহাটে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে যুদ্ধ হয়। সবশেষে মুজিব বাহিনীর একটি দল ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জেষ্ঠপুত্র, জাতীয় সংসদের সাবেক চীফ হুইপ আলহাজ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। তার চাচাত ভাই আঃ রকিব সেরনিয়াবাত, কসবার ফজলুর রহমান হাওলাদার, বিল্লগ্রামের মেজর শাহ আলম তালুকদার ছিলেন তার সহযোগী। গৌরনদী কলেজে পাক সেনাদের ক্যাম্পে মুজিব বাহিনী ও নিজাম বাহিনী যৌথ আক্রমণ চালিয়েছিল। কলেজের পশ্চিম দিক থেকে মুজিব বাহিনী ও পূর্বদিক থেকে নিজাম বাহিনী আক্রমণ করে। দীর্ঘ ২৮ দিন যুদ্ধের পর পাক সেনারা পরাস্ত হয়। একপর্যায়ে ৭১’র ২২ ডিসেম্বর গৌরনদী কলেজে অবস্থানরত পাক সেনারা মিত্র বাহিনীর মেজর ডিসি দাসের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
৪১ বছরেও স্বপ্ন পূরণ হয়নি
স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বশেষ পাক হানাদারমুক্ত গৌরনদীতে ১৯৭৫ সালের ৭ মে তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ নির্মাণের জন্য ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ওই বছরের ১৫ আগস্ট ভয়ালকালো রাতে তিনি শহীদ হন। ফলে থমকে যায় স্মৃতি সৌধ নির্মাণের উদ্যোগ। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৪১ বছরেও সাবেক মন্ত্রী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সেই স্বপ্ন আজও বাস্তবায়িত হয়নি। গৌরনদীতে আজও নির্মিত হয়নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সৌধ। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গৌরনদীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে জরুরী ভিত্তিতে স্মৃতি সৌধ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
Ñখোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল
No comments