প্রান্তকথা- ‘উফ্, জার বাহে’ by শান্ত নূরুননবী

২৬ ডিসেম্বর সকালে ঘন কুয়াশার ভেতর কুড়িগ্রাম কলেজ মোড়ে উপস্থিত হতেই এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে আরোহীর কথোপকথন কানে এল। আরোহী জোরে চালানোর জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন এবং আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী রিকশাওয়ালা দাঁতের কম্পমান দুই পাটিতে শব্দ তুলে বলছিলেন, ‘উফ্, জার বাহে, হাত-পাও নইড়ব্যার চায় না।’ জার মানে শীত।
আমার গায়ে যথেষ্ট পোশাক চাপানো থাকলেও ঘন কুয়াশায় ঢাকা আকাশের নিচে কেঁপে উঠছিলাম। তীব্র শীতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে কুড়িগ্রাম জেলায়, বিশেষ করে চরাঞ্চলে। ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত শীতাক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা সেখানে ২৬। মৃত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নবজাতক ও বয়স্ক। নবজাতকদের জন্য অবশ্যই প্রয়োজনীয় উষ্ণতার ব্যবস্থা দরকার। গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বাচ্চা হওয়ার পরপরই তাকে রোদে নিতে দেখা যায়। কিন্তু দিনের পর দিন রোদের দেখা নেই উত্তরাঞ্চলে। ২৭ ডিসেম্বর পঞ্চগড়ে গিয়েও হাড় কাঁপানো শীতের নিষ্ঠুরতা অনুভব করলাম। দুপুরবেলায়ও কুয়াশার কারণে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। তবু এড়ানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও জেলা মিলে ২৭ ডিসেম্বর মারা গেছেন নয়জন বয়স্ক ব্যক্তি। শীতের কারণে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এসে মারা গেছেন তাঁরা। কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে কেউ অসুস্থ হলে হাসপাতালে আসা অনেক কঠিন ব্যাপার। দুপুরের দিকে কুয়াশা পাতলা হয়ে এলে হয়তো ডুবোচরে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েই নৌকা ছাড়া হয়। বিকেল চারটার পরই আবার নৌকা চলাচল অসম্ভব হয় এই তীব্র কুয়াশাময় শীতে। সুতরাং, হাসপাতালের হিসাবের বাইরেও যে শীতজনিত রোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে না, তা হলফ করে বলা যায় না। এই শীতেও দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কাজে বেরোতে হচ্ছে। আগে ফসল কাটা হয়ে গেলে খেত থেকে নাড়া সংগ্রহ করে রাখত গ্রামীণ মানুষ। এখন অধিক উৎপাদনশীল ধানগাছের দৈর্ঘ্য এতই ছোট হয়েছে যে ধানকাটার পর খেতে আর নাড়া থাকে না। ফলে, সকাল-সন্ধ্যায় নাড়ার আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে আগুন পোহানোর উপায় কমে গেছে মানুষের। তারা কেবল একটা প্রার্থনাই করতে পারে, ‘হে সূর্য, তুমি আমাদের উত্তাপ দিয়ো।’ কিন্তু সূর্য তো সারা দিনে একবারও দেখা না দিয়ে কুয়াশার আড়াল থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে দিগন্তের অতলে!
বছরের পর বছর কম্বলসহ নানা রকম শীতের কাপড় বিতরণ চলছে দরিদ্র শীতার্ত ব্যক্তিদের মধ্যে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক, স্থানীয় ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট ও প্রথম আলো বন্ধুসভার মতো সংগঠনগুলো নিষ্ঠার সঙ্গে এই মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। তবু চাহিদা ফুরোচ্ছে না। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, শীতার্ত ব্যক্তিদের মধ্যে গরম কাপড় বিতরণ কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কে কোথায় কীভাবে শীতের কাপড় দিচ্ছেন, তা আগে থেকে প্রশাসনের জানা থাকলে সমন্বয় করা সম্ভব হতো। হয়তো এই সমন্বয়হীনতার কারণেই একই পরিবারে প্রতিবার শীতের কাপড় যেমন যাচ্ছে, তেমনি যোগাযোগবিচ্ছিন্ন চরগুলোয় চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোটারদের সন্তুষ্টি বিবেচনায় নিয়ে; অনেক দরিদ্র শীতার্ত মানুষ বিবেচনার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি বলেন, একই ব্যক্তির বারবার শীতবস্ত্র পাওয়ার ঘটনা ঘটছে। কিছু কর্মহীন মানুষ নানা জায়গা থেকে কম্বলসহ বিভিন্ন শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে অল্প পয়সায় আবার তা বিক্রি করে দিচ্ছে। অন্যদিকে, শীতের কাপড় কেনার সামর্থ্য আছে যাদের, এমন মানুষও কম্বল পাচ্ছে বিতরণকারীদের সঙ্গে সম্পর্কের জোরে। পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনে করেন, তীব্র শীত ও শৈত্যপ্রবাহ মোকাবিলায় দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করার ব্যক্তিগত, বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগগুলোর
মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারলে গরিব মানুষ বেশি উপকৃত হবে।
তবে প্রতিবছরই শীতের প্রকোপ বাড়ছে বলে সাধারণ গ্রামীণ মানুষ অনুভব করছে। প্রকোপটা অল্প সময় স্থায়ী হয় বটে, কিন্তু হাড়-মাংস কাঁপিয়ে দেয়। গায়ের ওপর ত্রাণের গরম কাপড় চাপিয়েও পরিত্রাণ মিলছে না শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের। নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ ঠান্ডাজনিত নানা রোগে কাবু হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া হিমেল হাওয়া আর কুয়াশার ঢেউ বরফের মতো ঠান্ডা করে দিচ্ছে অনেক কষ্টে জোগাড় করা পাতলা কম্বল কিংবা পুরোনো কাপড় জুড়ে বোনা কাঁথা। সুতরাং, শীত মোকাবিলায় কেবল গরম কাপড় বিতরণ যথেষ্ট নয়, পরিকল্পনা করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির। শীতজনিত রোগবালাইয়ের ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন-সহযোগীদের অর্থায়নে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য বড় আকারের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সেগুলো সবই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলার কর্মসূচি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বা হিমালয় অঞ্চলের বরফ গলে যেসব সম্ভাব্য বিপর্যয় তৈরি হবে, সেসব পরিস্থিতিতে দরিদ্র মানুষের টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করার কথাই বেশি বলা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ বা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টেকসই ফসল উৎপাদন ইত্যাদি অনিবার্য কারণে গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু শীতের তীব্রতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা মোকাবিলাও এসব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নদীতীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ মনে করে, নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে কেবল বন্যা ও নদীভাঙনই বাড়ছে না, শীত ও গ্রীষ্মের তাপমাত্রার তারতম্যও বাড়ছে। নদীর বুকে জেগে ওঠা বড় বড় চরের বালুমাটি গরমকালে যেমন দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, শীতে তেমন দ্রুত ঠান্ডা হয়ে গিয়ে চরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। আগে শীতকালে নদ-নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় এগুলোর পানি যে উত্তাপ সংরক্ষণ করে রাখতে পারত, এখন সেটাও সম্ভব হয় না। নদ-নদীর নাব্যতা স্বাভাবিক রাখতে পারলে শীতের তীব্রতা কিছুটা কম হতো। সুতরাং, কেবল জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাই নয়, শীতও এক ভয়াবহ দুর্যোগ।
 শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.