ট্রেনে ছদ্ম পেশায় দুর্ধর্ষ ছিনতাই by এস এম আজাদ

রেলস্টেশনে সারা দিন ঘুরে বেড়ায় ওরা। বয়স ১৭ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। কেউ পপকর্ন বিক্রি করে। কেউ বাদাম কিংবা আমড়া। তবে এসব কাজ তাদের ছদ্ম পেশা। আসল পেশা 'লেডিস কাম'! ওদের ভাষায় এর মানে হচ্ছে- নারীদের স্বর্ণালংকার ও ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া। পেশার মতো ওদের আছে ছদ্মনামও।
রাজধানীর বিমানবন্দর ও কমলাপুর রেলস্টেশনে টানা পার্টি বা লেডিস কাম করে পোষাচ্ছিল না, তাই অভিনব কায়দায় ট্রেনে ছিনতাইয়ের কাজে নামে তারা ছয়জন। চলন্ত ট্রেনে বগির বাতি নিভিয়ে যাত্রীদের টাকা ও জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয় তারা। এ কাজে তাদের মূল অস্ত্র বেল্ট। ছিনতাইয়ের সময় কোনো যাত্রী বাধা দিলে প্রথমে গলায় বেল্ট বেঁধে নির্যাতন এবং পরে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনা আছে। গত ২৩ ডিসেম্বর আন্তনগর ট্রেন তুরাগ এক্সপ্রেস থেকে দুই বস্ত্র প্রকৌশলীকে (টেঙ্টাইল ইঞ্জিনিয়ার) ফেলে দেয় এ চক্রটি। পুলিশ ওই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে তাদেরই একজন মমিন ওরফে সুজন ওরফে কালু (২০)। শাহিন (২৪), রাব্বী ওরফে দুর্জয় (১৭), মহাব্বত (২২) ও আকাশ (১৭) নামে বাকি চার আসামিকে দুদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এই চক্রের আরেক সদস্যকে গ্রেপ্তারের জন্য খোঁজা হচ্ছে বলে পুলিশ তার নাম প্রকাশ করেনি। কালু তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুই বস্ত্র প্রকৌশলীকে ফেলে দেওয়ার নৃশংস ঘটনার আগাগোড়া বিবরণ দেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতবছর ট্রেনে একের পর এক ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনার পর 'কৃষ্ণমালা পার্টি' বা 'গামছা পার্টি'র ১১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বর্ণনায় বের হয়ে আসে কিভাবে গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে যাত্রীদের ফেলে হত্যা করা হয়। এরপর পুলিশের সতর্কতা এবং ট্রেনের ছাদে ওঠার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে এ জাতীয় কর্মকাণ্ড কিছুটা কমে আসে। তবে এবার লেডিস কাম পার্টির তৎপরতায় নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ প্রশাসন।
কমলাপুর জিআরপি থানা পুলিশ জানায়, ২৩ ডিসেম্বর সকালে তুরাগ এক্সপ্রেসে জয়দেবপুর যাওয়ার সময় তেজগাঁও রেলস্টেশনের কাছে চলন্ত ট্রেন থেকে দুই প্রকৌশলী মাজহারুল ইসলাম রিপন ও গোলাম মোরশেদ নয়নকে ফেলে দেয় ছিনতাইকারীরা। একই বগির যাত্রী রেলের এক সাবেক পয়েন্টম্যানকেও (পুরো পরিচয় পাওয়া যায়নি) খিলক্ষেত এলাকায় ট্রেন থেকে ফেলে দেয় একই চক্র। এ ঘটনায় ২৫ ডিসেম্বর কমলাপুর জিআরপি থানায় মামলা করেন রিপনের বড় ভাই মনিরুল ইসলাম। রিপনের বাসা রাজধানীর সবুজবাগের আহমেদবাগ এলাকায়। তার বাবা রফিকুল ইসলাম রেলের পরিদর্শক হিসেবে কমলাপুরেই কর্মরত। নয়নের বাবা আবুল কালাম শ্রম ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন। তাদের বাসা শান্তিনগরে। ঘটনার দিন পথচারীদের সহায়তায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার পর গত বুধবার রিপনকে বাসায় নেওয়া হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় নয়নকে রাজধানীর ট্রমা সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তার দুটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে রিপন বলেন, 'ওদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি, ওরা শোনেনি। এক পর্যায়ে দুই বন্ধু অচেতন হয়ে পড়ি। আমরা মরে গেছি মনে করেই হয়তো ফেলে দিয়েছে।' রিপন জানান, তাঁদের সহযাত্রী বৃদ্ধ ব্যক্তিটিকেও মারধর করা হয়। প্রথমে রিপনকে এবং পরে নয়নকে জানালা দিয়ে ফেলে দেয় ছিনতাইকারীরা। রিপনের মাথা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়েছে। নয়নের ডান পা, ডান হাতের কনুই, কড়ে আঙুল ভেঙে গেছে। থেঁতলে গেছে তাঁর ডান কান।
রিপন জানান, তাঁরা দুই বন্ধু আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন। নয়ন গাজীপুরের কাশিমপুর মণ্ডল গ্রুপে এবং রিপন ডিবিএল গ্রুপের মতিন স্পিনিংয়ে ইন্টার্নি করছেন। ঘটনার দিন ভোর ৫টার দিকে জয়দেবপুর যাওয়ার জন্য তারা কমলাপুর থেকে তুরাগ এক্সপ্রেসে ওঠেন। বগিতে এক বৃদ্ধ যাত্রী ছিলেন। তেজগাঁও পৌঁছার পর এক ব্যক্তি জানালা দিয়ে ঢুকে বগির দরজা খুলে দেয়। পরে আরো দুই-তিনজন ঢুকে তাণ্ডব শুরু করে। বেল্ট দিয়ে নয়ন ও রিপনের গলায় ফাঁস দিয়ে তিনটি মোবাইল ফোন, ডেবিট কার্ড ও কিছু টাকাসহ মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে অনেকটা অচেতন অবস্থায় দুজনকে বাইরে ফেলে দেয়। রিপন আরো জানান, ছিনতাইকারীদের দুজনের পরনে ছিল লুঙ্গি-গেঞ্জি। একজনের ট্রাউজার ও গেঞ্জি। সবাই বয়সে তরুণ। এদিকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া বৃদ্ধ ব্যক্তির চারটি দাঁত পড়ে গেছে। তিনি বর্তমানে মিরপুরের ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে জানা গেছে। কমলাপুর জিআরপি থানার ওসি আলাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'ঘটনাটি জানার পরই আমরা অভিযান শুরু করি। ২৫ ডিসেম্বর সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক তথ্য উঠে আসে। পরে একে একে গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাঁচজনকে। বৃহস্পতিবার কালু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।' ওসি আরো জানান, এ চক্রের মূল হোতাকে ধরার জন্য অভিযান চলছে।
পুলিশ জানায়, ২৫ ডিসেম্বর রাতে প্রথমে আশকোনার বাসিন্দা শাহিনকে আটক করে পুলিশ। শাহিনকে দিয়ে ফাঁদ পেতে নরসিংদীর জিনারদী থেকে ডেকে আনা হয় চক্রের অপর সদস্যদের। কালু, দুর্জয়, মহাব্বত ও আকাশ নামে অপর চারজনকে আটক করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যে টঙ্গীর সজীব হোটেল থেকে দুই প্রকৌশলীর ছিনতাই হওয়া দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। গতকাল চার আসামিকে মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পাঁচ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আলমগীর হোসেন। আদালত দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাব্বত বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় ছদ্ম পেশা হিসেবে পপকর্ন বিক্রি করে। শাহিন বিক্রি করে আমড়া। কালু একেক সময় একেক ধরনের জিনিসপত্র ফেরি করে। দুর্জয় ও কালু স্টেশনে ঘুরে বেড়ায় আসল কাজের ধান্দায়। সুযোগ এলেই সবাইকে ইশারা দেওয়া হয়। লেডিস কাম করার জন্য বিমানবন্দর এলাকায় পুলিশের সোর্স আলম ও কালুকে ভাগও দিতে হয় তাদের। মহাব্বত ও দুর্জয় জানায়, শীতে ট্রেনে যাত্রী বেশি থাকে। তাই লেডিস কাম ভালো হয়। গত দেড় মাস ধরে চলন্ত ট্রেনে ছিনতাইও শুরু করে চক্রটি। ছিনতাইয়ের সময় নিরপরাধ যাত্রীদের কেন ফেলে দিয়েছে তা জানতে চাইলে তাদের একজন জবাব দেয়, 'বিল্লা করবো দেইখ্যা ফালাইয়া দেই।' ওদের ভাষায় বিল্লা মানে হলো ঝামেলা করা।
জানা গেছে, গত ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় আজিজুর রহমান নামের এক চিকিৎসককে গাজীপুরে তুরাগ এক্সপ্রেস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। আজিজুর রহমান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক এবং পলমল গার্মেন্টের চিকিৎসক হিসেবে কমর্রত ছিলেন। তাঁর ছেলে প্রকৌশলী রেজাউর রহমান বলেন, 'বাবার হত্যার ঘটনা জানিয়েছিলাম রেলওয়ে থানার ওসিকে। তিনি তদন্ত করা হচ্ছে বলে মামলা নেননি।' পুলিশ ও স্বজনরা ধারণা করছেন, গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের সদস্যরাই হত্যা করেছে আজিজুরকে। এ ব্যাপারে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া গত ১৭ ডিসেম্বর পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনে শারমিন সুলতানা নামে এক নারী ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন বলে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.