নাটোর থেকে ধরে আনা হয় পাক জেনারেল নাজারকে
মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে টিকতে না পেরে উত্তরাঞ্চলে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জেনারেল নাজার হুসেন সমস্ত ব্রিগেডকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন। খোঁজাখুঁজি করে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে নাটোর থেকে ধরে আনা হয় বগুড়ায়।
তারপর বগুড়া সেনানিবাসে মিত্র বাহিনীর ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল লাচমান সিংয়ের হাতে গুলিশূন্য পিস্তল দিয়ে উত্তরাঞ্চলের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ করেন জেনারেল নাজার। এ জেনারেলের নির্দেশে রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার পাকিস্তানী সেনারা উত্তরাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাসহ কয়েক লাখ নারী শিশু বৃদ্ধকে গুলি করে, জবাই করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চরম পৈশাচিকতায় হত্যা করে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকারের এমন বর্বরতার বহু চিহ্ন আজও রয়ে গেছে। সেদিনের দুর্ধর্ষ সেই হানাদার পাকিস্তানী জেনারেলের পরিণতি কী হয়েছিল তা জানা যায় তথ্য অনুসন্ধানে। ক্ষমা পাওয়ার পরও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে কতটা অকৃতজ্ঞ ও বেইমান সেই ঘটনাও বের হয়ে আসছে অনুসন্ধানে। ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখ থেকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাদের ছোট বড় সকল ইউনিট ভেঙ্গে পড়ে। উত্তরাঞ্চলে ৪ ব্রিগেডসমৃদ্ধ ১৬ ইনফেন্ট্রি ডিভিশন, আধা সামরিক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল নাজার হুসেন ডিভিশন সদর দফতর নাটোর থেকে বগুড়া সরিয়ে আনেন। ১০ ডিসেম্বর ভোরে বগুড়ার ওপর আক্রমণ শুরু হয়। মিত্র বাহিনীর ৬৪ মাউন্টেন রেজিমেন্টের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং বগুড়া শহরের উত্তরে লাঠিগাড়ি গ্রামে অবস্থান নেয়। শুরু“হয় সম্মুখ যুদ্ধ। টিকতে না পেরে ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার এলাহী বক্শ কিছু সৈন্য নিয়ে মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিংয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেন শহরতলির বৃন্দাবনপাড়ায়। বগুড়া পতনের পালায় বগুড়া সেনানিবাস থেকে জেনারেল নাজার কাপুরুষোচিতভাবে সেনাদের রেখে পালিয়ে যান। এর আগে মিত্র বাহিনীর ২০ মাউন্টের ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল লাচমান সিং তাঁর ব্রিগেড কমান্ডারদের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য দায়িত্ব দেন। এর মধ্যেই লাচমান সিং মেসেজ পান পাকিস্তানী জেনারেল নাজার পালিয়েছেন। খোঁজ করে জানেন জেনারেল নাজার নাটোরে লুকিয়ে আছেন। তাঁকে আনার জন্য জেনারেল লাচমান আত্মসমর্পণ করা দু’জন পাকিস্তানী কর্নেলকে নিরাপত্তা দলসহ নাটোর পাঠিয়ে দেন ১৭ ডিসেম্বর। জেনারেল নাজারকে বগুড়া আনতে ব্যর্থ হলে জেনারেল লাচমান সিং ১৬৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার রাঘুবির সিংকে হেলিকপ্টারে নাটোর পাঠান। ১৮ ডিসেম্বর জেনারেল নাজারকে ধরে আনা হয় বগুড়ায়। ওই দিন বিকালে বগুড়া সেনানিবাসে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর জেনারেল নাজার উত্তরাঞ্চলের ৩শ’ ৪ অফিসার, ৩শ’ ৭১ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও), ১১ হাজার ২শ’ ১৮ জন অন্যান্য পদবির সৈনিক, ৩ হাজার আধা সামরিক বাহিনী, নয়টি ট্যাঙ্ক, ২৫ টি কামান, প্রায় ১১ হাজার হালকা ও মাঝারি অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে। হানাদারদের আত্মসমর্পণের আগের দিনের এক ঘটনা- পাবনার সুজানগর উপজেলার (তখন থানা) রানীনগর ইউনিয়নের ভটিকয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাহ বিজয়ের আনন্দের সঙ্গে হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নিহত হওয়া ছোটভাই মুক্তিযোদ্ধা বুলবুলের (১৯) স্মৃতি নিয়ে বেদনা বিভূর হয়ে আছেন। এমন সময় হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পরাজিত ক্যাপ্টেন আমিন পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। জিন্নাহ ক্যাপ্টেন আমিনকে বেঁধে নিয়ে আসেন মা রোকেয়া বেগমের সামনে।বাড়ির উঠানে বেঁধে রেখে মাকে বলেন সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিতে। জিন্নাহ ছোরা নিয়ে এগিয়ে যেতেই মা রোকেয়া বেগম ক্যাপ্টেন আমিনের সামনে গিয়ে পথ রোধ করেন। বলতে থাকেন সন্তান হারানোর বেদনা তিনি বোঝেন। চান না আর কোন মায়ের বুক খালি হোক। হতবাক হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। তারপর ওই গ্রামেই আশ্রয় হয় তাঁর। পরিবারের সঙ্গে মিশে যান। বিয়ে দেয়া হয় জিন্নার এক জ্ঞাতি বোনের সঙ্গে। ভূমিষ্ঠ হয় ২ সন্তান। ক্যাপ্টেন আমিন ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে বিদেশ পাড়ি দিয়ে বহু টাকার মালিক হন। ডিভোর্স দেন স্ত্রীকে। ক্ষমার মূল্য, সন্তানতূল্য ভালোবাসার প্রতিদান দেন এভাবেই। অকৃতজ্ঞ এই ক্যাপ্টেন আমিন ছিলেন উত্তরাঞ্চলে মেজর জেনারেল নাজারের কমান্ডের অধীনের একজন অফিসার। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সার্চ এ্যান্ড ডেসট্রয় অপারেশন পরিচালনা করেন তিনি। কয়েক হাজার বাঙালীকে পৈশাচিকভাবে হত্যা ও সম্ভ্রমহানি করেন বাঙালী নারীর। এই পাকিস্তানী সেনাদের সহচর ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত চক্র।
Ñসমুদ্র হক, বগুড়া
No comments