আরও হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি by শওকত হোসেন

রাষ্ট্রমালিকানাধীন সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে অর্থ লুটপাটের আরও ঘটনা জানা গেছে। অভিনব উপায়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। আবার নথিতে নাম পরিবর্তন করে অন্য নাম বসিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারাও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকার হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া আরও ৫৮টি প্রতিষ্ঠানকে এই অর্থ দিয়েছে সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে এখন ৪০টি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক। এই ৪০ প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। বাকি কোম্পানিগুলোর সাইনবোর্ড থাকলেও উৎপাদন বন্ধ বা অন্য ধরনের পণ্য তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানগুলো অখ্যাত। কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবার হল-মার্কেরও সংশ্লিষ্টতা আছে।
অভিনব এ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে এ বছরের শুরুর দিকে। এর সঙ্গে অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জড়িত। অন্য ব্যাংকে স্থানীয় ঋণপত্র খোলা হয়েছে, আর সেই সব ঋণপত্রের বিল গ্রহণ করেছে সোনালী ব্যাংক। অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, ঋণপত্র (এলসি) জাল, কোম্পানিও ভুয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এই অর্থ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ঋণ দিলে তার কিছু আদায় হয়। কিন্তু এগুলো তো ঋণ নয়, পরিষ্কার জালিয়াতি। সুতরাং অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই।
সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পোশাক খাতের বিভিন্ন কাঁচামাল এখন দেশেও উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সুতা, কাপড়সহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য পণ্য রয়েছে। পোশাক রপ্তানিকারীরা এসব কাঁচামাল এখন দেশ থেকেই কেনে, তবে অর্থ পরিশোধ করে রপ্তানির অর্থ পাওয়ার পর। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক স্থানীয় কোম্পানিকে আগেই অর্থ পরিশোধ করে দেয়। আর এ জন্য স্থানীয় ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র খুলতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এক ব্যাংকে স্থানীয় ঋণপত্র খোলা হলেও আরেকটি ব্যাংক (যার কাছে মূল রপ্তানি ঋণপত্র রয়েছে, এ ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংক) তা গ্রহণ করে। দেখা গেছে, ওই এক হাজার কোটি টাকার ক্ষেত্রে সব কটি এলসির বিলে সম্মতি দিয়েছে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা (সাবেক শেরাটন)।
যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো কাঁচামালই সরবরাহ করা হয়নি, ফলে রপ্তানিও হয়নি কোনো পণ্য। অথচ কাঁচামাল সরবরাহের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করা হয়েছে।
আত্মসাৎ করা অর্থের সঙ্গে বহুল আলোচিত হল-মার্ক গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা আছে। যে কয়টি কোম্পানির অস্তিত্ব আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে এই সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যায়। কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের দাবি, তাঁরা হল-মার্ক গ্রুপকে কাঁচামাল সরবরাহ করেছেন, তবে এখনো কোনো অর্থ পাননি।
ব্যাংক খাত সূত্রে জানা গেছে, রূপসী বাংলা শাখার সম্মতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি স্থানীয় ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র খুলেছে বা কিনেছে জনতা, অগ্রণী ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো সোনালী ব্যাংকের সম্মতি নিয়ে এলসির অর্থ পরিশোধ করেছে। কিন্তু হল-মার্ক কেলেঙ্কারি জানাজানি হওয়ায় সম্মতি দিয়েও সোনালী ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোকে অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। নিয়ম হচ্ছে, অন্য ব্যাংক সম্মতি দিলেও ঋণপত্র খোলার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংককেই কোম্পানি যাচাই করে নিতে হবে। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা-ও করেনি।
সোনালী ব্যাংক পরিদর্শন করে দেখেছে যে, সব কটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে অর্থ জালিয়াতির সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে এক ব্যাংক ইচ্ছেমতো ঋণপত্র খোলার সুযোগ দিয়েছে, আর অন্য ব্যাংক তা গ্রহণ করেছে। তবে জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্যও ঋণপত্র কিনতে বাধ্য করেছিলেন। জনতা ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠিত হলেও ওই পরিচালক আবারও সদস্য হয়েছেন।
সোনালী ব্যাংক সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্থ আত্মসাতের বিস্তারিত বিবরণ পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে লেখা এক চিঠিতে সোনালী ব্যাংক বলেছে, সরবরাহকারী অন্য ব্যাংকে রাখা মূল ঋণপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে কোম্পানির মালিকদের নাম-ঠিকানা মুছে ফেলে বা কাটাকাটি করে পরিবর্তন করা হয়েছে। আবার রূপসী বাংলা শাখাও যাচাই না করে ভুয়া কোম্পানির নামে অর্থায়ন-সুবিধা দিয়েছে। এভাবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহায়তায় নতুন একজনের নাম বসিয়ে তার অনুকূলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়।
সোনালী ব্যাংকে অবাধে এসব জালিয়াতির সুযোগ করে দিয়েছিলেন রূপসী বাংলা শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে অন্য ব্যাংকের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে লেখা চিঠিতে বলেছে, অস্তিত্বহীন কোম্পানির বাস্তব অস্তিত্ব ও উৎপাদনক্ষমতা যাচাই না করেই ভুয়া চুক্তি বা ঋণপত্র স্থাপন এবং পণ্য সরবরাহে নিশ্চিত না হয়ে সম্মতি (অ্যাকসেপট্যান্স) দিয়ে শেরাটন শাখা যেমন গর্হিত অপরাধ করেছে, তেমনি সরবরাহকারী অন্যান্য ব্যাংক ওই সব নামসর্বস্ব কোম্পানির অস্তিত্ব, উৎপাদনক্ষমতা, বিনিয়োগ বোর্ডের সনদ, বিটিএমএর সদস্যপদ এবং কেওয়াইসি (নো ইয়োর কাস্টমার) সনদ যাচাই না করে বিলে (অ্যাকসেপট্যান্স বিল) সম্মতি বা অর্থায়ন করাও সমান গর্হিত অপরাধ। মূলত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অন্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা রূপসী বাংলা শাখাকে সহায়তা দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়াকে উৎসাহিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের পরিদর্শক দল ঋণপত্রের নথি দেখে ৫৮টি কোম্পানির নাম উদ্ধার করেছে। ৫৮টি কোম্পানির কারখানা পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪০টি কোম্পানির কারখানার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অথচ কাগজে-কলমে এসব কারখানা থেকে পণ্য তৈরি করে সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি ১৮টি কোম্পানির কারখানা পাওয়া গেছে। তবে সেখানে যে মানের সুতা উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে শুধু বিছানার চাদর, তোয়ালে-জাতীয় পণ্য ও লুঙ্গি তৈরি করা যায়। অথচ নথিতে রপ্তানিযোগ্য সুতা সরবরাহের কথা বলা আছে। আবার কিছু কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর শুধু সাইনবোর্ডই আছে, অন্য কিছু নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোম্পানি একাধিক হলেও ঠিকানা ও ফোন নম্বর একই।
অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং ও আনোয়ারা স্পিনিং মিলের প্রধান কার্যালয় একই ঠিকানায়। ব্যাংকের নথিতে রাখা ফোন নম্বরও এক। গতকাল শুক্রবার সেখানে ফোন করে তা বন্ধ পাওয়া যায়। আবার সরদার প্রিন্টিং ও স্টার লিট গার্মেন্টসের প্রধান কার্যালয় একই ঠিকানায়। প্রতিষ্ঠান দুটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফোনে বলেন, এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না। তবে তাঁরা হল-মার্ক গ্রুপের সঙ্গে ব্যবসা করেন। অস্তিত্বহীন মাস্টার্স কটন ইয়ার্ন নামের একটি কোম্পানির এমডি বলেন, তাঁরা মূলত ট্রেডিং ব্যবসা করেন।
নথি অনুযায়ী আলভী স্পিনিং মিল ৫২ লাখ ডলারের সুতা সরবরাহ করেছে। কিন্তু ব্যাংকের পরিদর্শক দল দেখেছে, এই পরিমাণ সুতা উৎপাদনের ক্ষমতাই তাদের নেই। আবার তারা যে ধরনের সুতা উৎপাদন করে, তা রপ্তানিযোগ্য নয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির এমডি আমিনুল হক চৌধুরী গতকাল দাবি করেন, হল-মার্ক গ্রুপকে তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী সুতা সরবরাহ করেছেন। তবে কী পরিমাণ সরবরাহ করেছেন, তা তাঁর মনে নেই।
সোহেল টেক্সটাইল ১১ লাখ ডলারের সুতা সরবরাহ করেছে। অথচ কোম্পানি কারখানায় তুলা থেকে সুতা তৈরির কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। কোম্পানির ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) তরুণ কুমার বড়ুয়া বলেন, ট্রেডিং ব্যবসার আওতায় তাঁরা সুতা সরবরাহ করেছিলেন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে সোনালী ব্যাংকের কেউ কথা বলতে চাননি।

অস্তিত্বহীন কোম্পানির তালিকা
সোনালী ব্যাংক পরিদর্শন করে ৪০টি কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। এগুলো হচ্ছে: ম্যাক্স স্পিনিং, আনোয়ারা স্পিনিং, সরদার প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, স্টার লিট গার্মেন্টস এক্সেসরিজ, মাস্টার কটন ইয়ার্ন, এবিএস স্পিনিং, সাউথ কম্পোজিট, ব্রডওয়ে স্পিনিং, সমতা টেক্সটাইল, সমতা ইয়ার্ন ট্রেডিং, অনন্ত কটন, ঢাকা ইয়ার্ন অ্যান্ড টেক্সটাইল, উত্তরা ইয়ার্ন অ্যান্ড টেক্সটাইল, আনজুমান স্পিনিং, ওশেন রোটর অ্যান্ড স্পিনিং, সুফিয়া অ্যাসোসিয়েটস, আমজাদ এন্টারপ্রাইজ, প্রমি এন্টারপ্রাইজ, তানিয়া এন্টারপ্রাইজ, দ্য বেস্ট ইয়ার্ন, জিয়া ট্রেডার্স, গোমতি এন্টারপ্রাইজ, সৈয়দ মুর্তজা কটন অ্যান্ড ইয়ার্ন, সঞ্জনা টেক্সটাইল, স্ট্রং প্লাস করপোরেশন, ম্যাস কটন, ম্যাস টেক্সটাইল অ্যান্ড স্পিনিং, একে কটন ইয়ার্ন ট্রেডিং, রিসোর্স (বিডি) সার্ভিসেস, বিসমিল্লাহ স্পিনিং, অপসোনিন টেক্সলাইফ, ডানা টেক্সটাইল, তৈয়বা রোটর অ্যান্ড স্পিনিং, জেএন টেক্সটাইল ও আটলান্টিক লিমিটেড।
এর বাইরে আরও কিছু কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা কম বা অন্য ধরনের পণ্য সরবরাহ করে। যেমন: আলভি স্পিনিং মিলের উৎপাদনক্ষমতা কম। সোহেল টেক্সটাইল গ্রে কাপড় উৎপাদন করে অথচ সরবরাহ করেছে ১১ লাখ ডলারের সুতা। সোহেল স্পিনিং মিলের কোনো বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংযোগ নেই, কিন্তু সরবরাহ করেছে ৮৬ লাখ ডলারের সুতা। আটলান্টিক টেক্সটাইল নথি অনুযায়ী এক লাখ ২০ হাজার ডলারের সুতা সরবরাহ করলেও কারখানার অস্তিত্ব নেই। সাদাপুর টেক্সটাইল সাড়ে ৪৬ লাখ ডলারের সুতা সরবরাহ করলেও তাদের কারখানায় সুতা তৈরির কোনো যন্ত্রপাতি নেই। গ্রিন বাংলা স্পিনিংয়ের সুতা টেরিটাওয়েল ও বিছানার চাদর তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, অথচ তারা উন্নতমানের সুতা সরবরাহ করেছে ১৪ লাখ ডলারের। রায়হান প্যাকেজিংয়ের উৎপাদন নেই, অথচ ২০ লাখ ডলারের পণ্য সরবরাহ করেছে। অ্যাকুরেট প্যাকেজিংয়েরও উৎপাদন বন্ধ, কিন্তু নথিতে আছে যে তিন লাখ ডলারের পণ্য সরবরাহ করেছে তারা।
একইভাবে প্রায় দুই লাখ ডলারের কার্টন সরবরাহকারী ইকরা প্যাকেজিংয়ের উৎপাদন বন্ধ। ৪৫ লাখ ডলারের সুতা সরবরাহকারী সিনথেটিক ইয়ার্নের মালিকেরা এ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। প্রায় নয় লাখ ডলার মূল্যের কাপড় সরবরাহকারী এশা নিটেক্সের কোনো উৎপাদন নেই। প্রায় তিন লাখ ডলারের সুতা সরবরাহ করলেও রওনক টেক্সটাইলের সুতা তৈরির কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। নাকিব স্পিনিং ১৯ লাখ ডলারের সুতা সরবরাহ করলেও উৎপাদনক্ষমতা এর চেয়ে কম। মাহবুব রোটর স্পিনিং, মাহবুব স্পিনিং ও খান রোটর একই ঠিকানায় অবস্থিত। আলাদা অস্তিত্ব বের করতে পারেনি পরিদর্শক দল। তারা এক কোটি ডলারের বেশি সুতা সরবরাহ করলেও উৎপাদনক্ষমতা এর চেয়ে কম। ১৫ লাখ ডলারের সুতা সরবরাহকারী মা এয়ারজেট স্পিনিং ছয় মাস ধরে বন্ধ। সাড়ে চার লাখ ডলারের সুতা সরবরাহ করলেও এ বিষয়ে কিছুই জানে না রায়া স্পিনিং মিলের মালিকপক্ষ।

No comments

Powered by Blogger.