দুর্নীতির শীর্ষে শ্রম অভিবাসন খাত-বদলায়নি পুলিশ
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জাতীয় খানা জরিপে দেশের সব সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শ্রম অভিবাসন খাত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, শ্রম অভিবাসন খাত এবারই প্রথম এই জরিপের আওতায় এসেছে। সে হিসেবে আগের তুলনামূলক মাপকাঠিতে শ্রম ও অভিবাসন খাতকে আলাদা করে দেখলে এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাই সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে টিকে আছে, তাদের অবস্থান খুব একটা বদলায়নি, এটা
খুবই উদ্বেগের বিষয়।
জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শ্রম অভিবাসন খাতে সেবা গ্রহণকারী খানার ৭৭ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। দুর্নীতির ধরনের মধ্যে ছিল চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া (৫৪.১%), টাকা আত্মসাৎ (৪৮.২%), চুক্তি অনুযায়ী কাজ না দেওয়া (১৮.৩%), অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ (১১.৬%), চুক্তি অনুযায়ী বেতন না দেওয়া (১১.১%) এবং অন্যান্য ধরনের দুর্নীতি (০.৯%)। এ খাতে সেবা গ্রহণকারী নারীদের ৮৫.৭% এবং পুরুষদের ৭৬.৯% দুর্নীতির শিকার হয়েছে। খানা থেকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া বা টাকা আত্মসাতের পরিমাণ গড়ে এক লাখ ৯৯ হাজার ৬৭৬ টাকা। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন টাকার পরিমাণ ১৬ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা।
টিআইবির প্রতিবেদনে শ্রম অভিবাসন খাতের সেবা বলতে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া সেবা বোঝানো হয়েছে। এ খাতে জড়িত হচ্ছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি), রিক্রুটিং এজেন্ট, বোয়েসেল এবং পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, বন্ধু বা পরিচিত ব্যক্তি ও দালাল; যারা শ্রম অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত থাকে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান লাভ করেছেন ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩৩ জন বাংলাদেশি কর্মী। টিআইবির জরিপের নির্ধারিত সময়ে শ্রম অভিবাসন-সংক্রান্ত সেবা নিয়েছে জরিপ করা খানার ৩.২%। ২.৫% খানার কোনো না কোনো সদস্য এই সময়ে কাজের জন্য দেশের বাইরে গেছেন এবং ১% খানার কোনো না কোনো সদস্য কাজের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ টাকা জমা দিয়েছেন। এ খাতে সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে পুরুষ ৯৬.৭% ও নারী ৩.৩%। শ্রম অভিবাসন-সংক্রান্ত সেবাগ্রহীতা খানাগুলোর সদস্যরা যেসব দেশে গেছেন বা যাওয়ার উদ্দেশ্যে টাকা জমা দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে আরব আমিরাত (৪৩.৫%), ওমান (২৪.১%), সৌদি আরব (৯.১%), ব্রুনাই (৪%), সিঙ্গাপুর (৩.৭%), ইতালি (৩.১%) ও অন্যান্য দেশ (১৪.২%)। শ্রম অভিবাসন খাতে সেবা গ্রহণকারীরা যে ধরনের ভিসা নিয়ে বিদেশ গেছেন বা শ্রম অভিবাসনের উদ্দেশ্যে যে ধরনের ভিসার জন্য টাকা জমা দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক নির্দিষ্ট মেয়াদি কর্ম ভিসা (৮৮.৬%), ফ্রি ভিসা (৬.৯%), ভ্রমণ বা ট্যুরিস্ট ভিসা (২.৭%), শিক্ষা ভিসা (০.৯%), হজ বা ওমরা ভিসা (০.৫%) ও অন্যান্য ধরনের ভিসা (০.৬%)।
জরিপে দেখা যায়, শ্রম অভিবাসন সেবা গ্রহণকারী খানাগুলো বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ভিসা কিনেছে বা কেনার জন্য টাকা জমা দিয়েছে। জরিপ করা সেবা গ্রহণকারী খানার ৬৩.৭% পরিবারের সদস্য, আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তি, ২১.৩% রিক্রুটিং এজেন্সি, ১৫.৬% দালাল, ০.৭% বোয়েসেল এবং ১.৯% অন্যান্য মাধ্যম থেকে ভিসা কিনেছে বা কেনার জন্য টাকা জমা দিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা : টিআইবির জরিপের অন্তর্ভুক্ত খানার ৯.২% বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবা গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক (৭৩.৩২%) সেবা গ্রহণ করে থানা পুলিশের কাছ থেকে; এর পরেই রয়েছে যথাক্রমে স্পেশাল ব্রাঞ্চ পুলিশ (১৭.৪%) ও ট্রাফিক পুলিশ (১০.৯%)। টিআইবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সেবা নেওয়া হয় জমিজমা-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে (২৫.৩%)। এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট, চাকরি এবং অন্যান্য কাজের জন্য 'পুলিশ ভেরিফিকেশন' (১৭.৫%)। এ ছাড়া মারামারি (১৩.৯%), ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন (৯.৫%), গাড়ি রিকুইজিশন (৬.৭%), নারী ও শিশু নির্যাতন (৫.৮%), চুরি ও ডাকাতি (৫.৩%), হত্যা (৪.৬%), মূল্যবান দ্রব্য হারানো (৪.৬%), ভয়ভীতি (৩.৩%), পুলিশ কর্তৃক চাঁদাবাজি (২.৭%), অর্থ ও সম্পদ আত্মসাৎসহ অন্যান্য সমস্যার কারণেও সেবাগ্রহীতারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার দ্বারস্থ হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবা নেওয়া খানার মধ্যে ৪১.২% বাদী হিসেবে অভিযোগ করেছেন এবং ৪৪.৯% বিবাদী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছেন। বাকি ১৩.৬% খানা পাসপোর্ট, চাকরি বা অন্যান্য কাজে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য যোগাযোগ করেছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতি বা হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৫.৮% খানা; গ্রামাঞ্চলের সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৭৯.৩% এবং শহরাঞ্চলের সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে ৬৯.৬% দুর্নীতির শিকার হয়। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয় হাইওয়ে পুলিশ (৮৮.৯%) ও ট্রাফিক পুলিশের (৮৮.২%) মাধ্যমে। এর পরেই রয়েছে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (৮৩.৬%) ও থানা পুলিশ (৭৩.৬%)।
এ খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের ধরন সম্পর্কে জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, সেবাগ্রহীতা খানাগুলোর মধ্যে যারা দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খানা (৮৯%) ঘুষ দেয় বা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। এর পরেই রয়েছে মিথ্যা মামলায় জড়ানো (১৪.৪%) ও অসদাচরণ বা ভয়ভীতি প্রদর্শন (১৪.৪%)। এ ছাড়া জিডি বা এফআইআর গ্রহণে অবহেলা বা সময়ক্ষেপণ (১১.৭%), ভেরিফিকেশন বা ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিতে দেরি করা বা মিথ্যা তথ্য দেওয়া (৫.৯%), মিথ্যা এফআইআর বা চার্জশিট প্রদানসহ (৩.৬%) অন্যান্য ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়।
ঘুষ দেওয়ার হার ও পরিমাণ : সবচেয়ে বেশি খানা ঘুষ দিয়েছে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে (৮৩.১%); এর পরেই রয়েছে হাইওয়ে পুলিশ (৮০.৭%) ও ট্রাফিক পুলিশ (৮০.৬%)। ঘুষ গ্রহণের হারের দিক থেকে থানা পুলিশ সবচেয়ে কম হারে (৬৩.১%) ঘুষ গ্রহণ করলেও পরিমাণের দিক থেকে তারা সবচেয়ে বেশি ঘুষ নেয়, যা খানাপ্রতি গড়ে সাত হাজার ৯১৩ টাকা।
স্বাস্থ্য খাত : টিআইবির প্রতিবেদন অনুসারে ২০১০ সালের তুলনায় দুর্নীতির হার বেড়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এ খাতে দুর্নীতি ২০১০ সালের ৩৩.২ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ৪০.২ শতাংশে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ে ৭৯.৯% খানা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে। এর মধ্যে ৫০.২% সরকারি, ৬৪.১% বেসরকারি এবং ১.০% এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে এ জরিপে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শুধু সরকারি স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, যেসব খানা সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে তার ৪০.২% কোনো না কোনো সেবা নিতে গিয়ে ভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। সেবাগ্রহণকারী খানার ২১.৫% সেবা পেতে নিয়মবহির্ভূতভাবে (রসিদ ছাড়া) গড়ে ২৫৮ টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া সেবাগ্রহণকারী খানার মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫.২% ডাক্তার দেখানোর সময় কক্ষে ওষুধ কম্পানির প্রতিনিধির উপস্থিতি, ১১.৪% জরুরি মুহূর্তে ডাক্তার না পাওয়া, ১০.১% ডাক্তার দেখানোর ক্ষেত্রে সিরিয়াল ভঙ্গ এবং ৬.২% হাসপাতালের ভেতরে দালালদের হাতে হয়রানির শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ করে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিষ্ঠানের ধরনভেদে দুর্নীতি ও অনিয়মের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে সেবাগ্রহণকারী খানাগুলোর সর্বাধিক (৩৫.০%) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ৭.২% অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে (বিশেষায়িত হাসপাতাল, সরকারি মাতৃসদন ইত্যাদি) বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হয়।
খাতভিত্তিক সেবা গ্রহণকারী খানার মধ্যে সর্বাধিক ৩২.৬% অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছে। এ ছাড়া ট্রলি ব্যবহারে ২০%, ব্যান্ডেজ ও ড্রেসিং করানোর জন্য ১৭.৩%, প্রসূতি সেবায় ১৭%, অপারেশন সেবায় ১২.১%, ইনজেকশন/স্যালাইন গ্রহণে ১২.১%, হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ১১.৪%, শয্যা বা কেবিন পাওয়ার জন্য ১০.৪%, টিকিট কেনায় ৯.৩% এবং ডাক্তার দেখানোর জন্য ৮.৭% খানা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়েছে।
No comments