মাঘের কাঁপন হার মেনেছে পৌষেই!

হিমাঙ্কের পারদ ক্রমেই নামছে। পৌষেই যেন জেঁকে বসেছে মাঘের শীত। খোদ রাজধানী ঢাকায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। আর যশোরে গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
চলমান এই মৃদু শৈত্যপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলেও। ঘন কুয়াশা, দিনভর সূর্যের দেখা না পাওয়া- সব মিলিয়ে শীতে কাঁপছে পুরো দেশ। ফেরি ও নৌ চলাচলেও ঘটছে বিপত্তি। গতকাল শীত ও শীতজনিত কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা গেছে আরো আটজন।
এই অবস্থা শিগগিরই কাটছে না। আবহাওয়া অফিস বলছে, চলতি শৈত্যপ্রবাহে বিরতি না দিয়ে অচিরেই শুরু হচ্ছে মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনায় তখন কনকনে ঠাণ্ডা আরো বাড়বে।
আবহাওয়াবিদ আব্দুল আলীম গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, চলতি মৃদু শৈত্যপ্রবাহটি এখন বিস্তৃতি লাভ করে ঢাকা, সিলেট, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। শৈত্যপ্রবাহের শেষে সম্ভাবনা রয়েছে বৃষ্টিপাতের। বৃষ্টির কারণে শীতের প্রকোপও বাড়বে।
সেই সঙ্গে শুরু হবে আরেকটি শৈত্যপ্রবাহ। জানুয়ারি মাসজুড়ে মাঝারি থেকে তীব্র আকারের দু-তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি শৈত্যপ্রবাহটি আরো দু-এক দিন অব্যাহত থাকবে। এ সময় রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকার কথা। নদী অববাহিকায় মধ্যরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘন কুয়াশা এবং অন্যত্র মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। আজ শনিবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৪ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকতে পারে। এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে। সে সময় উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে দু-একটি মাঝারি (৬-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে তীব্র (৪-৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার) শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের অন্যত্র দু-তিনটি মৃদু (৮-৯ ডিগ্রি) থেকে মাঝারি (৬-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার) শৈত্যপ্রবাহ থাকতে পারে।
সারা দেশের পরিস্থিতি
শীত ও শীতজনিত রোগে গতকাল ও বৃহস্পতিবার রাতে কুড়িগ্রামে দুজন, পিরোজপুরে তিনজন, পটুয়াখালীতে একজন ও বরিশালে দুজন মারা গেছে। এ ছাড়া ঘন কুয়াশার কারণে দেশের সবচেয়ে বড় দুই ফেরি পারাপারের রুট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও মাওয়া-কাওরাকান্দিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। আমাদের স্থানীয় অফিস, নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ :
কুড়িগ্রাম : শীতজনিত রোগে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে গতকাল ভোরে এক দিন বয়সী একটি শিশু এবং সকালে কেতকেতু (৪০) নামের এক ব্যক্তি মারা যান। এ নিয়ে শুধু সদর হাসপাতালে চলতি মাসে শীতজনিত রোগে ২২টি শিশুসহ ২৫ জনের মৃত্যু হয়। গতকাল সকাল ১১টা পর্যন্ত জেলা শহরের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ ছিল।
পিরোজপুর : কোল্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে নাজিরপুর উপজেলার যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বুইছাকাঠি গ্রামের মো. ফিরোজ আহম্মেদ খসরু (৪৮) এবং একই উপজেলার ইউপি সদস্য রুস্তম আলী হাওলাদারের মা গহরজান বিবি (৭২) মারা গেছেন। এ ছাড়া প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভাণ্ডারিয়া উপজেলায় মারা যায় সুমন (৯) নামের দ্বিতীয় শ্রেণীর একটি স্কুলশিশু। পারিবারিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি সূত্র এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
বরিশাল : আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়ে মারা গেছেন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার আন্দুয়া গ্রামের রুবি বেগম (৪০) নামে এক গৃহবধূ। বুধবার ঘরের সামনে খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করার সময়ে তাঁর পরনের কাপড়ে আগুন লেগে তিনি অগ্নিদগ্ধ হন। গতকাল দুপুরে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ নিয়ে গত দুই দিনে বরিশালের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যু এবং ১৫ জন অগ্নিদগ্ধ হয়।
গৌরনদী : বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারা দিনেও সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি। তীব্র ঠাণ্ডার কারণে বৃহস্পতিবার রাতে আগৈলঝাড়া উপজেলার আস্কর গ্রামে সুখরঞ্জন বাড়ৈ (৬৫) এবং দুপুরে পয়সারহাট বন্দরের কাঁচামাল ব্যবসায়ী উপজেলার পূর্ব সুজনকাঠি গ্রামের জেন্নাত আলী মোল্লা (৪৫) নামের দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
রাজবাড়ী : গরম কাপড় না থাকায় রান্নার চুলার আগুনে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে গিয়ে গতকাল সকালে পারভীন খাতুন (১৩) নামে তৃতীয় শ্রেণীর এক দরিদ্র স্কুলছাত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। তাকে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। সে জেলা সদরের উড়াকান্দা গ্রামের জয়নাল প্রামাণিকের মেয়ে।
চুয়াডাঙ্গা : তীব্র শীতের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সন্ধ্যার পরপরই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তীব্র শীতে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
গাইবান্ধা : পর্যাপ্ত শীতের কাপড় না থাকায় তীব্র কষ্টে দিন কাটছে গাইবান্ধা জেলার দরিদ্র মানুষের। গতকাল গাইবান্ধা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ফুলছড়ির বালাসীঘাট ঘুরে দেখা গেছে তীব্র শীতে কষ্ট পাচ্ছে চর এলাকার মানুষজন। কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক মুন্না জানান, সরকারিভাবে ১৯৭টি কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
বিপর্যস্ত ফেরি চলাচল
মুন্সীগঞ্জ ও শিবচর : ঘন কুয়াশার কারণে মাওয়া-কাওরাকান্দি নৌ-রুটে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সব ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। এর ফলে উভয় ঘাট এলাকা থেকে মহাসড়কের অনেক দূর পর্যন্ত বিশাল যানজটের সৃষ্টি হয়। আর মাঝ-পদ্মায় আটকা পড়ে সাতটি ফেরির প্রায় দুই হাজার যাত্রী কনকনে শীতে চরম বিড়ম্বনায় পড়ে। বিআইডাব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক চন্দ্র শেখর ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া ঘন কুয়াশার কারণে পদ্মা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীতে চলাচলকারী অন্য নৌযানগুলোও নোঙর করে।
মানিকগঞ্জ : ঘন কুয়াশার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটেও বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে গতকাল সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। এতে পাটুরিয়া ঘাটে চার কিলোমিটার এবং দৌলতদিয়া ঘাটে পাঁচ কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। বিআইডাব্লিউটিসির আরিচা এরিয়া ম্যানেজার (কমার্স) আশরাফুল্লাহ খান এর সত্যতা নিশ্চিত করেন।

No comments

Powered by Blogger.