শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন- ছিলেন ফেরিওয়ালা হলেন রপ্তানিকারক by নিজাম সিদ্দিকী
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কর্নেলহাট বাজারের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে একটি সরু গলি। এর একেবারে শেষ মাথায় একটি ঘরে বড় একটি চৌবাচ্চায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে ধবধবে সাদা কচুর ছড়া।
ছড়ার চামড়া ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত একদল নারী। মাটিতে বসে কোটাকুটি করছেন। পাশাপাশি কয়েকজন তরুণ এগুলো বস্তা থেকে বের করে এক জায়গায় জড়ো করে রাখছেন।
এটি অহিদুল আলমের সবজির আড়ত। এই আড়ত থেকে কাটাছাঁটা সবজিগুলো চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে অহিদুল গড়ে তুলেছেন এই আড়ত। একসময় ফেরি করে সবজি বিক্রি করতেন তিনি। নিজের চেষ্টা, পরিশ্রম ও বুদ্ধিতে আজ তিনি একজন রপ্তানিকারক।
যেভাবে শুরু: দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি অহিদুল। খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁকে রোজগারে নামতে হয়। দেশ স্বাধীনের পর একসময় নিজেই মাথায় করে সবজি বিক্রি করতেন। ১৯৭৮ সালের দিকে তিনি কর্নেলহাট তরকারির বাজারে আরেকজনের দোকানের সামনে বসার জায়গা করে নেন।
সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন অহিদুল। ঠিক সময়ে দোকান খুলতেন। আর যতক্ষণ বাজারে ক্রেতা থাকত, ততক্ষণ পর্যন্ত খোলা থাকত তাঁর দোকান। ধীরে ধীরে ব্যবসার উন্নতি হতে থাকে।
এরপর নিজেই একটি দোকানের মালিক বনে যান। অহিদুলের দোকান থেকে নিয়মিত সবজি নিয়ে যাওয়া হতো গ্ল্যাক্সো বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মচারী ক্যানটিনের জন্য।
এভাবে একসময় গ্ল্যাক্সোর কর্মচারীদের কাছ থেকে বিদেশে সবজি পাঠানোর ধারণা পান অহিদুল। ১৯৯০ সালে তিনি প্রথম দুবাইয়ে সবজি পাঠাতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি পাহাড়তলীর কর্নেলহাট এলাকায় ‘গাউছে ভান্ডার স্টোর’ নামে একটি আড়ত প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেই বিভিন্ন স্থান থেকে আনা সবজি সংরক্ষণ, কাটা, ধোয়ামোছার কাজ চলতে থাকে।
কারা কাজ করছেন: অহিদুলের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে গোল হয়ে বসে কাজ করছেন নারীরা। আমেনা বেগম নয় বছর ধরে এখানে সবজি কাটার কাজ করছেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে পান চিবোতে চিবোতে কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘স্বামী-পোলাপাইন লইয়া আল্লাহর রহমতে ভালাই আছি। সাড়ে চার হাজার টাকা ঘরভাড়া দিয়া থাকি।’
আংকারা বেগম প্রায় নয় বছর ধরে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। স্বামী, পাঁচ ছেলেসহ থাকেন কর্নেলহাট এলাকায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আড়তে কাজ করেন। বেতন পান সাপ্তাহিক ভিত্তিতে।
অহিদুল জানান, প্রায় দেড় হাজার নারী তাঁর আড়তে কাজ করেন। প্রতি কেজি সবজি কাটা বাবদ তাঁরা একেকজন পাঁচ টাকা করে পান।
সবজি সংগ্রহ ও রপ্তানি: যেসব রপ্তানি করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে: ঝিঙে, চিচিঙা, করলা, কাঁকরোল, বরবটি, পটোল, ঢ্যাঁড়স, কচুর লতি, পাইন্যা কচু, কচুর ছড়া, লালশাক, পুঁইশাক, লাউশাক, কাঁঠালের বিচি, জলপাই, কালো জাম, টক বরই প্রভৃতি।
নরসিংদী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, যশোর, বগুড়া, মেহেরপুর, কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি থেকে ভালো মানের সবজি সংগ্রহ করে আনা হয় ট্রাকে করে। এসব সবজি যায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, কানাডা প্রভৃতি দেশে।
অহিদুল সিমার্ক ফিশারিজ ও কোস্টার শিপ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপে সবজি রপ্তানি করেন। তাঁর আড়তে সবজি কাটা ও ধোয়ামোছার পর সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রসেসিং প্ল্যান্টে। সেখানে সবজি প্যাকেটজাত করে হিমাগারে রেখে দেওয়া হয়। এরপর বিদেশ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর সেগুলো জাহাজীকরণ (শিপমেন্ট) করা হয়।
আয়ের পরিমাণ: প্রতি মাসে সবজি রপ্তানি করে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো আয় হয় অহিদুলের। তবে নিজে সরাসরি রপ্তানি করতে পারলে আরও ভালো আয় হতো। অহিদুলের সহযোগী শাহ আলম বলেন, ‘নিজেরা সরাসরি পাঠাতে হলে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু আমাদের কাছে তো এত টাকা নেই।’
অহিদুলের পরিবার: একেবারেই সাদাসিধে গোছের মানুষ অহিদুল (৫০)। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। থাকেন কর্নেলহাটের পণ্ডিতবাড়ী এলাকায়। তিল তিল করে জমানো টাকায় বানিয়েছেন তিনতলা বাড়ি। স্ত্রী গৃহিণী। ছেলে পাভেল চৌধুরী এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন কাট্টলী মোস্তফা হাকিম কলেজ থেকে। মেয়ে তানজুমান আরা বেগম পড়ে কাট্টলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে।
অহিদুলের জীবনসংগ্রামের শুরুতে তাঁর স্ত্রীই ছিলেন একমাত্র প্রেরণা। আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যেও এতটুকু ভেঙে পড়েননি। আগলে রেখেছেন ঘরসংসার। অভয় দিয়েছেন স্বামীকে। তাই তো অহিদুল সুদিনের স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিলেন।
আরও অনেকে: এলাকায় দেশীয় সবজি, ফলফলারি বিদেশে পাঠানোর প্রথম নজির গড়েন অহিদুল। বর্তমানে তাঁর পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন হালিশহর, উত্তর কাট্টলী ও দক্ষিণ কাট্টলী এলাকার কিছু ব্যবসায়ী।
স্থানীয় বাসিন্দা, একসময়কার সৌদি-প্রবাসী মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘এই এলাকায় অহিদুল চাচাই প্রথম বিদেশে সবজি রপ্তানি শুরু করেছেন।’ এর আগে এমন চিন্তা কারও মাথায়ই আসেনি।’
অহিদুলের স্বপ্ন: অহিদুল আলম বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় এত দূর এসেছি। কোনো ব্যাংক অথবা কারও কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা নেইনি। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি কিছু মানুষকে মোটামুটিভাবে চলার সুযোগ করে দিতে পারছি, এটাই আমার সান্ব্তনা। তবে আরও আর্থিক সহযোগিতা পেলে ভালো হতো। তাহলে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারতাম। এতে অনেক বেশি মানুষের কাজের সুযোগ করে দেওয়া যেত।’
অহিদুলের আগামী দিনের স্বপ্নগুলো সফল হবে—এই আশা তো করাই যায়।
এটি অহিদুল আলমের সবজির আড়ত। এই আড়ত থেকে কাটাছাঁটা সবজিগুলো চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে অহিদুল গড়ে তুলেছেন এই আড়ত। একসময় ফেরি করে সবজি বিক্রি করতেন তিনি। নিজের চেষ্টা, পরিশ্রম ও বুদ্ধিতে আজ তিনি একজন রপ্তানিকারক।
যেভাবে শুরু: দারিদ্র্যের কারণে স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি অহিদুল। খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁকে রোজগারে নামতে হয়। দেশ স্বাধীনের পর একসময় নিজেই মাথায় করে সবজি বিক্রি করতেন। ১৯৭৮ সালের দিকে তিনি কর্নেলহাট তরকারির বাজারে আরেকজনের দোকানের সামনে বসার জায়গা করে নেন।
সুযোগটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন অহিদুল। ঠিক সময়ে দোকান খুলতেন। আর যতক্ষণ বাজারে ক্রেতা থাকত, ততক্ষণ পর্যন্ত খোলা থাকত তাঁর দোকান। ধীরে ধীরে ব্যবসার উন্নতি হতে থাকে।
এরপর নিজেই একটি দোকানের মালিক বনে যান। অহিদুলের দোকান থেকে নিয়মিত সবজি নিয়ে যাওয়া হতো গ্ল্যাক্সো বাংলাদেশ লিমিটেডের কর্মচারী ক্যানটিনের জন্য।
এভাবে একসময় গ্ল্যাক্সোর কর্মচারীদের কাছ থেকে বিদেশে সবজি পাঠানোর ধারণা পান অহিদুল। ১৯৯০ সালে তিনি প্রথম দুবাইয়ে সবজি পাঠাতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি পাহাড়তলীর কর্নেলহাট এলাকায় ‘গাউছে ভান্ডার স্টোর’ নামে একটি আড়ত প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেই বিভিন্ন স্থান থেকে আনা সবজি সংরক্ষণ, কাটা, ধোয়ামোছার কাজ চলতে থাকে।
কারা কাজ করছেন: অহিদুলের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে গোল হয়ে বসে কাজ করছেন নারীরা। আমেনা বেগম নয় বছর ধরে এখানে সবজি কাটার কাজ করছেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে পান চিবোতে চিবোতে কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘স্বামী-পোলাপাইন লইয়া আল্লাহর রহমতে ভালাই আছি। সাড়ে চার হাজার টাকা ঘরভাড়া দিয়া থাকি।’
আংকারা বেগম প্রায় নয় বছর ধরে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। স্বামী, পাঁচ ছেলেসহ থাকেন কর্নেলহাট এলাকায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আড়তে কাজ করেন। বেতন পান সাপ্তাহিক ভিত্তিতে।
অহিদুল জানান, প্রায় দেড় হাজার নারী তাঁর আড়তে কাজ করেন। প্রতি কেজি সবজি কাটা বাবদ তাঁরা একেকজন পাঁচ টাকা করে পান।
সবজি সংগ্রহ ও রপ্তানি: যেসব রপ্তানি করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে: ঝিঙে, চিচিঙা, করলা, কাঁকরোল, বরবটি, পটোল, ঢ্যাঁড়স, কচুর লতি, পাইন্যা কচু, কচুর ছড়া, লালশাক, পুঁইশাক, লাউশাক, কাঁঠালের বিচি, জলপাই, কালো জাম, টক বরই প্রভৃতি।
নরসিংদী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, যশোর, বগুড়া, মেহেরপুর, কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি থেকে ভালো মানের সবজি সংগ্রহ করে আনা হয় ট্রাকে করে। এসব সবজি যায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, কানাডা প্রভৃতি দেশে।
অহিদুল সিমার্ক ফিশারিজ ও কোস্টার শিপ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপে সবজি রপ্তানি করেন। তাঁর আড়তে সবজি কাটা ও ধোয়ামোছার পর সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রসেসিং প্ল্যান্টে। সেখানে সবজি প্যাকেটজাত করে হিমাগারে রেখে দেওয়া হয়। এরপর বিদেশ থেকে অর্ডার পাওয়ার পর সেগুলো জাহাজীকরণ (শিপমেন্ট) করা হয়।
আয়ের পরিমাণ: প্রতি মাসে সবজি রপ্তানি করে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো আয় হয় অহিদুলের। তবে নিজে সরাসরি রপ্তানি করতে পারলে আরও ভালো আয় হতো। অহিদুলের সহযোগী শাহ আলম বলেন, ‘নিজেরা সরাসরি পাঠাতে হলে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু আমাদের কাছে তো এত টাকা নেই।’
অহিদুলের পরিবার: একেবারেই সাদাসিধে গোছের মানুষ অহিদুল (৫০)। স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। থাকেন কর্নেলহাটের পণ্ডিতবাড়ী এলাকায়। তিল তিল করে জমানো টাকায় বানিয়েছেন তিনতলা বাড়ি। স্ত্রী গৃহিণী। ছেলে পাভেল চৌধুরী এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন কাট্টলী মোস্তফা হাকিম কলেজ থেকে। মেয়ে তানজুমান আরা বেগম পড়ে কাট্টলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে।
অহিদুলের জীবনসংগ্রামের শুরুতে তাঁর স্ত্রীই ছিলেন একমাত্র প্রেরণা। আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যেও এতটুকু ভেঙে পড়েননি। আগলে রেখেছেন ঘরসংসার। অভয় দিয়েছেন স্বামীকে। তাই তো অহিদুল সুদিনের স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিলেন।
আরও অনেকে: এলাকায় দেশীয় সবজি, ফলফলারি বিদেশে পাঠানোর প্রথম নজির গড়েন অহিদুল। বর্তমানে তাঁর পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন হালিশহর, উত্তর কাট্টলী ও দক্ষিণ কাট্টলী এলাকার কিছু ব্যবসায়ী।
স্থানীয় বাসিন্দা, একসময়কার সৌদি-প্রবাসী মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘এই এলাকায় অহিদুল চাচাই প্রথম বিদেশে সবজি রপ্তানি শুরু করেছেন।’ এর আগে এমন চিন্তা কারও মাথায়ই আসেনি।’
অহিদুলের স্বপ্ন: অহিদুল আলম বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ নিজ চেষ্টায় এত দূর এসেছি। কোনো ব্যাংক অথবা কারও কাছ থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা নেইনি। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি কিছু মানুষকে মোটামুটিভাবে চলার সুযোগ করে দিতে পারছি, এটাই আমার সান্ব্তনা। তবে আরও আর্থিক সহযোগিতা পেলে ভালো হতো। তাহলে ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারতাম। এতে অনেক বেশি মানুষের কাজের সুযোগ করে দেওয়া যেত।’
অহিদুলের আগামী দিনের স্বপ্নগুলো সফল হবে—এই আশা তো করাই যায়।
No comments