প্রতিক্রিয়া- তৃতীয় শক্তি: স্নেহাদ্রিদের গল্পের অসম্পূর্ণতা by অভিনু কিবরিয়া ইসলাম
২৩ ডিসেম্বর ২০১২ প্রথম আলোয় আসিফ নজরুল স্যারের ‘তৃতীয় শক্তি: স্নেহাদ্রিদের গল্প’ শিরোনামের কলামটি এমন সময় প্রকাশিত হলো, যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি, বামপন্থীদের হরতাল ইত্যাদি বিষয় মানুষের আলোচনায় মুখরিত।
লেখাটির শিরোনামে যে স্নেহাদ্রি চক্রবর্তীর কথা বলা হয়েছে, তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি, আমি তখন ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্বে। এখনো স্নেহাদ্রির মতো ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান কর্মীরা শ্রম-ঘাম দিয়ে সমতার সমাজ গড়ার স্বপ্নের সলতেটুকু জ্বালিয়ে রেখেছেন—এ কথাও স্যার পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন।
কিন্তু বামপন্থীদের হরতাল প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সরকার একে ‘গৃহপালিত’ হরতালে পরিণত করেছে। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে স্যারের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এবং বলেছেন, নিষিদ্ধ না করে ‘রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা’ করা শ্রেয়তর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্যারের এই কথাগুলো বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। আমাদের অনেকেরই মানসিকতা দ্বিদলীয় রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে এমনভাবে আটকে গেছে যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে চিন্তা করা কঠিন। এর ফলাফল হিসেবেই হয়তো কাউকে আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ অথবা কাউকে ‘বিএনপিপন্থী’ বলে চিত্রায়িত করা হয়।
গত ১৮ তারিখের হরতালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে তাজরীনে শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী মালিককে গ্রেপ্তার ও বিচার, বিদ্যুৎ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোসহ অন্যান্য দাবি থাকলেও সেগুলো হয়তো ঠিকমতো গণমাধ্যমে আসেনি। একে বামপন্থীদের ব্যর্থতা বলবেন, না গণমাধ্যমের ব্যর্থতা বলবেন, নাকি সরকারের কারসাজি বলবেন—সেটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। তবে যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার শুধু আওয়ামী লীগের নয়, তা যে গণদাবিতে পরিণত হয়েছে, এটা অস্বীকার করা মানে সত্য উপলব্ধির ব্যর্থতা।
প্রশ্ন এসেছে, ১৮ তারিখের হরতালে পুলিশ আগ্রাসী হলো না কেন? বামপন্থীরা হরতালের আগেই মিডিয়াকে জানিয়ে বেশ কটি পরিবহন শ্রমিক সংগঠন ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেসব সংগঠন হরতালে তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। হরতালের দিন পরিবহন শ্রমিকেরা গাড়ি ছাড়েননি, গার্মেন্টস শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছেন গাজীপুরে, নারায়ণগঞ্জে, আশুলিয়ায়। জনগণের নীরব সমর্থন থাকায় এই হরতাল শেষ পর্যন্ত শুধু বামপন্থীদের হরতাল থাকেনি, পরিণত হয়েছিল গণমানুষের হরতালে। ওই দিন প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণ থেকে দুটি লাইন তুলে দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি, ‘গন্তব্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্ভোগ পোহাতে হলেও অনেক যাত্রী এই হরতালের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন। বেসরকারি ব্যাংকার সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ডাকা এ হরতাল সমর্থন করেন তিনি।’ () ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভোটে ক্ষমতায় এসেছে। সেই দাবির পক্ষে যে হরতালে দেশবাসী নীরব সমর্থন জানিয়েছে, যে হরতালে ভাঙচুর হয়নি, ককটেল ফোটেনি; তরুণ প্রজন্মের ছাত্ররা মাঠে নেমেছে তবলা-গিটার নিয়ে—শান্তিপূর্ণ সেই হরতালে যদি সরকার আগ্রাসী হতো, তা কি তাদের জন্য বুমেরাং হতো না?
এ সরকারের আমলে বামপন্থীরা আগেও হরতাল ডেকেছে—তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর-খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকে। ২০১১ সালের ৩ জুলাই ঢাকায় আধা বেলা হরতাল ডাকা হয়েছিল। সে সময় সিপিবি-বাসদ অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, আহত-গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। এই জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার দায়ে দুই বছর আগে মিছিলে জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ স্যারের পা ভেঙে দেওয়া হয়। এই আমলেই, পোশাক কারখানার শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ, তুহিন চৌধুরীসহ অনেককে দীর্ঘদিন কারাবন্দী করে রাখা হয়, নির্যাতন করা হয়। কদিন আগেও এশিয়া এনার্জিকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকায় পুলিশ বা সরকার আগ্রাসী হতে পারেনি।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে স্যার ভারতের উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভারত ও বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এক নয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্মেছিল ভারত-পাকিস্তান। সেই দ্বিজাতি তত্ত্বকে পরাজিত করে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানিরা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করতে পারেনি। ধর্মের ধুয়া তুলে মুক্তিযুদ্ধকালে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা ধর্মব্যবসায়ীরা। তাদের পরাজিত করে সাম্প্রদায়িক শক্তির কবর রচনা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধেই। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধানে তাই নিষিদ্ধ ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরশাসকেরা পুনরুজ্জীবিত করেছে সাম্প্রদায়িকতাকে। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও ঢুকিয়েছে স্বৈরশাসকেরাই, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার নয়। অথচ দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগই সংবিধান সংশোধন করে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্মকে বহাল রেখেছে, রেখেছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগ। এ সংশোধনীর সময়ও বামপন্থীরা প্রতিবাদ করেছে। সংবিধান সংশোধনের দিন সংসদ অভিমুখে পদযাত্রায় পুলিশের লাঠিচার্জে রক্ত ঝরেছে অনেকের।
বামপন্থীদের বিষয়ে স্যারের একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি থেকে সরে আসার পর বামপন্থীরা আর আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেনি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায়, এ ঘটনায় বামপন্থীরাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছে এবং নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে তারা সব সময়ই সোচ্চার ছিল। এ কারণেই জঙ্গিগোষ্ঠী বারবার হামলা চালিয়ে মানুষ মেরেছে সিপিবির সমাবেশে, উদীচীর অনুষ্ঠানে। যে দলগুলো গত ১৮ তারিখ হরতাল করেছে, ১৯৯৬ সালে বা এর পরে কোনো নির্বাচনেই তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেনি। তাই জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপসের দায় বামপন্থীরা কেন নেবে? বিএনপির বিরুদ্ধে মহাজোটে যখন ডান-বামদের মহামেলা বসেছিল, তখনো এ দলগুলো মহাজোটের শরিক হয়নি। হলে হয়তো এদের অনেকেই এমপি-মন্ত্রী হতে পারতেন। সুতরাং ‘সুবিধাজনক সময়ে আন্দোলন করা’র কথা বলে কার্যত ‘সুবিধাবাদী’ যে তকমাটি স্যার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা অযথার্থ।
আসিফ নজরুল স্যার জামায়াত-জাতীয় পার্টির চেয়েও বামপন্থী পার্টিগুলোর সমর্থন নগণ্য কেন সে প্রশ্ন করেছেন। এ সমর্থন বোধ হয় তিনি ভোটের হিসাবে করেছেন। সমর্থন সব সময় ভোটের হিসাবে চোখে পড়ে না। নির্বাচনে যখন জামায়াত-জাতীয় পার্টি কোটি কোটি টাকা খরচ করে, সে অনুযায়ী বামপন্থী সৎ প্রার্থীর খরচ করার সামর্থ্য কত? আর এই এক মেরু বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার ‘বোকামিও (!)’ এই বামপন্থীরাই করে, সে হিসাবটুকুও বাতিল করে দিলে চলবে না। স্যার আরও বলেছেন, পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকতে পারলে এ দেশে কেন পারছে না। ভারতে ৬৫ বছর ধরে গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। এ দেশে সামরিক শাসকেরা প্রতিক্রিয়াশীলতার বাহনে চেপে দেশ শাসন করেছে বহুদিন। বামপন্থীদের ওপর চলেছে স্টিম রোলার। অনেক বামপন্থী বিচ্যুত হয়েছেন, এ-ও সত্যি। এ-ও সত্যি, বামপন্থীদের বহুধাবিভক্তি, ভুল সিদ্ধান্ত, জনগণের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ব্যর্থতাও রয়েছে। স্যারের কিছু কিছু সমালোচনার সঙ্গে আমিও একমত এবং আমি এ-ও মনে করি, সমালোচনার প্রয়োজন আছে। তবে সেই সমালোচনা যেন একচোখা না হয় কিংবা প্রতিক্রিয়ার হাতকে শক্তিশালী না করে।
অভিনু কিবরিয়া ইসলাম: শিক্ষক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
কিন্তু বামপন্থীদের হরতাল প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, সরকার একে ‘গৃহপালিত’ হরতালে পরিণত করেছে। ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে স্যারের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এবং বলেছেন, নিষিদ্ধ না করে ‘রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা’ করা শ্রেয়তর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্যারের এই কথাগুলো বিএনপির বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। আমাদের অনেকেরই মানসিকতা দ্বিদলীয় রাজনীতির কাঠামোর মধ্যে এমনভাবে আটকে গেছে যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে চিন্তা করা কঠিন। এর ফলাফল হিসেবেই হয়তো কাউকে আওয়ামী লীগের ‘বি টিম’ অথবা কাউকে ‘বিএনপিপন্থী’ বলে চিত্রায়িত করা হয়।
গত ১৮ তারিখের হরতালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবির সঙ্গে তাজরীনে শ্রমিক হত্যার জন্য দায়ী মালিককে গ্রেপ্তার ও বিচার, বিদ্যুৎ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানোসহ অন্যান্য দাবি থাকলেও সেগুলো হয়তো ঠিকমতো গণমাধ্যমে আসেনি। একে বামপন্থীদের ব্যর্থতা বলবেন, না গণমাধ্যমের ব্যর্থতা বলবেন, নাকি সরকারের কারসাজি বলবেন—সেটা দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়। তবে যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার শুধু আওয়ামী লীগের নয়, তা যে গণদাবিতে পরিণত হয়েছে, এটা অস্বীকার করা মানে সত্য উপলব্ধির ব্যর্থতা।
প্রশ্ন এসেছে, ১৮ তারিখের হরতালে পুলিশ আগ্রাসী হলো না কেন? বামপন্থীরা হরতালের আগেই মিডিয়াকে জানিয়ে বেশ কটি পরিবহন শ্রমিক সংগঠন ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেসব সংগঠন হরতালে তাদের সমর্থন ঘোষণা করে। হরতালের দিন পরিবহন শ্রমিকেরা গাড়ি ছাড়েননি, গার্মেন্টস শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছেন গাজীপুরে, নারায়ণগঞ্জে, আশুলিয়ায়। জনগণের নীরব সমর্থন থাকায় এই হরতাল শেষ পর্যন্ত শুধু বামপন্থীদের হরতাল থাকেনি, পরিণত হয়েছিল গণমানুষের হরতালে। ওই দিন প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণ থেকে দুটি লাইন তুলে দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি, ‘গন্তব্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্ভোগ পোহাতে হলেও অনেক যাত্রী এই হরতালের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন। বেসরকারি ব্যাংকার সৈয়দ আশরাফুজ্জামান বলেন, দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ডাকা এ হরতাল সমর্থন করেন তিনি।’ () ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ভোটে ক্ষমতায় এসেছে। সেই দাবির পক্ষে যে হরতালে দেশবাসী নীরব সমর্থন জানিয়েছে, যে হরতালে ভাঙচুর হয়নি, ককটেল ফোটেনি; তরুণ প্রজন্মের ছাত্ররা মাঠে নেমেছে তবলা-গিটার নিয়ে—শান্তিপূর্ণ সেই হরতালে যদি সরকার আগ্রাসী হতো, তা কি তাদের জন্য বুমেরাং হতো না?
এ সরকারের আমলে বামপন্থীরা আগেও হরতাল ডেকেছে—তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর-খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকে। ২০১১ সালের ৩ জুলাই ঢাকায় আধা বেলা হরতাল ডাকা হয়েছিল। সে সময় সিপিবি-বাসদ অফিস অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, আহত-গ্রেপ্তার হয়েছিলেন অসংখ্য নেতা-কর্মী। এই জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার দায়ে দুই বছর আগে মিছিলে জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ স্যারের পা ভেঙে দেওয়া হয়। এই আমলেই, পোশাক কারখানার শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ, তুহিন চৌধুরীসহ অনেককে দীর্ঘদিন কারাবন্দী করে রাখা হয়, নির্যাতন করা হয়। কদিন আগেও এশিয়া এনার্জিকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকায় পুলিশ বা সরকার আগ্রাসী হতে পারেনি।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে স্যার ভারতের উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভারত ও বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এক নয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্মেছিল ভারত-পাকিস্তান। সেই দ্বিজাতি তত্ত্বকে পরাজিত করে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানিরা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে বিনষ্ট করতে পারেনি। ধর্মের ধুয়া তুলে মুক্তিযুদ্ধকালে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা ধর্মব্যবসায়ীরা। তাদের পরাজিত করে সাম্প্রদায়িক শক্তির কবর রচনা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধেই। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধানে তাই নিষিদ্ধ ছিল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরশাসকেরা পুনরুজ্জীবিত করেছে সাম্প্রদায়িকতাকে। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও ঢুকিয়েছে স্বৈরশাসকেরাই, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার নয়। অথচ দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগই সংবিধান সংশোধন করে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্মকে বহাল রেখেছে, রেখেছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার সুযোগ। এ সংশোধনীর সময়ও বামপন্থীরা প্রতিবাদ করেছে। সংবিধান সংশোধনের দিন সংসদ অভিমুখে পদযাত্রায় পুলিশের লাঠিচার্জে রক্ত ঝরেছে অনেকের।
বামপন্থীদের বিষয়ে স্যারের একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি থেকে সরে আসার পর বামপন্থীরা আর আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেনি। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায়, এ ঘটনায় বামপন্থীরাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছে এবং নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে তারা সব সময়ই সোচ্চার ছিল। এ কারণেই জঙ্গিগোষ্ঠী বারবার হামলা চালিয়ে মানুষ মেরেছে সিপিবির সমাবেশে, উদীচীর অনুষ্ঠানে। যে দলগুলো গত ১৮ তারিখ হরতাল করেছে, ১৯৯৬ সালে বা এর পরে কোনো নির্বাচনেই তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেনি। তাই জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আপসের দায় বামপন্থীরা কেন নেবে? বিএনপির বিরুদ্ধে মহাজোটে যখন ডান-বামদের মহামেলা বসেছিল, তখনো এ দলগুলো মহাজোটের শরিক হয়নি। হলে হয়তো এদের অনেকেই এমপি-মন্ত্রী হতে পারতেন। সুতরাং ‘সুবিধাজনক সময়ে আন্দোলন করা’র কথা বলে কার্যত ‘সুবিধাবাদী’ যে তকমাটি স্যার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা অযথার্থ।
আসিফ নজরুল স্যার জামায়াত-জাতীয় পার্টির চেয়েও বামপন্থী পার্টিগুলোর সমর্থন নগণ্য কেন সে প্রশ্ন করেছেন। এ সমর্থন বোধ হয় তিনি ভোটের হিসাবে করেছেন। সমর্থন সব সময় ভোটের হিসাবে চোখে পড়ে না। নির্বাচনে যখন জামায়াত-জাতীয় পার্টি কোটি কোটি টাকা খরচ করে, সে অনুযায়ী বামপন্থী সৎ প্রার্থীর খরচ করার সামর্থ্য কত? আর এই এক মেরু বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করার ‘বোকামিও (!)’ এই বামপন্থীরাই করে, সে হিসাবটুকুও বাতিল করে দিলে চলবে না। স্যার আরও বলেছেন, পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকতে পারলে এ দেশে কেন পারছে না। ভারতে ৬৫ বছর ধরে গণতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। এ দেশে সামরিক শাসকেরা প্রতিক্রিয়াশীলতার বাহনে চেপে দেশ শাসন করেছে বহুদিন। বামপন্থীদের ওপর চলেছে স্টিম রোলার। অনেক বামপন্থী বিচ্যুত হয়েছেন, এ-ও সত্যি। এ-ও সত্যি, বামপন্থীদের বহুধাবিভক্তি, ভুল সিদ্ধান্ত, জনগণের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ব্যর্থতাও রয়েছে। স্যারের কিছু কিছু সমালোচনার সঙ্গে আমিও একমত এবং আমি এ-ও মনে করি, সমালোচনার প্রয়োজন আছে। তবে সেই সমালোচনা যেন একচোখা না হয় কিংবা প্রতিক্রিয়ার হাতকে শক্তিশালী না করে।
অভিনু কিবরিয়া ইসলাম: শিক্ষক, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments