সাফওয়ানের পথচলা- জসীম আল ফাহিম
গোধূলিবেলা। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবু ডুবু। ডিসেম্বর মাস। কনকনে শীত নামতে শুরু করেছে। দিবা শেষের দু’একটি পাখি করুণ সুরে গান করছে। এমন সময় মোমবাতি তৈরির কারখানা থেকে ছুটি পেল সাফওয়ান। বয়স আট-নয়। নিরীহ শান্ত স্বভাব।
ছোট ছোট পা ফেলে শহরের শেষ মাথার বস্তিটির দিকে সে হাঁটছে । বস্তির একপাশে পলিথিন মোড়ানো ছোট্ট তাঁবুর মতো ঘর। ওই ঘরে সাফওয়ান এবং তার মা থাকে। বাবা বেঁচে আছে না বেঁচে নেই, সে জানে না। বাবার হাত ধরে একদিন ওরা শহরে এসেছিল। বাবা রিকশা চালাতেন। তখন মুক্তিযুদ্ধের সময়। সারা দেশে শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তুমুল মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে পাখির মতো মারতে লাগল নিরীহ মানুষ। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শরিক হলেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর অবশেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু বাবা আর ফিরে এলেন না। সাফওয়ানের বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। স্বামী হারিয়ে সাফওয়ানের মা ওকে নিয়ে অকূলে ভাসলেন। মা লোকের বাসায় ঝিয়ের কাজ নিলেন। আর ছোট্ট সাফওয়ান কাজ নিলো মোমবাতি তৈরির কারখানায়। সেই থেকে এই পথে তার পথচলা।বাবা স্বপ্ন দেখতেন ছেলে একদিন বড় হবে। স্কুল-কলেজে পড়বে। মানুষের মতো মানুষ হবে। তারপর কোনো একটা চাকরি নিয়ে বাবা-মায়ের দুঃখ মুছে দেবে। কিন্তু হলো আর কই। বাবাকে হারিয়ে সাফওয়ানের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। সাফওয়ানের মা সামান্য লেখাপড়া জানা মহিলা। ছেলেকে স্কুলে দিতে না পারলে কি হবে। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে তিনি ছেলেকে নিয়ে পড়াতে বসেন। মায়ের চেষ্টায় সাফওয়ান একটু একটু পড়তে শিখল। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর মা সাফওয়ানকে বললেন, বাবা, শোন! ভাবছি এবার তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। মায়ের কথা শুনে সাফওয়ান চিন্তিত হয়ে বলল, কিন্তু মা-স্কুলে গেলে খাবো কি? কারখানায় গিয়ে কাজ না করলে আমাদের চলবে কি করে?
ছেলের কথা শুনে মা বললেন, ওসব তোকে ভাবতে হবে না। আমি যে বাসায় কাজ করি সে বাসার মালিক একজন শিক্ষক। ইউনিসেফ পরিচালিত শিশু স্কুলে তিনি পড়ান। একদিন তোর কথা তাকে বললাম। শুনে তিনি ভরসা দিলেন। বললেন, নতুন বছরে জানুয়ারি মাসে তোকে নিয়ে যেতে। উনার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে। ওই স্কুলে পড়াশোনা করতে নাকি কোনো খরচ লাগে না। ইউনিসেফই ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা এবং থাকা-খাওয়ার খরচ জোগায়। মায়ের কথা শুনে সাফওয়ানের মন আনন্দে দোলে উঠল। কারণ নতুন বছরে সে নতুন স্কুলে ভর্তি হবে। অন্য ছেলেমেয়ের মতো সেও পড়াশোনা করতে পারবে। কি আনন্দের কথা, ভাবা যায়! ব্যপারটা একবার চিন্তা করেই ওর চোখ দুটো আনন্দে ঝাপসা হয়ে উঠল। আনন্দভরা মনে সে মাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের শাড়ির আঁচলে মুখ লুকাল।
জানুয়ারি মাসে সাফওয়ান নতুন স্কুলে ভর্তি হলো। স্কুলের নাম ‘ছিন্নমূল শিশু নিকেতন’। ওই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সে। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। পড়াশোনার ফাঁকে ছোটখাটো কাজ করে সে এখন রোজগারও করে। ওর যাবতীয় ব্যয়ভার স্কুল বহন করে। আর উপার্জিত সামান্য টাকাকড়ি সে মায়ের হাতে তুলে দেয়।
সাফওয়ান খুব মেধাবী ছাত্র। মনোযোগী ও পরিশ্রমী। পড়াশোনায় ভাল। শুধু পড়াশোনা নয়। খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায়ও সে সমান পারদর্শী। তাই ওর প্রতি স্কুলের মিস্গণ খুব খুশি।
কয়েকদিন পরই স্কুলে সাফওয়ানের বার্ষিক পরীক্ষা। সাফওয়ান খুব মনোযোগ দিয়ে পড়শোনা করছে। ওর ইচ্ছে পরীক্ষায় এবার প্রথম হওয়া। প্রথম হতে পারলে পুরস্কার আছে। ইউনিসেফ থেকে বৃত্তি প্রদান করা হবে। মায়ের জন্য সে একটা শাড়ি কিনবে। মায়ের শাড়িটা কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। মায়ের একটা নতুন শাড়ি দরকার। এরই মধ্যে পরীক্ষা শুরু হয়ে যথারীতি শেষও হলো। তারপর কেটে গেলো আরওা কিছুদিন। আজ স্কুলে রেজাল্ট জানানো হবে। সাফওয়ান গম্ভীর মনে স্কুলে গেলো। তার মনে ভয়মিশ্রিত আনন্দ। কি জানি ফলাফল কেমন হয়! আশানুরূপ না হলে তো ওর ইচ্ছেটা ব্যর্থ হয়ে যাবে। মায়ের জন্য শাড়িটা আর কিনা হবে না। মনে মনে ভাবে সাফওয়ান।
স্কুলের ছোট্ট মাঠে টেবিল-চেয়ার পেতে মঞ্চ বানানো হলো। স্কুলের খোলামাঠে সবুজ ঘাসের চাদরে বসে ছাত্রছাত্রী রেজাল্ট শোনার অপেক্ষা করছে। প্রধান মিস্ রেজাল্টশীট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বোঝা গেলো এখনই তিনি রেজাল্ট ঘোষণা করবেন। প্রথম শ্রেণি থেকে তিনি রেজাল্ট ঘোষণা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণিরও রেজাল্ট ঘোষণা করা হয়ে গেছে। এখন ঘোষণা করা হবে তৃতীয় শ্রেণির রেজাল্ট। সাফওয়ানের বুকের ভেতর ধুকপুক করতে লাগল। কি জানি কি হয়! মিস্ ঘোষণা করলেন, তৃতীয় শ্রেণিতে এবার তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে-জামান। সঙ্গে সঙ্গে হাত উঁচিয়ে সাড়া দিল সে। পরে তিনি বললেন, দ্বিতীয় হয়েছে সোহান। সোহানও উঠে হাত উঁচিয়ে সকলকে অভিবাদন জানাল। মিস্ এবার ঘোষণা করলেন, তৃতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সাফওয়ান। রেজাল্ট শুনে আনন্দে সাফওয়ানের দু’চোখে জল এসে গেলো। জলভরা চোখে সেও দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে সবাইকে অভিবাদন জানাল। রেজাল্ট ঘোষণার পর প্রধান মিস্ প্রথম স্থান অধিকারী ছাত্রদের মধ্যে বৃত্তি প্রদান করলেন। বৃত্তির টাকা পেয়ে সাফওয়ানের আনন্দ যেন আর ধরে না। টাকাগুলো পকেটে পুরে সে সোজা মার্কেটে চলে গেলো। একটি শাড়ি কাপড়ের দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল সাফওয়ান। শাড়ি কিনতে গিয়ে তার দু’চোখ আবার চিকচিক করে উঠল। কতদিন মা নতুন শাড়ি পরেন না! আজ সে মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি কিনবে।
অনেক দেখেশুনে সাফওয়ান মায়ের জন্য সুন্দর একটা শাড়ি কিনল। লালপেড়ে সবুজ রঙের শাড়ি। যে রঙকে ছিনিয়ে আনতে গিয়ে তার বাবা মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ওর ভাল রেজাল্টের খবর শুনে এবং নতুন শাড়িটা দেখে মা একেবারে কেঁদে ফেললেন। সাফওয়ানকে তিনি বুকে জড়িয়ে নিলেন। সাফওয়ান বুঝতে পারল, তার কৃতিত্বে মা খুব খুশি হয়েছেন। কারণ মা খুশি হলে কেঁদে ফেলেন।
অলঙ্করণ : শাহ্রিন আক্তার
No comments