ঘুষ বেড়েছে দ্বিগুণ-স্বাস্থ্য ছাড়া সেবা খাতে দুর্নীতি কমেছে
স্বাস্থ্য ছাড়া সরকারি সেবা খাতগুলোতে দুই বছর আগের তুলনায় সার্বিক দুর্নীতির হার কমেছে। তবে এমন ইতিবাচক অবস্থানের মধ্যেই অন্য হিসাবে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ দেওয়ার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জাতীয় খানা জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটি গতকাল শুক্রবার ঢাকায় সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এ জরিপের ফল প্রকাশ করে জানিয়েছে, দুর্নীতির হার কমলেও এখনো পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। কারণ ৬৩.৭ শতাংশ সেবাগ্রহণকারী কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের ১৩টি সুনির্দিষ্ট সেবা খাতের সার্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি ২০১০ সালে থাকা ৮৪.২ থেকে এ বছর ৫৫.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা (২১ হাজার ৯৫৫.৬ কোটি)। ২০১০-এ খানা জরিপের ফলাফলে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। এবারের নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ ২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৩.৬ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৪ শতাংশ।
জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, গত দুই বছরে সব সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শ্রম অভিবাসন খাত। এখানে সেবাগ্রহীতাদের ৭৭ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, যেখানে ৭৫.৮ শতাংশ সেবাগ্রহণকারী দুর্নীতির শিকার হয়েছে। বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভূমি প্রশাসন (৫৯ শতাংশ) এবং চতুর্থ অবস্থানে বিচারিক সেবা (৫৭.১ শতাংশ)। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ২০১০ সালের ৩৩.২ থেকে বেড়ে ৪০.২ শতাংশে উঠে এসেছে। তবে এ খাতে সর্বোচ্চ ৭৯.৯ শতাংশ খানা সেবা নিয়েছে, যার ৫০.২ শতাংশ সেবা নিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ২০১০-এর চেয়ে তুলনামূলক দুর্নীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৯ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১০-এর জাতীয় খানা জরিপের সঙ্গে ২০১২ সালের তুলনামূলক চিত্রের বিশ্লেষণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, শিক্ষা, ব্যাংকিং, বীমা ও এনজিও খাতে আগের তুলনায় দুর্নীতির হার কমছে। এ সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মতো খাতে দুর্নীতির ফলে মানুষের হয়রানির অভিজ্ঞতা এখনো সবচেয়ে বেশি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ভৌগোলিক অবস্থানভেদে দুর্নীতির মাত্রা গ্রামাঞ্চলে বেশি, যা এ সমস্যার গভীরতা ও ব্যাপকতার উদ্বেগজনক অবস্থার প্রতিফলন। বাংলাদেশে ঘুষ ও নিয়মবহির্ভূত অর্থের পেছনে খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ব্যয়ের ৪.৮ শতাংশ খরচ হয়, তবে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতির প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি (মোট ব্যয়ের ৫.৫ শতাংশ), পক্ষান্তরে ধনীদের জন্য তা তুলনামূলক কম (মোট ব্যয়ের ১.৩ শতাংশ)। অর্থাৎ দুর্নীতির কারণে বিপুল ক্ষতির বোঝা আপেক্ষিক অর্থে দরিদ্র জনগণের ওপরই বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন টিআইবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। সঞ্চালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। প্রতিবেদন উপস্থান করেন পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মো. রফিকুল হাসান ও সিনিয়র গবেষণা ফেলো শাহজাদা এম আকরাম।
সুলতানা কামাল তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'যখন সেবাগ্রহণের হার কমে যায় তখন বুঝতে হবে আমাদের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট মাত্রায় সেবামুখী ও শক্তিশালী নয়। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে ওই সেবা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় এবং তারা নানাবিধ বিকল্প উপায়ে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়, যা মূলত সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে।'
সুলতানা কামাল আরো বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ধারণা সূচক আর জাতীয় খানা জরিপের মধ্যে কোনো মিল নেই। দুটি সম্পূর্ণ দুই ধরনের ব্যাপার। একটি হচ্ছে গ্রান্ড করাপশন (বড় দুর্নীত), আরেকটি হচ্ছে পেটি করাপশন (ছোট দুর্নীতি)। টিআইয়ের চিত্রটি হচ্ছে দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রের বড় দুর্নীতির ধারণা সূচক, আর এখনকার খানা জরিপটি হচ্ছে মাঠ পর্যায়ে সেবাগ্রহীতাদের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রশ্নোত্তর বা বক্তব্যভিত্তিক। এখানে টিআইবির নিজস্ব কিছু নেই, ভুক্তভোগি মানুষ যা জানিয়েছে টিআইবি কেবল প্রতিবেদন আকারে তা তুলে ধরেছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির হার কমার ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা ও সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের ভূমিকা থাকতে পারে। বিশেষ করে জনগণের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি, কোনো কোনো সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধমে সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজকরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিবিরোধী প্রশিক্ষণ, কোনো কোনো স্থানীয় সরকার পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সর্বোপরি নাগরিক সমাজ, এনজিও ও গণমাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী সক্রিয় প্রচারণার ফলে সার্বিকভাবে জনসচেতনতা ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান গ্রহণের সুযোগ, তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জন অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসবের পরও যে হারে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ দেওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসহ কিছু খাতে দুর্নীতির প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস না পাওয়া হতাশাজনক।
ঘুষ দেওয়ার হার : এবারের খানা জরিপের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেবা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের ৫৩.৩ শতাংশ খানাকে কোনো না কোনো খাতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে, যার গড় ১৩ হাজার ৮৪ টাকা। জরিপকৃত সব খানার ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত এ অর্থের গড় ছয় হাজার ৯০০ টাকা। এই ভিত্তিতে প্রাক্কলনে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে প্রদত্ত মোট নিয়মবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ২১ হাজার ৯৫৫.৬ কোটি টাকা। নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ৭৭ শতাংশ দিতে হয়েছে শ্রম অভিবাসন খাতে। এরপর পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দিতে হয়েছে ৬৬.৯ শতাংশ, ভূমি প্রশাসনে ৫৪.৮ শতাংশ ও বিচারিক সেবায় ৩৮.১ শতাংশ, শিক্ষায় ৩০.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকারে ২৫.৫ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ২১.৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ১৬.২ শতাংশ, কর ও শুল্ক খাতে ১২.৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ খাতে ১২ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ৪.৯ শতাংশ, বীমা খাতে ৩.২ শতাংশ, এনজিও খাতে ১.৬ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে (বিভিন্ন ধরনের ছোট সরকারি প্রতিষ্ঠানে) ৩৪ শতাংশ অর্থ দিতে হয়েছে।
কেন ঘুষ দেওয়া হয়েছে : জরিপে অংশ নেওয়া ৫২.৫ শতাংশ খানার প্রতিনিধিরা জরিপ দলের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন নিয়মের বাইরে টাকা না দিলে সেবা পাওয়া যায় না, ৪২.৪ শতাংশ জানিয়েছেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়ার আশায় তারা অতিরিক্ত টাকা দিয়েছেন, ২৭.৮ শতাংশ জানিয়েছেন নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য নিয়মের চেয়ে বেশি টাকা দিয়েছেন, ১৬.৩ শতাংশ বলেছেন হয়রানি বা জটিলতা এড়ানোর জন্য টাকা দিয়েছেন, ১২.৮ শতাংশ সেবা প্রদানকারীকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে টাকা দিয়েছেন এবং অন্যান্য কারণে টাকা দিয়েছেন ৭.৫ শতাংশ খানাওয়ালা।
যে হারে দুর্নীতি কমেছে : প্রতিবেদন অনুসারে ১৩টি খাতভেদে ২০১০ সালের তুলনায় এবারে (২০১২) দুর্নীতি কমার চিত্রে দেখা যায়, সার্বিক পর্যায়ের দুর্নীতির হার ৮৪.২ থেকে কমে ৫৫.৬, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ৭৯.৭ থেকে কমে ৭৫.৮, ভূমি প্রশাসনে ৭১.২ থেকে কমে ৫৯, বিচারিক সেবায় ৮৮ থেকে কমে ৫৭.১, স্থানীয় সরকারে ৪৩.৯ থেকে কমে ৩০.৯, কৃষি খাতে ৪৫.৩ থেকে ২০.৪, কর ও শুল্ক খাতে ৫১.৩ থেকে ১৬.৮, ব্যাংকিং খাতে ১৭.৪ থেকে ৭.১, বীমা খাতে ১৯.২ থেকে ৬ এবং এনজিও খাতে ১০.১ থেকে কমে ৫ শতাংশে নেমেছে। কেবল স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির হার ২০১০ সালের তুলনায় ৩৩.২ থেকে বেড়ে ৪০.২ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে (ছোটখাটো কিছু খাতে) ৩৪.১ থেকে বেড়ে ৫৪.৯ শতাংশে উঠেছে।
জরিপের পদ্ধতি : টিআইবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত ছয়টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। ২০১২ সালের জরিপে সেবা নেওয়ার সময়কাল ২০১১ সালের মে থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। গত ১৫ মে থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিতকল্পে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি ছয়জন জাতীয়-আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞের একটি দলের সহায়তা ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পদ্ধতি ব্যবহার করে জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় ৬০ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৪০ শতাংশ নমুনা ধরে বিভিন্ন স্তরে সমন্বয় করে মোট জরিপকৃত খানার সংখ্যা ৭৯০৬। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ৪৬২৪ (৫৮.৫ শতাংশ), পৌরসভা ১৯৮১টি (২৫ শতাংশ), ংঃধঃরংঃরপধষ গবঃৎড়ঢ়ড়ষরঃধহ ধৎবধ (এসএমএ) ১৩০১ (১৬.৫ শতাংশ)। খানা নির্বাচনের জন্য দৈবচয়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। খানা জরিপে তথ্যদাতার ধরনের মধ্যে খানাপ্রধান ৬৬.৩ শতাংশ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ৩৩.৭ শতাংশ, ৩৫.৮ শতাংশ নারী এবং ৬৪.২ শতাংশ পুরুষ ছিলেন।
টিআইবির সুপারিশ : সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল ও পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণপূর্বক প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, সচেতনতা, প্রচারণা ও অ্যাডভোকেসি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে টিআইবির পক্ষ থেকে। এতে বলা হয়, সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রণোদনা প্রদান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১-এর কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বাধীন ও শক্তিশালী দুদক গঠন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি বৃদ্ধি, জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়ন, নাগরিক সমাজ প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের ভূমিকা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
এ জরিপে ব্যবহৃত দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে 'ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার'। এ ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়া বা ঘুষ দিতে বাধ্য করা ছাড়াও অর্থ বা সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানিকে দুর্নীতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় বা বাধ্যতামূলকভাবে প্রদত্ত ঘুষ, প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ এবং আত্মসাৎকৃত অর্থকে নিয়মবহির্ভূত অর্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের ১৩টি সুনির্দিষ্ট সেবা খাতের সার্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি ২০১০ সালে থাকা ৮৪.২ থেকে এ বছর ৫৫.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ রয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা (২১ হাজার ৯৫৫.৬ কোটি)। ২০১০-এ খানা জরিপের ফলাফলে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৯ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। এবারের নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ ২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৩.৬ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৪ শতাংশ।
জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, গত দুই বছরে সব সেবা খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শ্রম অভিবাসন খাত। এখানে সেবাগ্রহীতাদের ৭৭ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, যেখানে ৭৫.৮ শতাংশ সেবাগ্রহণকারী দুর্নীতির শিকার হয়েছে। বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভূমি প্রশাসন (৫৯ শতাংশ) এবং চতুর্থ অবস্থানে বিচারিক সেবা (৫৭.১ শতাংশ)। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ২০১০ সালের ৩৩.২ থেকে বেড়ে ৪০.২ শতাংশে উঠে এসেছে। তবে এ খাতে সর্বোচ্চ ৭৯.৯ শতাংশ খানা সেবা নিয়েছে, যার ৫০.২ শতাংশ সেবা নিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ২০১০-এর চেয়ে তুলনামূলক দুর্নীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৯ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১০-এর জাতীয় খানা জরিপের সঙ্গে ২০১২ সালের তুলনামূলক চিত্রের বিশ্লেষণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, শিক্ষা, ব্যাংকিং, বীমা ও এনজিও খাতে আগের তুলনায় দুর্নীতির হার কমছে। এ সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মতো খাতে দুর্নীতির ফলে মানুষের হয়রানির অভিজ্ঞতা এখনো সবচেয়ে বেশি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ভৌগোলিক অবস্থানভেদে দুর্নীতির মাত্রা গ্রামাঞ্চলে বেশি, যা এ সমস্যার গভীরতা ও ব্যাপকতার উদ্বেগজনক অবস্থার প্রতিফলন। বাংলাদেশে ঘুষ ও নিয়মবহির্ভূত অর্থের পেছনে খানাপ্রতি বার্ষিক গড় ব্যয়ের ৪.৮ শতাংশ খরচ হয়, তবে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতির প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি (মোট ব্যয়ের ৫.৫ শতাংশ), পক্ষান্তরে ধনীদের জন্য তা তুলনামূলক কম (মোট ব্যয়ের ১.৩ শতাংশ)। অর্থাৎ দুর্নীতির কারণে বিপুল ক্ষতির বোঝা আপেক্ষিক অর্থে দরিদ্র জনগণের ওপরই বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন টিআইবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। সঞ্চালনা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। প্রতিবেদন উপস্থান করেন পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মো. রফিকুল হাসান ও সিনিয়র গবেষণা ফেলো শাহজাদা এম আকরাম।
সুলতানা কামাল তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'যখন সেবাগ্রহণের হার কমে যায় তখন বুঝতে হবে আমাদের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট মাত্রায় সেবামুখী ও শক্তিশালী নয়। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে ওই সেবা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় এবং তারা নানাবিধ বিকল্প উপায়ে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়, যা মূলত সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করে।'
সুলতানা কামাল আরো বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ধারণা সূচক আর জাতীয় খানা জরিপের মধ্যে কোনো মিল নেই। দুটি সম্পূর্ণ দুই ধরনের ব্যাপার। একটি হচ্ছে গ্রান্ড করাপশন (বড় দুর্নীত), আরেকটি হচ্ছে পেটি করাপশন (ছোট দুর্নীতি)। টিআইয়ের চিত্রটি হচ্ছে দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রের বড় দুর্নীতির ধারণা সূচক, আর এখনকার খানা জরিপটি হচ্ছে মাঠ পর্যায়ে সেবাগ্রহীতাদের অভিজ্ঞতালব্ধ প্রশ্নোত্তর বা বক্তব্যভিত্তিক। এখানে টিআইবির নিজস্ব কিছু নেই, ভুক্তভোগি মানুষ যা জানিয়েছে টিআইবি কেবল প্রতিবেদন আকারে তা তুলে ধরেছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির হার কমার ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতা ও সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপের ভূমিকা থাকতে পারে। বিশেষ করে জনগণের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি, কোনো কোনো সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধমে সেবাগ্রহণ প্রক্রিয়া সহজকরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিবিরোধী প্রশিক্ষণ, কোনো কোনো স্থানীয় সরকার পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং সর্বোপরি নাগরিক সমাজ, এনজিও ও গণমাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী সক্রিয় প্রচারণার ফলে সার্বিকভাবে জনসচেতনতা ও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান গ্রহণের সুযোগ, তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জন অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এসবের পরও যে হারে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ দেওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসহ কিছু খাতে দুর্নীতির প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস না পাওয়া হতাশাজনক।
ঘুষ দেওয়ার হার : এবারের খানা জরিপের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেবা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের ৫৩.৩ শতাংশ খানাকে কোনো না কোনো খাতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে, যার গড় ১৩ হাজার ৮৪ টাকা। জরিপকৃত সব খানার ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত এ অর্থের গড় ছয় হাজার ৯০০ টাকা। এই ভিত্তিতে প্রাক্কলনে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে প্রদত্ত মোট নিয়মবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ২১ হাজার ৯৫৫.৬ কোটি টাকা। নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ৭৭ শতাংশ দিতে হয়েছে শ্রম অভিবাসন খাতে। এরপর পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দিতে হয়েছে ৬৬.৯ শতাংশ, ভূমি প্রশাসনে ৫৪.৮ শতাংশ ও বিচারিক সেবায় ৩৮.১ শতাংশ, শিক্ষায় ৩০.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকারে ২৫.৫ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ২১.৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ১৬.২ শতাংশ, কর ও শুল্ক খাতে ১২.৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ খাতে ১২ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ৪.৯ শতাংশ, বীমা খাতে ৩.২ শতাংশ, এনজিও খাতে ১.৬ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে (বিভিন্ন ধরনের ছোট সরকারি প্রতিষ্ঠানে) ৩৪ শতাংশ অর্থ দিতে হয়েছে।
কেন ঘুষ দেওয়া হয়েছে : জরিপে অংশ নেওয়া ৫২.৫ শতাংশ খানার প্রতিনিধিরা জরিপ দলের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন নিয়মের বাইরে টাকা না দিলে সেবা পাওয়া যায় না, ৪২.৪ শতাংশ জানিয়েছেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দ্রুত সেবা পাওয়ার আশায় তারা অতিরিক্ত টাকা দিয়েছেন, ২৭.৮ শতাংশ জানিয়েছেন নির্ধারিত সময়ে সেবা পাওয়ার জন্য নিয়মের চেয়ে বেশি টাকা দিয়েছেন, ১৬.৩ শতাংশ বলেছেন হয়রানি বা জটিলতা এড়ানোর জন্য টাকা দিয়েছেন, ১২.৮ শতাংশ সেবা প্রদানকারীকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে টাকা দিয়েছেন এবং অন্যান্য কারণে টাকা দিয়েছেন ৭.৫ শতাংশ খানাওয়ালা।
যে হারে দুর্নীতি কমেছে : প্রতিবেদন অনুসারে ১৩টি খাতভেদে ২০১০ সালের তুলনায় এবারে (২০১২) দুর্নীতি কমার চিত্রে দেখা যায়, সার্বিক পর্যায়ের দুর্নীতির হার ৮৪.২ থেকে কমে ৫৫.৬, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ৭৯.৭ থেকে কমে ৭৫.৮, ভূমি প্রশাসনে ৭১.২ থেকে কমে ৫৯, বিচারিক সেবায় ৮৮ থেকে কমে ৫৭.১, স্থানীয় সরকারে ৪৩.৯ থেকে কমে ৩০.৯, কৃষি খাতে ৪৫.৩ থেকে ২০.৪, কর ও শুল্ক খাতে ৫১.৩ থেকে ১৬.৮, ব্যাংকিং খাতে ১৭.৪ থেকে ৭.১, বীমা খাতে ১৯.২ থেকে ৬ এবং এনজিও খাতে ১০.১ থেকে কমে ৫ শতাংশে নেমেছে। কেবল স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির হার ২০১০ সালের তুলনায় ৩৩.২ থেকে বেড়ে ৪০.২ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে (ছোটখাটো কিছু খাতে) ৩৪.১ থেকে বেড়ে ৫৪.৯ শতাংশে উঠেছে।
জরিপের পদ্ধতি : টিআইবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত ছয়টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। ২০১২ সালের জরিপে সেবা নেওয়ার সময়কাল ২০১১ সালের মে থেকে ২০১২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। গত ১৫ মে থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপের বৈজ্ঞানিক মান নিশ্চিতকল্পে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি ছয়জন জাতীয়-আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞের একটি দলের সহায়তা ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পদ্ধতি ব্যবহার করে জরিপটি পরিচালিত হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় ৬০ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৪০ শতাংশ নমুনা ধরে বিভিন্ন স্তরে সমন্বয় করে মোট জরিপকৃত খানার সংখ্যা ৭৯০৬। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ৪৬২৪ (৫৮.৫ শতাংশ), পৌরসভা ১৯৮১টি (২৫ শতাংশ), ংঃধঃরংঃরপধষ গবঃৎড়ঢ়ড়ষরঃধহ ধৎবধ (এসএমএ) ১৩০১ (১৬.৫ শতাংশ)। খানা নির্বাচনের জন্য দৈবচয়ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। খানা জরিপে তথ্যদাতার ধরনের মধ্যে খানাপ্রধান ৬৬.৩ শতাংশ, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ৩৩.৭ শতাংশ, ৩৫.৮ শতাংশ নারী এবং ৬৪.২ শতাংশ পুরুষ ছিলেন।
টিআইবির সুপারিশ : সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফলাফল ও পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণপূর্বক প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, সচেতনতা, প্রচারণা ও অ্যাডভোকেসি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে টিআইবির পক্ষ থেকে। এতে বলা হয়, সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রণোদনা প্রদান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ ও তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন ২০১১-এর কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বাধীন ও শক্তিশালী দুদক গঠন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের তদারকি বৃদ্ধি, জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সনদ বাস্তবায়ন, নাগরিক সমাজ প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের ভূমিকা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
এ জরিপে ব্যবহৃত দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে 'ব্যক্তিগত স্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার'। এ ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়া বা ঘুষ দিতে বাধ্য করা ছাড়াও অর্থ বা সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানিকে দুর্নীতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় বা বাধ্যতামূলকভাবে প্রদত্ত ঘুষ, প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ এবং আত্মসাৎকৃত অর্থকে নিয়মবহির্ভূত অর্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
No comments