ফিরে দেখা ২০১২: ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গন -ফুটবলে বড় স্বপ্ন
কেউই আভাস পেলেন না। শুনে সবারই চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! দেড় মাস আগে কাজী সালাউদ্দিন তাঁর চমকের ঝুলি থেকে বের করলেন দুটি শব্দ, ‘ভিশন ২০২২।’ কাতার বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখেন বাফুফে সভাপতি। প্রায় সবার কাছেই এটি বাস্তবতাবিবর্জিত এক চিন্তা।
কিন্তু এত বছর পরে হলেও কেউ তো ফুটবল নিয়ে স্বপ্নের বীজটা অন্তত বুনলেন! ২০১২ সালকে তাই আলাদা করে মনে রাখবেই বাংলাদেশের ফুটবল।
সালতামামিতে ক্রিকেট বাদে অন্যান্য খেলার পরিক্রমায় সালাউদ্দিনের ওই ঘোষণাটাই সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে। ২০১২ সালটা ফুটবলের মানচিত্রে আরও কিছু নতুন চিহ্ন এঁকেছে। হকি-দাবায় আছে কিছু সাফল্যের কোলাজ।
ফুটবল নিয়মিত মাঠে থাকছে, এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। মাঠে দর্শক সেভাবে আসছে না, সেটা ভিন্ন বিষয়। দর্শক না আসার কারণ অনেক। কিন্তু কয়েক বছর আগে ঢাকার ফুটবল নিয়মিত ছিল না। খেলোয়াড়দের আন্দোলন করতে হয়েছে। কিন্তু ক্যানভাসে ছবিটা এখন ভিন্ন। কানাগলি পেরিয়ে ফুটবল ক্যারাভান এখন মহাসড়কে।
ক্যারাভানের স্টিয়ারিং সালাউদ্দিনের হাতে, চালক হিসেবে যাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, চারদিকে শুধু আবর্জনা। ফুটবল উন্নয়ন নিয়ে অতীতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। তাই এখন সময় লাগছে। সালাউদ্দিন নিজেও সময় পেয়েছেন আরও চার বছর। এ বছরের এপ্রিলে হয়েছে বাফুফের নির্বাচন। বাফুফে সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত হয়ে এবার সালাউদ্দিন নজর দিয়েছেন অবহেলিত জেলার ফুটবলের দিকে। জেলাগুলোকে ডেকে আর্থিক অনুদান দিয়েছেন গত মাসে। জেলা লিগগুলো শুরু করাই মূল লক্ষ্য। জেলার জন্য একটা স্পনসরও পেয়েছেন। সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একটা চেষ্টা দৃশ্যমান, এটা তো আগে ছিল না।
জাতীয় দল নিয়ে কখনো যা হয়নি, এ বছর সেই মাইলফলকে পা রেখেছে বাফুফে। দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ফিফা-স্বীকৃত প্রীতি ম্যাচ খেলেছে তিনটি! তা-ও আবার প্রতিপক্ষের মাঠে। প্রথমে নেপাল, এরপর থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন বছরের শুরুতেও ঢাকায় কিছু ফিফা-স্বীকৃত প্রীতি ম্যাচ হওয়ার কথা। মোদ্দা কথা, জাতীয় দল নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
পাশাপাশি সিলেট বিকেএসপিতে একাডেমি গড়ার কাজে এসেছে অগ্রগতি। খেলোয়াড় বাছাইয়ের কাজ মোটামুটি শেষ। এটাও ফুটবলের দিনবদলের ইঙ্গিতবাহী। তৃণমূলের লিগগুলোও মোটামুটি মাঠে নামছে। কদিন আগে পাইওনিয়ার লিগ হয়েছে।
তবে পাতানো খেলার বিষবাষ্প এখনো উড়ে বেড়ানো, বাংলাদেশ লিগে দল কমে যাওয়া, তিনটি প্রীতি ম্যাচ বাদ দিলে জাতীয় দলের কোনো টুর্নামেন্টে আমন্ত্রণ না পাওয়া—কিছু নেতিবাচক দিক রয়ে গেছে। সাফ মহিলা ফুটবলে এবার গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। এসব এক পাশে রেখে বলা উচিত, সামগ্রিকভাবে ঘরোয়া ফুটবলের জন্য মোটামুটি আশাবাদী হওয়ার মতো একটা বছরই কাটল।
বিবর্ণ হকিতেও লেগেছে খানিক রং। জাতীয় দল দুটি টুর্নামেন্টে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে। ব্যাংককে এশিয়ান হকি ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন, সিঙ্গাপুরে বিশ্ব হকি লিগের প্রথম রাউন্ডে সেরা। সেই সুবাদে আসছে ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে দ্বিতীয় রাউন্ড খেলবে বাংলাদেশ। তৃতীয় রাউন্ডে যাওয়া বেশ কঠিন। সে যা-ই হোক, নিয়মিত খেলাই তো ছিল না আগে, এখন খেলাটা মোটামুটি মাঠে আছে। ‘মরা হকির’ জন্য তা কম কী!
দাবার অনৈক্যের সুরে ঐক্যের গান বেজেছে। ফেডারেশনের বহুকাঙ্ক্ষিত নির্বাচন হয়েছে এ বছরই, দূরত্ব ভুলে ‘এক’ হয়েছেন পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার। এরই ফল এসেছে হাতেনাতে। বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে দেশের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে ভালো ফল (৩৩তম) হয়েছে। এশিয়ান র্যা ঙ্কিংয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন ষষ্ঠ। ভারতে নাগপুর গ্র্যান্ডমাস্টার্স দাবায় চ্যাম্পিয়ন জিয়াউর রহমান, ভাইজাগ দাবায় সেরা এনামুল হোসেন রাজীব। নাজরানা খানের মহিলা ফিদে মাস্টার হওয়া, বছরান্তে এশিয়ান অনূর্ধ্ব-৯ বিভাগে ফাহাদ রহমানের সোনা জয়—এগুলোও বাদ যাবে কেন!
অন্য খেলার মধ্যে হ্যান্ডবল যথারীতি বছরব্যাপী মাঠে। আন্তর্জাতিক একটা অর্জনও আছে হ্যান্ডবলে। আন্তর্জাতিক হ্যান্ডবল ফেডারেশন ট্রফির মধ্য ও এশীয় অঞ্চলের মহিলা বিভাগে বাংলাদেশ রানার্সআপ। সিদ্দিকুর রহমানের জন্য বছরটা ভালো না কাটলেও সামগ্রিকভাবে গলফ এগোচ্ছে। জুনে লন্ডন অলিম্পিকে সিপ্রন্টার মোহন খান নিজের সেরা টাইমিং করেছেন। এর বাইরে শুধুই হতাশা। অ্যাথলেটিকস, সাঁতারসহ অনেক খেলাই ধুঁকছে। সাঁতারের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৩৬টি ইভেন্টে রেকর্ড মাত্র একটি! সম্ভাবনাময় শ্যুটিংয়ের আকাশে এখন কালো মেঘের ঘনঘটা।
ক্রীড়াঙ্গনে নির্বাসিত নিবাচন ফিরেছে এ বছর। নির্বাচনের মাধ্যমে অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে এসেছে নতুন কমিটি। একটা পরিবর্তনের হাওয়া ছিলই, নতুন বছরে সেই হাওয়ায় কি ভাসবে মাঠের পারফরম্যান্স?
No comments