চরম নিরাপত্তাহীনতায় ঠিকাদাররা : টেন্ডার নিয়ে তিন বছরে ৫০০ সংঘর্ষ, নিহত অর্ধশতাধিক by কাদের গনি চৌধুরী

টেন্ডার নিয়ে গত তিন বছরে সারাদেশে পাঁচশ’র বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। খুন হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ ঠিকাদার। একের পর এক খুনের ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন ঠিকাদাররা। অনেকে প্রাণভয়ে এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে টেন্ডার কাজে অংশ নেন। ক্ষমতা ব্যবহার করে অল্পদিনে বিত্তবান হওয়ার লালসা এই টেন্ডার-সন্ত্রাসের অন্যতম কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। আর এই লোভকে উসকে দিয়েছে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট বা সরকারি ক্রয় আইনের পরিবর্তন।


গত তিন বছরের সংঘর্ষ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেশিরভাগ সংঘর্ষ হয়েছে সরকারি দলের সমর্থক দুই গ্রুপ টেন্ডারবাজের মধ্যে। তবে কখনও বিরোধী দলের সমর্থকদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন, আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সাধারণ ঠিকাদারদের সংঘর্ষ ঘটেছে। যেখানেই টেন্ডার সেখানেই ক্ষমতাসীন দলের টেন্ডারবাজরা হামলে পড়েছে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, মারপিট, খুন-জখম ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয় প্রায় প্রতিটি টেন্ডারের সময়। এ কারণে সাধারণ ঠিকাদারদের অনেকেই এখন ভয় পান টেন্ডার জমা দিতে। আবার অনেক সময় সরকারি দলের প্রভাবশালী ক্যাডাররা অন্যদের টেন্ডার জমা পর্যন্ত দিতে দেয় না।
এক্ষেত্রে অসহায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও। তারা কিছুই বলতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করতে অন্যায়কেও সমর্থন দিতে বাধ্য হচ্ছেন টেন্ডারসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সর্বনিম্ন দরদাতা হলেই এখন আর কাজ পাওয়া যায় না। সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন দরদাতা বলে এখন এককভাবে নির্ণায়ক কিছু নেই। নেতা, এমপি ও মন্ত্রীদের নাম ভাঙিয়ে দলীয় সমর্থকদের ভাগ্যেই জুটছে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশব্যাপী টেন্ডার নিয়ে পাঁচ শতাধিক সংঘর্ষ এবং অর্ধশতেরও বেশি ঠিকাদার খুন হয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানীর সূত্রাপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মো. শহীদ (৩৫) নামে এক ঠিকাদার খুন হয়েছেন। রাত সাড়ে ১১টায় মোটরসাইকেলে শহীদ বাংলাবাজারে বাসায় যাওয়ার সময় লালমোহন দাস স্ট্রিটে পৌঁছলে দুই অস্ত্রধারী তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ রাস্তায় পড়ে যান। পরে আশপাশের লোকজন শহীদকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। শহীদ বাংলাবাজার বইবাঁধাই সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালের একজন ঠিকাদার।
ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুলনা অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা ও যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি শহীদ ইকবাল ওরফে বিথার খুন হন। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জবানবন্দি অনুযায়ী, মূলত ঠিকাদারি ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিতেই পরিকল্পিতভাবে বিথারকে খুন করা হয়েছে। আর এই খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম এসেছে স্থানীয় চার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার। ওই ১৫ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এসব জবানবন্দিতে বিথার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজী আমিনুল হক, মিজানুর রহমান, আনিসুর রহমান পপলু ও সাইফুল ইসলামের নাম রয়েছে।
এসব জবানবন্দি ও খুলনা মহানগর পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত অনুযায়ী, খুলনা আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় নেতা ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিথারকে বাধা মনে করতেন। খুলনার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বিথার ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। বিথার খুন হওয়ার পর মেয়র খালেক একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছেন।
২০০৯ সালের ১১ জুন রাতে বিথার খুন হওয়ার পর যুবলীগ নেতা মেসবাহ হোসেইন ওরফে বুরুজসহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে সবে কাদির নামে এক আসামি ছাড়া সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রভাবশালী নেতাদের নাম আসায় মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ শাখায় পাঠানো হয়েছে।
রংপুরে ছাত্রলীগ নেতা ও র্যাবের ২ সোর্সসহ ৩ জনকে নৃশংসভাবে খুন করেছে সন্ত্রাসীরা। গত ৪ দিনে রংপুরে এই ৩ খুনের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে কোতোয়ালি থানায় পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ রানার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
রংপুর বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের টেন্ডারের ৯ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জের ধরে খুন হন রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও ঠিকাদার মাসুদ রানা। ঝিনাইদহের শৈলকূপায় হাটবাজার ইজারার টেন্ডার জমা দেয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুুপের সংঘর্ষে রশিদ নামে একজন নিহত হন। রাজশাহীতে খুন হন ঠিকাদার আবদুল কুদ্দুস। দরপত্র দাখিলকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড়ে সরকারি দলের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে ফারুক হোসেন নামে এক ঠিকাদার খুন হন। দিনাজপুর গণপূর্ত বিভাগে জেলা কারাগারে কয়েদি ব্যারাক নির্মাণে প্রায় ১৪ কোটি টাকার দরপত্র জমা দেয়াকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষ হয়। সাভারের আশুলিয়ায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ঠিকাদার রাশেদ মিলন খুন হন সম্প্রতি। সন্ত্রাসীরা এ ব্যবসায়ীর লাশ আশুলিয়ার পাড়াগ্রাম এলাকার সাদুপাড়া মহল্লার লেকের পাড়ে ড্রেনে ফেলে দেয়।
চট্টগ্রামের হালিশহরে দিনদুপুরে সন্ত্রাসীরা আবদুল মোনাফ (৩১) নামে এক ঠিকাদারকে গুলি করে হত্যা করেছে। টেন্ডারকে কেন্দ্র করেই এ খুনের ঘটনা। রাজধানীর মোহাম্মদপুর নূরজাহান রোডে সন্ত্রাসীদের গুলিতে তানজীব হোসেন জনি নামে এক ঠিকাদার খুন হন। তিনি বাংলাদেশ ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেন মণ্ডলের ছেলে। তাদের বাড়ি মোহাম্মদপুরের ১১০/এ কাটাসুর, নামারবাজারে। রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ঠিকাদার শাহজান মিয়া খুন হন। তিনি ৭৮৬/১ পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসায় ভাড়া থাকতেন। তিনি স্থানীয় ১৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেও জানা গেছে। রাত সোয়া ৯টায় শাহজান মিয়া বাসায় ফেরার পথে দক্ষিণ শেওড়াপাড়ার সিদ্দীক মিয়ার রিকশা গ্যারেজের কাছে পৌঁছামাত্র ৪-৫ সন্ত্রাসী তাকে ঘিরে ধরে মাথা ও বুকের বাঁ পাশ লক্ষ্য করে পরপর কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এসময় গুলিবিদ্ধ শাহজান মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আশপাশের লোকজন প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নেন। অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রাত পৌনে ১০টায় সেখানকার কর্তব্যরত চিকিত্সক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সিলেটে খুন হয়েছেন ঠিকাদার রহমত আলী। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজতুরীবাজার এলাকায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সন্ত্রাসীদের গুলিতে মাসুম ভূইয়া বাবলু (৪২) নামে এক ঠিকাদার খুন হন। তিনি ছিলেন বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের একজন নেতা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার সময় বিজ্ঞান কলেজের কাছে মাসুমের ওপর গুলি চালানো হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিত্সকরা জানান, মাসুম মারা গেছেন।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই রাজধানীর বাড্ডায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ঠিকাদার নাজিম। রাজধানীর মধ্যবাড্ডার রিংরোডের জমিদারবাড়ির মোড়ে সন্ত্রাসীরা নাজিম ও তার বন্ধু উজ্জ্বলকে লক্ষ্য করে অতর্কিত গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই নাজিম নিহত হন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কাশিয়ানীতে পীযূষ কান্তি বিশ্বাস (৩৩) নামে এক ঠিকাদারকে হত্যা করা হয়। নওগাঁ সদর উপজেলার পার-বোয়ালিয়া গ্রামে জুবায়ের হোসেন লিটন নামে এক ঠিকাদারকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত ১৫ জুন রাজশাহী মহানগরীর কোর্ট হড়গ্রামবাজার এলাকায় আবদুল কুদ্দুস নামে এক ঠিকাদারকে খুন করা হয়। গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঠিকাদারি নিয়ে বিরোধ, মাদক ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার ও দলীয় কোন্দলের কারণেই খুন হয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা এবিএম ফারুক হোসেন আরমান। সবুজবাগের মাদারটেকে ব্যবসায়িক বিরোধের জের ধরে খুন করা হয়েছে ঠিকাদার আল আমিনকে। রংপুরে গতবছর ঈদের আগের দিন টেন্ডার ভাগাভাগি নিয়ে এক ঠিকাদারকে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। ঈদের রাতে শহরের অদূরে পাগলাপীর এলাকায় আরও দুই ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে খুন হন ঠিকাদার কালাম। গত বছরের ১৫ নভেম্বর রাতে বরমা ইউনিয়নের চরবরমা গ্রামের বজল আহমদের ছেলে ঠিকাদার আবুল কালামকে (৪২) ডেকে নিয়ে হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে রাখা হয়। পরদিন সকালে স্থানীয় লোকজন খবর দিলে পুকুর থেকে কালামের লাশ উদ্ধার করে থানা পুলিশ।
নিষেধ উপেক্ষা করে টেন্ডার জমা দেয়ায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ ক্যাডারদের হাতে প্রাণ দিতে হলো সঞ্জীব দাশকে (৪০)। গত বছরের ৮ এপ্রিল রাতে নগরীর টাইগারপাস এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসীরা তাকে লাঠি, হকিস্টিক এবং লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। নিহত সঞ্জীব দাশ কালুরঘাট শিল্প এলাকার হলি জিপার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি নগরীর চন্দপুরার গোলাম রহমান লেনের পেশকার ভবনের (৪র্থ তলা) নির্মল কুমারের ছেলে। রাজধানীর মহাখালী সেতু ভবন ও বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে ঢাকা মহানগর (উত্তর) যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার পাশা ওরফে লিটনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গতবছর মহাখালীর একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে সন্ত্রাসীরা আনোয়ার পাশাকে হত্যা করে। নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসীরা ফজল শেখ (৩৮) নামে এক নির্মাণ ঠিকাদারকে হত্যা করে। নিহত ফজল শহরের মধ্য সৈয়দপুর এলাকার মৃত নেওয়াজ আলী শেখের ছেলে। মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ঠিকাদারি কাজের বিরোধ নিয়ে খুন হয়েছেন ঢাকা (উত্তর) যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন পাশা ওরফে লিটন। গত ১৯ জুলাই ঢাকা (উত্তর) যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লিটন (৪২) খুন হন। মহাখালী আমতলী এলাকার একটি হোটেলে প্রবেশের মুখে সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে খুন করে। গতবছর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মাহমুদাবাদ এলাকায় মাইক্রোবাসে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় দুলাল মিয়া (৩০) নামে এক ঠিকাদারকে।
টেন্ডারবাজিতে জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের ঘোষণার এক ঘণ্টার মাথায় সরকারি দলের ক্যাডারদের হামলায় রাজধানীতে খুন হন যুবলীগ নেতা ইউসুফ আলী সরদার। এরপর টেন্ডারবাজি আর খুনোখুনি তো কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে পাল্লা দিয়ে।
সারাদেশে সরকারদলীয় ক্যাডারদের বেপরোয়া টেন্ডারবাজি ঠেকাতে প্রশাসনও ব্যর্থ হচ্ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন, শিক্ষাভবন, এলজিইডিই নয়, এ টেন্ডার সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বলেও। ঢাবি, জাবি ও জবিসহ অনেক শিক্ষাঙ্গনেই ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতা ও ক্যাডার ব্যাপক টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। একপর্যায়ে এদের কর্মকাণ্ড এতটাই মাত্রা ছাড়িয়ে যায় যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে তার সাংগঠনিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন ছাত্রলীগের সঙ্গে। মূল দলের সাধারণ সম্পাদক বারবার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। তাতেও টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি কখনোই বন্ধ থাকেনি। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও টেন্ডার নিয়ে সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, টেন্ডারবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কিছু লোক জড়িত। আলোচিত দিনাজপুরের টেন্ডার নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় প্রথম সারির কয়েকজন ঠিকাদার পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ জেলা আওয়ামী লীগের দু’নেতা এজন্য দায়ী।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় ও সব আঞ্চলিক কার্যালয়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, রেলওয়ে, স্বাস্থ্য, বিদ্যুত্ বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, ওয়াসা, কৃষিসহ সব বিভাগেই টেন্ডারবাজি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যার আসামি সরকারি দলের এমপি শাওন ঢাকা সিটি করপোরেশনের বেশিরভাগ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ঢাকা দক্ষিণের এক যুবলীগ নেতা, এক এমপি, এক এমপিপুত্র, এক এমপির ভাই, সাবেক এক ছাত্রনেতার দুই ভাগ্নে ঢাকা দক্ষিণ এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন। টেন্ডারবাজরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলেও আন্ডার ওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও পেশাদার খুনিদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। টেন্ডার নিয়ে সংঘর্ষ হলে পেশাদার খুনি ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মহড়া দেয়। এমনকি নিজদলের হলেও তারা একে অন্যের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়, জড়িয়ে পড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামনে এসব ঘটনা ঘটলেও দলীয় পরিচয়ের কারণে তারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে উল্টো তারা অভিযুক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে প্রশাসন বারবারই টেন্ডারবাজদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
টেন্ডার নিয়ে খুন-সংঘর্ষের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইদানীং নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে কাজ ভাগাভাগি করে নেয়ার কৌশল নিয়েছে সরকারি দলের ক্যাডাররা। মিডিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের টেন্ডারবাজি নিয়ে খবর প্রকাশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় দলীয় ক্যাডাররা এ সিদ্ধান্ত নেয়। আর তাদের সমঝোতার কারণে প্রকৃত ঠিকাদাররা পড়ছেন সমস্যায়। তারা এখন কোনো কাজ পাচ্ছেন না। তাদের দু-একটি কাজ নিতে হলে সরকারি দলের ক্যাডারদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকেও ঠিকাদারি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ ভবন, শিক্ষাভবন, সিটি করপোরেশন ও ওয়াসায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। টেন্ডার নিয়ে তাদের অভিযোগের অন্ত নেই। কোথাও কোথাও টেন্ডারের কাগজপত্রই অফিস থেকে সরবরাহ করা হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাধারণ ঠিকাদারদের অনেকে অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্যে তারা টেন্ডার জমা দিতে পারেন না। তারা টেন্ডার দলিলাদি ক্রয় করতে চাইলেও মহাজোটপন্থী ঠিকাদারদের ভয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তা দেন না।

No comments

Powered by Blogger.