মহাপরিকল্পনায় মহাগাফিলতি by এহসানুল হক
যেকোনো বড় ঘটনা, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরপরই তা প্রতিরোধে ঢাকঢোল পিটিয়ে নেওয়া হয় 'মহাপরিকল্পনা'। গঠন করা হয় নানা ধরনের কমিটি, কমিশন। অন্তর্ভুক্ত করা হয় বিভিন্ন স্তরের আমলাদের। চলে বৈঠকের পর বৈঠক। প্রণয়ন হয় নানা সুপারিশ। চালাচালি হয় চিঠির পর চিঠি। এসব কাজ করতে সরকারের কোষাগার থেকে বেরিয়ে যায় মোটা অঙ্কের টাকা। অহেতুক ব্যয় হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যবান কর্মঘণ্টা। তারপর সব 'ঠাণ্ডা'। আলোর মুখ আর দেখে না মহাপরিকল্পনাগুলো। সেই সুযোগে বারবার ঘটতে থাকে অযাচিত সর্বনাশা ঘটনাগুলো।
এভাবেই জলাবদ্ধতা, সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনা, পাহাড় ও ভবন ধস, ভূমিকম্প, শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পোশাক শিল্প খাতে অস্থিতিশীলতা, জঙ্গিবাদের প্রসার, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ বড় বড় ঘটনা, দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে বিগত সরকারগুলো; কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার চরম গাফিলতিতে শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেছে সবকিছু। এ কাজে পিছিয়ে নেই বর্তমান মহাজোট সরকারও।
মূলত সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, দক্ষ লোকবলের স্বল্পতা, আর্থিক দৈন্যদশা, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অর্থ ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতা, ক্ষমতা বদলের পর আগের সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ আমলে না নেওয়া, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবেই সরকারের মহাপরিকল্পনাগুলো ভেস্তে যায়। এ রকম বেশ কিছু ব্যর্থ পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে।
জঙ্গিবাদ নির্মূল : ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম বিষয় ছিল জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ও নির্মূল করা। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সরকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে 'জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটি' নামে একটি কেন্দ্রীয় ফোরাম গঠন করে। প্রতিটি জেলায় গঠন করা হয় একই ধরনের কমিটি। গত আড়াই বছরে কেন্দ্রীয় কমিটি ১১টি বৈঠক করে ছয় মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে জঙ্গি দমনে প্যাকেজ কর্মসূচি হাতে নেয়। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় জঙ্গিদের রুট নির্মূল, সারা দেশের মহল্লা-পাড়ায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো, জঙ্গিদের গডফাদারসহ আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও অর্থ জোগানদাতাদের চিহ্নিত করা এবং জনগণকে সচেতন করতে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও বেতারে জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা চালানো, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজের সিলেবাসে জঙ্গিবাদের নেতিবাচক বিষয় অন্তর্ভুক্ত এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি আরো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কমিটির ১১তম সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, আড়াই বছরের বেশি সময় চলে গেলেও প্যাকেজের বেশির ভাগ কর্মসূচিই বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে। শুধু বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন অনিয়মিতভাবে জনসচেতনতামূলক কিছু অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। অন্যগুলোর অগ্রগতি খুবই সামান্য। এসব কর্মসূচি জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন না করলে যেকোনো সময় বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকেই। জেলা কমিটিগুলো তেমন সক্রিয় নয় বলে স্বরাষ্ট্রসচিব সভাকে অবহিত করেন।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের অভিযোগ, গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি জানাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় সময়ই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; কিন্তু তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় না। জঙ্গিবাদ নিরসনে বিগত জোট সরকারও একই ধরনের প্যাকেজ কর্মসূচি নিয়েছিল; কিন্তু চিঠি চালাচালির মধ্য দিয়েই তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে নিয়মিতভাবে কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। এমনকি জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার অনুরোধ জানিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে সব সংসদ সদস্যের কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। গৃহীত কার্যক্রমগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন অথবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ইউনিট : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সংঘটিত একাধিক ক্যু-এর ঘটনা, ১৯৭২, ১৯৯১ ও ২০০৯ সালে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সৈনিকদের বিদ্রোহ, ১৯৯৫ সালে আনসার সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনা, রমনা বটমূল ও উদীচীর সম্মেলনসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা এবং বিগত জোট সরকার আমলে দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারকে আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বা কমিশন বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না, তা তদারকি করতে একটি 'কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ইউনিট' গঠনের সুপারিশ করে। বিগত জোট সরকারের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০০২ সালে এ ইউনিট গঠনের উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত কমিশনও এ ইউনিট গঠনের সুপারিশ করে। কিন্তু আজও সেটি প্রতিষ্ঠা হয়নি। উল্লেখ্য, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা_ডিজিএফআইয়ের 'কাউন্টার টেরোরিজম ইনটেলিজেন্স ব্যুরো' আছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, যার ফলে দেশে এখন তেমন কোনো সন্ত্রাসমূলক ঘটনা ঘটছে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন : খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানির পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তী সময় প্রায় দুই ডজন বৈঠকের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। আইনটি প্রণয়নের আগেই তৎকালীন বিএনপি সরকার বিদায় নেয়। এর পর যত সরকার এসেছে, সবাই প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। আইন প্রণয়নের তাগিদ বোধ করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রস্তাবিত আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একাধিক বৈঠক করে নতুন খসড়াও তৈরি করেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।
জানতে চাইলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব ড. এম আসলাম আলম গত রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার এ আইনটি অবশ্যই প্রণয়ন করবে। আইনের খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে অনুমোদনের জন্য যত দ্রুত সম্ভব মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে।
উল্লেখ্য, এ আইনটি প্রণয়ন হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসংক্রান্ত সব ঘটনার আগাম প্রস্তুতিসহ পরবর্তী করণীয় সুনির্দিষ্ট আকারে নির্ধারিত হবে।
এনজিও আইন : এনজিওগুলোর সার্বিক কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রায় দুই বছর আগে এ-সংক্রান্ত নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত হলেও রহস্যজনক কারণে আজো সেটি প্রণীত হয়নি। ৫০ বছরের পুরনো আইন দিয়েই দেশে চলছে আড়াই লাখ এনজিওর যাবতীয় কর্মকাণ্ড। এতে বিভিন্ন এনজিওর বিরুদ্ধে উত্থাপিত জঙ্গিবাদে অর্থায়ন, তৈরি পোশাক শিল্পসহ রপ্তানি খাতকে অস্থিতিশীল করা, বিদেশি তহবিলের অপব্যবহার, বিভ্রান্তিকর তথ্য পাচার ও প্রকাশ করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সমাজসেবার নামে পুরোদমে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ থাকলেও বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অনিয়মের জন্য প্রায় ছয় হাজার এনজিওর সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আর যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ জোগানের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি খসড়া আইনটি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ : ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ 'ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ ও বাইপাস' প্রকল্পটির পরিকল্পনা করে। দুই হাজার ৪৭৫ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয়ের প্রকল্পটি তখনই একনেকে অনুমোদন হয়। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ আরো একাধিক দাতা সংস্থা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থসহায়তা দিতে আগ্রহ দেখায়। প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নানামুখী সমীক্ষাও চলে অনেক দিন। একপর্যায়ে ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার টাকা না পাওয়ার অজুহাতে প্রকল্পটি স্থগিত করে দেয়। এরপর থেকে প্রতিবারই এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তোড়জোড় শুরু করে।
পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী সুনীল চন্দ্র দেবরাই কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রকল্পটি খুবই বড় হওয়ার কারণে অর্থায়নে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কয়েক দফা রিভাইজের পর প্রকল্প ব্যয় এসে দাঁড়িয়েছিল তিন হাজার কোটি টাকায়। এখন আমরা আবারও রিভাইজ করছি। এতে প্রাক্কলন ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। তবে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে অর্থের জোগানদাতা খুঁজে বের করতে। সে পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত বলা যায়।'
জলাবদ্ধতা : বিগত আওয়ামী লীগ ও জোট সরকার এবং ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ভারি বর্ষণে ঢাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ওয়াসা একাধিক প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু কোনোটিই সময়মতো সম্পন্ন করতে পারেনি। রাজধানীর খাল রক্ষা ও সংস্কারের জন্য ২০০২ সালে এডিবির অর্থায়নে এক হাজার ৪৬০ কোটির প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি নেই। ঢাকা ওয়াসা বলছে, এ অর্থ একসঙ্গে পাওয়া যায় না বলেই এটা সম্ভব হয় না। ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ২৫ ভাগও কাজ সম্পন্ন হয়নি।
ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যখন জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, তখন আমরা এসব প্রকল্প নিয়ে তৎপর হয়ে পড়ি। কিন্তু এবার ওয়াসা সেটা করছে না। ঈদের পরপরই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করার কাজ শুরু হবে। এমনভাবে করা হবে, যাতে আগামীতে আর কোনো জলাবদ্ধতা না হয়।'
ভূমিকম্প ও ভবন ধস : বিগত জোট সরকার আমলে ঢাকায় ফিনিঙ্ ভবন ও সাভার এলাকায় একটি বহুতল গার্মেন্ট ভবন ধসে পড়ে। প্রশিক্ষিত লোকবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। নানা কার্যক্রম হাতে নেয় সরকার। কিন্তু অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় ২০০৯ সালে হাইকোর্ট একটি রিটের আলোকে সরকারকে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ প্রণয়নের জন্য 'ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি বিষয়ক কমিটি' গঠনের নির্দেশ দেন। এরপর খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ৩৯ সদস্যের এক বিশাল কমিটি গঠন করে। ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে এ কমিটি গঠন করা হলেও ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রথম বৈঠকে বসে। গত মাসে দেশে ভূমিকম্প হওয়ার পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কোনো সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে দেশে ছোট-বড় ১০০টি ভূমিকম্প ধরা পড়ে। রাজধানীতে ভবন নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড মানা হয় কি না তা তদারকি করে রাজউক। কিন্তু উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়েও বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে বিল্ডিং কোড তদারকির কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বিল্ডিং কোড তদারকির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি আরো বলেছেন, 'আদালতের রায়ের বাইরেও আমরা অনেক কাজ করেছি। হয়তো সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়নি, কিন্তু কাজ থেমে নেই।'
সড়ক দুর্ঘটনা : সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর উদ্দেশ্যে ১৯৯৫ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ। গত ১৫ বছরে এ পরিষদ ২০টি বৈঠক করে ২৩টি সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, সিএনজি অটোরিকশার নতুন নিবন্ধন বন্ধ রাখা ও বিআরটিএর আইন-নীতিমালা সংশোধন করা_এই তিনটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ২০টি ঝুলে আছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে দেশে বছরে গড়ে ১২ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ৪০ হাজার ৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২ হাজার ২৬১ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় ২৯ হাজার ৬৭৯ ব্যক্তি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
পাহাড় ধস : ২০০৭-০৮ সালে পৃথক কয়েকটি পাহাড় ধসের ঘটনায় চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার ও পার্বত্য জেলাগুলোয় দেড় শতাধিক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটি মন্তব্য করে। ওই সময় পাহাড় কাটা বন্ধ করতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি ঘটনার পর পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনও নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেখানে আবার বসবাস শুরু হয়, যার পরিণতি ২০০৯ সালে বান্দরবানে পাহাড়ধসের ঘটনায় ১০ জন নিহত। ২০১০ সালে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করার বিষয়টি পরিবেশ আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এখনো নির্বিঘ্নে চলছে পাহাড় কাটা।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি মনে করি সরকারগুলো শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করে, সেগুলোই অবাস্তবায়িত থাকে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে জনগণকে দেখানো হয়_সরকার বেশ কাজ করছে। আসলে প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তাহলেই সরকার পরিবর্তন হলেও চলমান কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি থেমে থাকবে না।'
মূলত সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, দক্ষ লোকবলের স্বল্পতা, আর্থিক দৈন্যদশা, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অর্থ ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতা, ক্ষমতা বদলের পর আগের সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ আমলে না নেওয়া, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবেই সরকারের মহাপরিকল্পনাগুলো ভেস্তে যায়। এ রকম বেশ কিছু ব্যর্থ পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে।
জঙ্গিবাদ নির্মূল : ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম বিষয় ছিল জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ও নির্মূল করা। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সরকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে 'জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটি' নামে একটি কেন্দ্রীয় ফোরাম গঠন করে। প্রতিটি জেলায় গঠন করা হয় একই ধরনের কমিটি। গত আড়াই বছরে কেন্দ্রীয় কমিটি ১১টি বৈঠক করে ছয় মন্ত্রণালয় সমন্বয়ে জঙ্গি দমনে প্যাকেজ কর্মসূচি হাতে নেয়। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় জঙ্গিদের রুট নির্মূল, সারা দেশের মহল্লা-পাড়ায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো, জঙ্গিদের গডফাদারসহ আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও অর্থ জোগানদাতাদের চিহ্নিত করা এবং জনগণকে সচেতন করতে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও বেতারে জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা চালানো, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজের সিলেবাসে জঙ্গিবাদের নেতিবাচক বিষয় অন্তর্ভুক্ত এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি আরো জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কমিটির ১১তম সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, আড়াই বছরের বেশি সময় চলে গেলেও প্যাকেজের বেশির ভাগ কর্মসূচিই বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে। শুধু বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন অনিয়মিতভাবে জনসচেতনতামূলক কিছু অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। অন্যগুলোর অগ্রগতি খুবই সামান্য। এসব কর্মসূচি জরুরি ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন না করলে যেকোনো সময় বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেকেই। জেলা কমিটিগুলো তেমন সক্রিয় নয় বলে স্বরাষ্ট্রসচিব সভাকে অবহিত করেন।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের অভিযোগ, গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি জানাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় সময়ই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; কিন্তু তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় না। জঙ্গিবাদ নিরসনে বিগত জোট সরকারও একই ধরনের প্যাকেজ কর্মসূচি নিয়েছিল; কিন্তু চিঠি চালাচালির মধ্য দিয়েই তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার কমিটির সভাপতি শামসুল হক টুকু গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে নিয়মিতভাবে কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। এমনকি জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার অনুরোধ জানিয়ে কমিটির পক্ষ থেকে সব সংসদ সদস্যের কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। গৃহীত কার্যক্রমগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন অথবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ইউনিট : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সংঘটিত একাধিক ক্যু-এর ঘটনা, ১৯৭২, ১৯৯১ ও ২০০৯ সালে বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সৈনিকদের বিদ্রোহ, ১৯৯৫ সালে আনসার সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনা, রমনা বটমূল ও উদীচীর সম্মেলনসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা এবং বিগত জোট সরকার আমলে দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারকে আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বা কমিশন বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কি না, তা তদারকি করতে একটি 'কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ইউনিট' গঠনের সুপারিশ করে। বিগত জোট সরকারের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০০২ সালে এ ইউনিট গঠনের উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের তদন্ত কমিশনও এ ইউনিট গঠনের সুপারিশ করে। কিন্তু আজও সেটি প্রতিষ্ঠা হয়নি। উল্লেখ্য, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা_ডিজিএফআইয়ের 'কাউন্টার টেরোরিজম ইনটেলিজেন্স ব্যুরো' আছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, যার ফলে দেশে এখন তেমন কোনো সন্ত্রাসমূলক ঘটনা ঘটছে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন : খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক লাখ মানুষের প্রাণহানির পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরবর্তী সময় প্রায় দুই ডজন বৈঠকের মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। আইনটি প্রণয়নের আগেই তৎকালীন বিএনপি সরকার বিদায় নেয়। এর পর যত সরকার এসেছে, সবাই প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। আইন প্রণয়নের তাগিদ বোধ করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রস্তাবিত আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একাধিক বৈঠক করে নতুন খসড়াও তৈরি করেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।
জানতে চাইলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব ড. এম আসলাম আলম গত রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার এ আইনটি অবশ্যই প্রণয়ন করবে। আইনের খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে অনুমোদনের জন্য যত দ্রুত সম্ভব মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে।
উল্লেখ্য, এ আইনটি প্রণয়ন হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসংক্রান্ত সব ঘটনার আগাম প্রস্তুতিসহ পরবর্তী করণীয় সুনির্দিষ্ট আকারে নির্ধারিত হবে।
এনজিও আইন : এনজিওগুলোর সার্বিক কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রায় দুই বছর আগে এ-সংক্রান্ত নতুন আইনের খসড়া চূড়ান্ত হলেও রহস্যজনক কারণে আজো সেটি প্রণীত হয়নি। ৫০ বছরের পুরনো আইন দিয়েই দেশে চলছে আড়াই লাখ এনজিওর যাবতীয় কর্মকাণ্ড। এতে বিভিন্ন এনজিওর বিরুদ্ধে উত্থাপিত জঙ্গিবাদে অর্থায়ন, তৈরি পোশাক শিল্পসহ রপ্তানি খাতকে অস্থিতিশীল করা, বিদেশি তহবিলের অপব্যবহার, বিভ্রান্তিকর তথ্য পাচার ও প্রকাশ করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সমাজসেবার নামে পুরোদমে ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ থাকলেও বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ গত শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অনিয়মের জন্য প্রায় ছয় হাজার এনজিওর সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আর যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ জোগানের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি খসড়া আইনটি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আরো কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধন করা হবে। যত দ্রুত সম্ভব এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ : ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ 'ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বাঁধ ও বাইপাস' প্রকল্পটির পরিকল্পনা করে। দুই হাজার ৪৭৫ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয়ের প্রকল্পটি তখনই একনেকে অনুমোদন হয়। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ আরো একাধিক দাতা সংস্থা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থসহায়তা দিতে আগ্রহ দেখায়। প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নানামুখী সমীক্ষাও চলে অনেক দিন। একপর্যায়ে ২০০৫ সালে বিএনপি সরকার টাকা না পাওয়ার অজুহাতে প্রকল্পটি স্থগিত করে দেয়। এরপর থেকে প্রতিবারই এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তোড়জোড় শুরু করে।
পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী সুনীল চন্দ্র দেবরাই কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রকল্পটি খুবই বড় হওয়ার কারণে অর্থায়নে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কয়েক দফা রিভাইজের পর প্রকল্প ব্যয় এসে দাঁড়িয়েছিল তিন হাজার কোটি টাকায়। এখন আমরা আবারও রিভাইজ করছি। এতে প্রাক্কলন ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। তবে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে অর্থের জোগানদাতা খুঁজে বের করতে। সে পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত বলা যায়।'
জলাবদ্ধতা : বিগত আওয়ামী লীগ ও জোট সরকার এবং ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ভারি বর্ষণে ঢাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ওয়াসা একাধিক প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু কোনোটিই সময়মতো সম্পন্ন করতে পারেনি। রাজধানীর খাল রক্ষা ও সংস্কারের জন্য ২০০২ সালে এডিবির অর্থায়নে এক হাজার ৪৬০ কোটির প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি নেই। ঢাকা ওয়াসা বলছে, এ অর্থ একসঙ্গে পাওয়া যায় না বলেই এটা সম্ভব হয় না। ২০১৩ সালের মধ্যে প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ২৫ ভাগও কাজ সম্পন্ন হয়নি।
ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যখন জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, তখন আমরা এসব প্রকল্প নিয়ে তৎপর হয়ে পড়ি। কিন্তু এবার ওয়াসা সেটা করছে না। ঈদের পরপরই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করার কাজ শুরু হবে। এমনভাবে করা হবে, যাতে আগামীতে আর কোনো জলাবদ্ধতা না হয়।'
ভূমিকম্প ও ভবন ধস : বিগত জোট সরকার আমলে ঢাকায় ফিনিঙ্ ভবন ও সাভার এলাকায় একটি বহুতল গার্মেন্ট ভবন ধসে পড়ে। প্রশিক্ষিত লোকবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। নানা কার্যক্রম হাতে নেয় সরকার। কিন্তু অগ্রগতি সন্তোষজনক না হওয়ায় ২০০৯ সালে হাইকোর্ট একটি রিটের আলোকে সরকারকে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ প্রণয়নের জন্য 'ভূমিকম্প প্রস্তুতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি বিষয়ক কমিটি' গঠনের নির্দেশ দেন। এরপর খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ৩৯ সদস্যের এক বিশাল কমিটি গঠন করে। ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে এ কমিটি গঠন করা হলেও ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রথম বৈঠকে বসে। গত মাসে দেশে ভূমিকম্প হওয়ার পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কোনো সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণে দেশে ছোট-বড় ১০০টি ভূমিকম্প ধরা পড়ে। রাজধানীতে ভবন নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড মানা হয় কি না তা তদারকি করে রাজউক। কিন্তু উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়েও বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে বিল্ডিং কোড তদারকির কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। বিল্ডিং কোড তদারকির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি আরো বলেছেন, 'আদালতের রায়ের বাইরেও আমরা অনেক কাজ করেছি। হয়তো সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়নি, কিন্তু কাজ থেমে নেই।'
সড়ক দুর্ঘটনা : সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর উদ্দেশ্যে ১৯৯৫ সালে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা পরিষদ। গত ১৫ বছরে এ পরিষদ ২০টি বৈঠক করে ২৩টি সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি স্কুলের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, সিএনজি অটোরিকশার নতুন নিবন্ধন বন্ধ রাখা ও বিআরটিএর আইন-নীতিমালা সংশোধন করা_এই তিনটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ২০টি ঝুলে আছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে দেশে বছরে গড়ে ১২ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ৪০ হাজার ৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২ হাজার ২৬১ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় ২৯ হাজার ৬৭৯ ব্যক্তি। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
পাহাড় ধস : ২০০৭-০৮ সালে পৃথক কয়েকটি পাহাড় ধসের ঘটনায় চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার ও পার্বত্য জেলাগুলোয় দেড় শতাধিক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটি মন্তব্য করে। ওই সময় পাহাড় কাটা বন্ধ করতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি ঘটনার পর পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনও নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেখানে আবার বসবাস শুরু হয়, যার পরিণতি ২০০৯ সালে বান্দরবানে পাহাড়ধসের ঘটনায় ১০ জন নিহত। ২০১০ সালে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করার বিষয়টি পরিবেশ আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এখনো নির্বিঘ্নে চলছে পাহাড় কাটা।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি মনে করি সরকারগুলো শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনে যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করে, সেগুলোই অবাস্তবায়িত থাকে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে জনগণকে দেখানো হয়_সরকার বেশ কাজ করছে। আসলে প্রয়োজন সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তাহলেই সরকার পরিবর্তন হলেও চলমান কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি থেমে থাকবে না।'
No comments