নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনঃ দল না থাকুক, আমরা তো আছি by মাহমুদুর রহমান মান্না
দৈনিক প্রথম আলো থেকে উদ্ধৃত করছি: ২১ তারিখ বেলা সাড়ে ১১টা। নারায়ণগঞ্জ শহরের কলেজ রোডের গৃহবধূ তাহমিনা আক্তার রান্না ফেলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘আপা, ভয় পাবেন না। মনে সাহস রাখেন। দল না থাকুক, আমরা তো আছি।’ (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০১১)
এমন কথা গত শুক্রবার গণসংযোগকালে বেশ কয়েকবার শুনেছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। সকাল নয়টায় তিনি শুরু করেন প্রচারণা ও গণসংযোগ। চলে বেলা একটা পর্যন্ত। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরই তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয় শত শত মানুষ। সমর্থকেরা তাঁকে সাহস জোগান। বলেন, পরিস্থিতি যতই বৈরী হোক, তাঁরা আইভীকে ছেড়ে যাবেন না। শামীম ওসমানের ঘাঁটি বলে পরিচিত জামতলার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব লুৎফুন্নেসা আইভীর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন। কী দোয়া করেছেন—জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা কওয়ার আল্লাহরেই কইছি। আল্লাহই দেখব। কেউ ঠেকাইতে পারব না।’
আমার উদ্ধৃতির এখানেই শেষ। মাহমুদুর রহমান মান্না দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম আলোকে একটু বেশি পছন্দ করেন। প্রথম আলো আওয়ামী লীগকে আবার একটু বেশি অপছন্দ করে—এ রকম করে বলার অভ্যাস আছে একটি মহলের। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ তোলার কথা জামায়াতে ইসলামীর। কারণ, এই একটি প্রশ্নে প্রথম আলো কখনো ছাড় দিয়ে কথা বলেনি। এবং সে জন্য বিএনপিরও একটু অস্বস্তি থাকতে পারে প্রথম আলোর ব্যাপারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের একটি বিশেষ মহলের উষ্মা কেন? প্রথম আলো এক-এগারোর পক্ষে ছিল বলে? সে তো আওয়ামী লীগও ছিল। এখন ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে আমার পক্ষে বললেই ভালো আর সমালোচনা করলেই শত্রুপক্ষের গোপন এজেন্ট। এটা তো গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, ফ্যাসিবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
প্রথম আলো কেবল সেলিনা হায়াৎ আইভীর কথাই লেখেনি, তারা পাশাপাশি অপর দুই আলোচিত প্রার্থীর গণসংযোগ তৎপরতার কথাও কাগজে ছেপেছে। আমি কেবল সেলিনা হায়াৎ আইভীর কথা লিখলাম, তা আমার এই লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক বলে। সপ্তাহ খানেক আগে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) একটি টিম নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী হালচাল পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিল। সেই টিমের দুজন সদস্য ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘মান্না, কী বলব, ২০ জন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাদের মধ্যে ১৮ জন আইভীর সমর্থক। কী করলেন আপনারা?’
কী করলাম আমরা, সেটাই আমার আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু এই প্রতিপাদ্যটাও বোধহয় ঠিক হলো না। যা কিছুই করা হলো নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে, তার কোথাও তো আমি নেই। মে মাসের মাঝামাঝি তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। তখন সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লাকে সঙ্গে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আইভীর তাতে আপত্তি নেই। তাঁর আপত্তি নব্য প্রতিষ্ঠিত এই সিটি করপোরেশনে একজন আমলাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে। আইভী ব্যাপারটি দলের হাইকমান্ডকে জানাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হাইকমান্ডের সামনে যে চীনের প্রাচীর, সেটা তিনি ডিঙাতে পারেননি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা তাঁকে বলেছেন, আগে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে।
আমি বুঝতে পারি, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সরকারি দলের যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার শুরু সেই থেকে অথবা আরও আগে থেকে। এবং সেখানে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী যে নিজেই একজন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের আচরণ থেকে বোঝা গিয়েছিল।
ডা. আইভী সমস্যা হলেন কেন? কিন্তু সে কথা বলার আগে আলোচনা করা দরকার, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ব্যাপারটি কী হলো? শোনা যাচ্ছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভেঙে ফেলা হবে। কারণ, সিটি করপোরেশন একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও মন্ত্রী পদমর্যাদার ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে মন্ত্রীর চেয়ে বড় দেখাচ্ছিল। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা বিষয়টিতে স্বস্তি বোধ করছিলেন। বলা হচ্ছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশন অনেক বড় হয়ে গেছে, যা ম্যানেজ করা অসম্ভব। যদিও নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস বা বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরে এ প্রশ্ন আসছে না। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন এল কেন?
সম্প্রতি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা নিয়ে এ প্রশ্ন আরও ব্যাপকভাবে আলোচিত। বিরোধী দল বলছে, এ সিদ্ধান্ত মূলত রাজনৈতিক। বিশেষজ্ঞরা যেসব মত প্রকাশ করেছেন, তা প্রধানত ঢাকা সিটি দুই ভাগ করাকে প্রশাসনিকসহ অন্যান্য বিবেচনায় ভুল বলা হচ্ছে। ঢাকা সিটি কি এত বড় হয়ে গেছে, যা ম্যানেজ করার বাইরে? তাহলে সেই যে ঢাকা শহরে তিনটি পৌরসভা ছিল, সেগুলো একত্র করে বৃহত্তর ঢাকা সিটি করা হলো কেন? একইভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে, ছোট্ট নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ ইত্যাদিকে যুক্ত করে নারায়ণগঞ্জকে সিটি করপোরেশন করা হলো কেন? আলাদা করে বন্দর, ফতুল্লার উন্নয়ন করা কি ঢাকা মহানগরকে যে বিবেচনায় দ্বিখণ্ডিত করা হলো, সেই বিবেচনায় সহজ ছিল না?
নিন্দুকদের মতে, ডা. আইভীকে সাইজ করার দরকার ছিল আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। সে জন্যই এই মহা আয়োজন। না হলে আইভীকে তো বাদ দেওয়া যাবে না। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন এক টক শোতে বলেছিলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করা সম্ভব, যদি বেশির ভাগ এমপি একমত থাকেন। কিন্তু নির্বাচিত মেয়রকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া দুষ্কর। নয় বছরের বেশি সময় ধরে সাদেক হোসেন খোকা ঢাকা মহানগরের মেয়র হয়ে আছেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই তিতা বড়ি গিলেছে না তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকার? এখন অবশ্য সরকার একটা বুদ্ধি বের করেছে। এবার চাকরি যাবে খোকার।
কিন্তু ডা. আইভীর কী হয়েছে? তিনি তো ক্ষমতাসীন দলেরই লোক। আট বছর ধরে তিনিও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। আট বছর বড় দীর্ঘ সময়। এত দিন ধরে ক্ষমতায় থাকলে মানুষ জনপ্রিয়তা হারায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ল্যাম্পপোস্টকে জিজ্ঞেস করুন কিংবা পথে চলতে থাকা একটা বাস থামিয়ে প্রশ্ন করুন, আইভী কেমন লোক? জবাব মিলবে, আইভী ভালো লোক। বর্তমানে যাঁরা শামীম ওসমানের ক্যাম্পেইনার হয়েছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে যেকোনো ১০০টা মানুষকে কাতারবন্দী করে দাঁড় করিয়ে একই প্রশ্ন করুন, সবাই বলবে—বড় ভালো লোক। সেই মানুষটাকে সমর্থন দেওয়া হলো না কেন? শামীম ওসমানের জন্যই তো? শামীম ওসমান দলের জন্য এতই অপরিহার্য? কেন?
আওয়ামী লীগের সেসব নেতা-কর্মী, যাঁরা ধমক খেয়ে, আদিষ্ট হয়ে কিংবা হতে পারে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে শামীম ওসমানের পেছনে আছেন, তাঁদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আমার বক্তব্য নেই। আমি শামীম ওসমানকে তিন দশক ধরে চিনি। আমি মনে করি, দলের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু এ কথা প্রায় সবাই বলছে, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে, মামলা আছে। কেন? রাজনীতিতে একটা কথা আছে—তুমি কেমন মানুষ, সেটাই বড় কথা নয়; বড় কথা, মানুষ তোমাকে কেমন জানে। এটাই হলো ভাবমূর্তি। শামীম ওসমান সত্যি সত্যি সন্ত্রাসী কি না, সে কথায় আমি যাব না। কিন্তু এ কথা বলব যে রাজনীতির মাঠে শামীম ওসমানের ইমেজ খারাপ ছিল; এবং সে কারণে এ নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন দেওয়া কোনোভাবেই দলের উচিত হয়নি।
শামীম যত কথাই বলুন না কেন, এক দশক আগে খালেদা জিয়ার চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে যে বাধা তিনি তৈরি করেছিলেন, তা তাঁকে সারা দেশেই একজন সন্ত্রাসীর পরিচিতি এনে দিয়েছে। কেন করেছিলেন তিনি এমন একটি কাজ? একা একা? নিজস্ব সিদ্ধান্তে? হতে পারে তা? নিশ্চয়ই না। আমি আগে বলেছি দলের নেতৃত্বের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও নিবেদনের কথা। আজ দলের স্বীকার করা উচিত, শামীম ওসমানের মতো এ রকম এক সাহসী নেতার এই অসুর ভাবমূর্তির অন্তত অর্ধেকের জন্য দল দায়ী। দল যদি সে ভুল বুঝতে পারে, তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, তাহলে শামীম ওসমানকে এই অপবাদ থেকে তুলে আনার চেষ্টা করুন। তাঁকে অন্যভাবে পুরস্কৃত করুন। এই নির্বাচনে বিভিন্ন ছলাকলা করে, সমর্থন করে তাঁকে পুরস্কৃত করা যাবে না।
নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা আমি বলতে পারব না। খুব ইচ্ছা করছিল নারায়ণগঞ্জ যেতে, সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে আসতে। কিন্তু যাইনি পাছে না আমার যাওয়া নিয়ে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়। অসংখ্য ফোন পাচ্ছি নারায়ণগঞ্জ থেকে। এর মধ্যে দলের অনেক কর্মীও আছেন। আমি প্রাথমিকভাবে বলতে পারি, এই নির্বাচনে নৈতিকভাবে সেলিনা হায়াৎ আইভী জিতেছেন। অর্থাৎ নৈতিকভাবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। মানুষ দল এবং দলীয় নেতার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে তাঁদের মত ব্যক্ত করেছেন, এখন যা ইচ্ছা তা-ই করা যাবে না। এ কথা তো এখন সূর্যের আলোর মতো পরিষ্কার, আওয়ামী লীগ এবং দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলগত কিংবা ব্যক্তিগতভাবে আইভীকে সমর্থন দেননি। তার পরও টিভিতে দেখছি আইভীর পেছনে জনতার স্রোত।
এটা সৎ রাজনীতি ও নেতৃত্বের প্রতি জনতার আস্থা ও ভালোবাসার প্রকাশ। দল যদি আইভীকে সমর্থন দিত, তাহলে তিনি অনায়াসে জিতে আসতেন—এ কথা বলা যায়।
২২ অক্টোবর শনিবার প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ ভালো ও মন্দের পার্থক্য করতে জানে।’ তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা ভুল। নেতা-কর্মীরা এ জন্য ব্যথিত। কারণ, যাঁকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, তিনি এমন ব্যক্তি যে যখন দল বিপদে, তখন দেশ ছেড়ে পালান। এ ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের কোনো মতই নেওয়া হয়নি।’ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এস এম আকরামও এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই বিশেষ সিদ্ধান্তটি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি যে ভুল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আশা করি, ৩০ তারিখে সেই ভুল সত্যায়িত হবে, যদি নির্বাচন কোনো অঘটনের শিকার না হয়।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
আমার উদ্ধৃতির এখানেই শেষ। মাহমুদুর রহমান মান্না দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম আলোকে একটু বেশি পছন্দ করেন। প্রথম আলো আওয়ামী লীগকে আবার একটু বেশি অপছন্দ করে—এ রকম করে বলার অভ্যাস আছে একটি মহলের। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ তোলার কথা জামায়াতে ইসলামীর। কারণ, এই একটি প্রশ্নে প্রথম আলো কখনো ছাড় দিয়ে কথা বলেনি। এবং সে জন্য বিএনপিরও একটু অস্বস্তি থাকতে পারে প্রথম আলোর ব্যাপারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের একটি বিশেষ মহলের উষ্মা কেন? প্রথম আলো এক-এগারোর পক্ষে ছিল বলে? সে তো আওয়ামী লীগও ছিল। এখন ব্যাপারটা যদি এমন হয় যে আমার পক্ষে বললেই ভালো আর সমালোচনা করলেই শত্রুপক্ষের গোপন এজেন্ট। এটা তো গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, ফ্যাসিবাদী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
প্রথম আলো কেবল সেলিনা হায়াৎ আইভীর কথাই লেখেনি, তারা পাশাপাশি অপর দুই আলোচিত প্রার্থীর গণসংযোগ তৎপরতার কথাও কাগজে ছেপেছে। আমি কেবল সেলিনা হায়াৎ আইভীর কথা লিখলাম, তা আমার এই লেখার জন্য প্রাসঙ্গিক বলে। সপ্তাহ খানেক আগে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) একটি টিম নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী হালচাল পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিল। সেই টিমের দুজন সদস্য ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘মান্না, কী বলব, ২০ জন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাদের মধ্যে ১৮ জন আইভীর সমর্থক। কী করলেন আপনারা?’
কী করলাম আমরা, সেটাই আমার আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু এই প্রতিপাদ্যটাও বোধহয় ঠিক হলো না। যা কিছুই করা হলো নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে, তার কোথাও তো আমি নেই। মে মাসের মাঝামাঝি তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। তখন সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লাকে সঙ্গে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আইভীর তাতে আপত্তি নেই। তাঁর আপত্তি নব্য প্রতিষ্ঠিত এই সিটি করপোরেশনে একজন আমলাকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের ব্যাপারে। আইভী ব্যাপারটি দলের হাইকমান্ডকে জানাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হাইকমান্ডের সামনে যে চীনের প্রাচীর, সেটা তিনি ডিঙাতে পারেননি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা তাঁকে বলেছেন, আগে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে।
আমি বুঝতে পারি, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সরকারি দলের যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার শুরু সেই থেকে অথবা আরও আগে থেকে। এবং সেখানে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী যে নিজেই একজন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের আচরণ থেকে বোঝা গিয়েছিল।
ডা. আইভী সমস্যা হলেন কেন? কিন্তু সে কথা বলার আগে আলোচনা করা দরকার, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ব্যাপারটি কী হলো? শোনা যাচ্ছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভেঙে ফেলা হবে। কারণ, সিটি করপোরেশন একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও মন্ত্রী পদমর্যাদার ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে মন্ত্রীর চেয়ে বড় দেখাচ্ছিল। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা বিষয়টিতে স্বস্তি বোধ করছিলেন। বলা হচ্ছিল, ঢাকা সিটি করপোরেশন অনেক বড় হয়ে গেছে, যা ম্যানেজ করা অসম্ভব। যদিও নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস বা বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরে এ প্রশ্ন আসছে না। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন এল কেন?
সম্প্রতি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা নিয়ে এ প্রশ্ন আরও ব্যাপকভাবে আলোচিত। বিরোধী দল বলছে, এ সিদ্ধান্ত মূলত রাজনৈতিক। বিশেষজ্ঞরা যেসব মত প্রকাশ করেছেন, তা প্রধানত ঢাকা সিটি দুই ভাগ করাকে প্রশাসনিকসহ অন্যান্য বিবেচনায় ভুল বলা হচ্ছে। ঢাকা সিটি কি এত বড় হয়ে গেছে, যা ম্যানেজ করার বাইরে? তাহলে সেই যে ঢাকা শহরে তিনটি পৌরসভা ছিল, সেগুলো একত্র করে বৃহত্তর ঢাকা সিটি করা হলো কেন? একইভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে, ছোট্ট নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ ইত্যাদিকে যুক্ত করে নারায়ণগঞ্জকে সিটি করপোরেশন করা হলো কেন? আলাদা করে বন্দর, ফতুল্লার উন্নয়ন করা কি ঢাকা মহানগরকে যে বিবেচনায় দ্বিখণ্ডিত করা হলো, সেই বিবেচনায় সহজ ছিল না?
নিন্দুকদের মতে, ডা. আইভীকে সাইজ করার দরকার ছিল আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। সে জন্যই এই মহা আয়োজন। না হলে আইভীকে তো বাদ দেওয়া যাবে না। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন এক টক শোতে বলেছিলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করা সম্ভব, যদি বেশির ভাগ এমপি একমত থাকেন। কিন্তু নির্বাচিত মেয়রকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া দুষ্কর। নয় বছরের বেশি সময় ধরে সাদেক হোসেন খোকা ঢাকা মহানগরের মেয়র হয়ে আছেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই তিতা বড়ি গিলেছে না তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকার? এখন অবশ্য সরকার একটা বুদ্ধি বের করেছে। এবার চাকরি যাবে খোকার।
কিন্তু ডা. আইভীর কী হয়েছে? তিনি তো ক্ষমতাসীন দলেরই লোক। আট বছর ধরে তিনিও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। আট বছর বড় দীর্ঘ সময়। এত দিন ধরে ক্ষমতায় থাকলে মানুষ জনপ্রিয়তা হারায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ল্যাম্পপোস্টকে জিজ্ঞেস করুন কিংবা পথে চলতে থাকা একটা বাস থামিয়ে প্রশ্ন করুন, আইভী কেমন লোক? জবাব মিলবে, আইভী ভালো লোক। বর্তমানে যাঁরা শামীম ওসমানের ক্যাম্পেইনার হয়েছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে যেকোনো ১০০টা মানুষকে কাতারবন্দী করে দাঁড় করিয়ে একই প্রশ্ন করুন, সবাই বলবে—বড় ভালো লোক। সেই মানুষটাকে সমর্থন দেওয়া হলো না কেন? শামীম ওসমানের জন্যই তো? শামীম ওসমান দলের জন্য এতই অপরিহার্য? কেন?
আওয়ামী লীগের সেসব নেতা-কর্মী, যাঁরা ধমক খেয়ে, আদিষ্ট হয়ে কিংবা হতে পারে ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে শামীম ওসমানের পেছনে আছেন, তাঁদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে আমার বক্তব্য নেই। আমি শামীম ওসমানকে তিন দশক ধরে চিনি। আমি মনে করি, দলের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু এ কথা প্রায় সবাই বলছে, শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে, মামলা আছে। কেন? রাজনীতিতে একটা কথা আছে—তুমি কেমন মানুষ, সেটাই বড় কথা নয়; বড় কথা, মানুষ তোমাকে কেমন জানে। এটাই হলো ভাবমূর্তি। শামীম ওসমান সত্যি সত্যি সন্ত্রাসী কি না, সে কথায় আমি যাব না। কিন্তু এ কথা বলব যে রাজনীতির মাঠে শামীম ওসমানের ইমেজ খারাপ ছিল; এবং সে কারণে এ নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন দেওয়া কোনোভাবেই দলের উচিত হয়নি।
শামীম যত কথাই বলুন না কেন, এক দশক আগে খালেদা জিয়ার চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে যে বাধা তিনি তৈরি করেছিলেন, তা তাঁকে সারা দেশেই একজন সন্ত্রাসীর পরিচিতি এনে দিয়েছে। কেন করেছিলেন তিনি এমন একটি কাজ? একা একা? নিজস্ব সিদ্ধান্তে? হতে পারে তা? নিশ্চয়ই না। আমি আগে বলেছি দলের নেতৃত্বের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ও নিবেদনের কথা। আজ দলের স্বীকার করা উচিত, শামীম ওসমানের মতো এ রকম এক সাহসী নেতার এই অসুর ভাবমূর্তির অন্তত অর্ধেকের জন্য দল দায়ী। দল যদি সে ভুল বুঝতে পারে, তার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, তাহলে শামীম ওসমানকে এই অপবাদ থেকে তুলে আনার চেষ্টা করুন। তাঁকে অন্যভাবে পুরস্কৃত করুন। এই নির্বাচনে বিভিন্ন ছলাকলা করে, সমর্থন করে তাঁকে পুরস্কৃত করা যাবে না।
নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা আমি বলতে পারব না। খুব ইচ্ছা করছিল নারায়ণগঞ্জ যেতে, সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে আসতে। কিন্তু যাইনি পাছে না আমার যাওয়া নিয়ে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়। অসংখ্য ফোন পাচ্ছি নারায়ণগঞ্জ থেকে। এর মধ্যে দলের অনেক কর্মীও আছেন। আমি প্রাথমিকভাবে বলতে পারি, এই নির্বাচনে নৈতিকভাবে সেলিনা হায়াৎ আইভী জিতেছেন। অর্থাৎ নৈতিকভাবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। মানুষ দল এবং দলীয় নেতার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে তাঁদের মত ব্যক্ত করেছেন, এখন যা ইচ্ছা তা-ই করা যাবে না। এ কথা তো এখন সূর্যের আলোর মতো পরিষ্কার, আওয়ামী লীগ এবং দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলগত কিংবা ব্যক্তিগতভাবে আইভীকে সমর্থন দেননি। তার পরও টিভিতে দেখছি আইভীর পেছনে জনতার স্রোত।
এটা সৎ রাজনীতি ও নেতৃত্বের প্রতি জনতার আস্থা ও ভালোবাসার প্রকাশ। দল যদি আইভীকে সমর্থন দিত, তাহলে তিনি অনায়াসে জিতে আসতেন—এ কথা বলা যায়।
২২ অক্টোবর শনিবার প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের মানুষ ভালো ও মন্দের পার্থক্য করতে জানে।’ তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা ভুল। নেতা-কর্মীরা এ জন্য ব্যথিত। কারণ, যাঁকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, তিনি এমন ব্যক্তি যে যখন দল বিপদে, তখন দেশ ছেড়ে পালান। এ ব্যাপারে নেতা-কর্মীদের কোনো মতই নেওয়া হয়নি।’ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এস এম আকরামও এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এই বিশেষ সিদ্ধান্তটি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি যে ভুল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আশা করি, ৩০ তারিখে সেই ভুল সত্যায়িত হবে, যদি নির্বাচন কোনো অঘটনের শিকার না হয়।
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
No comments