মরুভূমির অজ্ঞাত স্থানে গাদ্দাফিকে লুকিয়ে দাফন

মুয়াম্মার গাদ্দাফির মরদেহ নিয়ে নাটকের অবসান হলো অবশেষে। স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তরের ঘোষণা দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ভোর ৫টায় (বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টা) লিবিয়ার কোনো এক মরুভূমিতে গোপনে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। দেশটির ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি) গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছে।গাদ্দাফির ছেলে মুতাসিম এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু বকর ইউনিস জবরকেও মরুর গোপন স্থানে সমাহিত করা হয়েছে।


নতুন ক্ষমতাসীন নেতা-কর্মীদের বরাতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জানায়, গাদ্দাফিকে ঘিরে সমাধি গড়ে উঠুক এনটিসি তা চায়নি। এ কারণে দাফনের আগে তাঁর গোত্রের লোকজনদের শুধু প্রার্থনা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর এনটিসির কমান্ডাররা অজ্ঞাত এক মরুভূমিতে তাঁর মরদেহ নিয়ে সমাহিত করে।
এনটিসির এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আল-জাজিরা টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, চার দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিকে মঙ্গলবার ভোরে ধর্মীয় বিধান মেনে মরুভূমির অজ্ঞাত স্থানে কবরে দাফন করা হয়েছে।
জন্মশহর সার্তে বিদ্রোহী বাহিনীর আক্রমণে গত বৃহস্পতিবার নিহত হন গাদ্দাফি। পরে তাঁর মরদেহ মিসরাতার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি মার্কেটের মাংস রাখার ঘরে রাখা হয়। সেখানে আগ্রহী মানুষকে লাশ দেখার সুযোগও দেওয়া হয়। এদিকে গাদ্দাফির পরিবার তাঁর লাশ নিয়ে নিজেদের হেফাজতে দাফন করতে চাইলেও এনটিসি তাতে সাড়া দেয়নি। সোমবার এনটিসি নিজেরাই গাদ্দাফিকে দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে লাশ দেখানো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মিসরাতার এনটিসি সেনা সূত্র জানায়, গাদ্দাফিকে দাফনের উদ্দেশে সোমবার রাতেই মাংস রাখার হিমঘর থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাসূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, গাদ্দাফির জানাজায় তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কয়েকজন এবং এনটিসির ঊর্ধ্বতন কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। ইসলাম ধর্মের রীতি মেনেই তাঁর লাশ কবরে সমাহিত করা হয়েছে।
এর আগে সোমবার এনটিসির এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন, গাদ্দাফির লাশে পচন ধরে গেছে। তাঁকে মরুভূমির কোনো এক স্থানে সাদামাটাভাবেই দাফন করা হবে। তাঁর দাফনের সময় মাত্র চারজন প্রত্যক্ষদর্শী থাকবে। দাফনের স্থানের নাম প্রকাশ না করার ব্যাপারে তাঁদের কোরআন ছুঁয়ে শপথ করানো হবে।
গাদ্দাফির মরদেহ নিয়ে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ভীতি ছিল বলেই গোপনে দাফন করা হয়েছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, প্রকাশ্যে গাদ্দাফিকে কবর দিলে তা ঘিরে তাঁর অনুসারীরা মাজার গড়ে তুলতে পারে। এনটিসি চায়নি তাঁর কবর গিয়ে মাজার গড়ে উঠুক। এ জন্য গাদ্দাফির লাশ গোপনে অজ্ঞাত স্থানে কবর দেওয়া হলো।
৬৯ বছর বয়সী গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের অবসানের দাবিতে চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশটিতে আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু তিনি গণদাবির মুখে ক্ষমতা ছেড়ে না দিয়ে সেনাবাহিনী দিয়ে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা চালিয়ে যান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান উপেক্ষা করে তিনি তাঁর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখেন। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়ে ন্যাটো দেশটির সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীর সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালানো শুরু করে। দীর্ঘ আট মাস লড়াইয়ে একে একে সব অঞ্চল থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনুগত বাহিনী নিয়ে গাদ্দাফি তাঁর জন্মশহর ও শক্ত ঘাঁটি সার্তে আশ্রয় নেন। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার সেখানে তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং নিহত হন। এ সময় তাঁর ছেলে মুতাসিমও নিহত হন।
গাদ্দাফির মৃত্যুর পর এনটিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, পালানোর সময় ক্রসফায়ারে পড়ে গাদ্দাফির মৃত্যু হয়েছে। রবিবার চিকিৎসকরা জানান, ময়নাতদন্তে তাঁর মাথায় গুলির আঘাত পাওয়া গেছে।
ছেলে সাইফ নাইজার সীমান্তে : গাদ্দাফির সবচেয়ে আলোচিত ছেলে সাইফ আল ইসলাম সেনাদের হাতে বন্দি রয়েছেন বলে এনটিসির পক্ষ থেকে কিছুদিন ধরে দাবি করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, সাইফ নাইজার ও আলজেরিয়ার সীমান্তে অবস্থান করছেন। সাইফের ভাই আল সাদী ও গাদ্দাফি পরিষদের কয়েকজন ইতিমধ্যেই নাইজারের রাজধানীতে গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।
নাইজারের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ও আঞ্চলিক পরিষদের আগাদেজের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রাইসা অ্যাগ বুলা বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, 'সীমান্তে তোরেজ সম্প্রদায়ের লোকজনের সহায়তায় সাইফ নাইজারে ঢুকতে চাইছেন বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। তোরেজ সম্প্রদায়ের লোকজন গাদ্দাফির কঠিন ভক্ত।'
রাইসা অ্যাগ বুলা বলেন, 'যদি সাইফ নাইজারে ঢোকেন, তাহলে আমাদের সরকার তাঁকে গ্রহণ করবে। তবে আমরা আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিও মেনে চলব।' এদিকে নাইজার সরকার বলছে, আল সাদী ও গাদ্দাফি পরিষদের লোকজনকে লিবিয়ায় ততক্ষণ পর্যন্ত ফেরত পাঠানো হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স, আল-জাজিরা।

No comments

Powered by Blogger.