চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন-বিএসসি গ্রুপ মুখোমুখি by কাজী আবুল মনসুর,

ট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে অনিয়মই এখন নিয়ম। নগর কমিটি কাগজে-কলমে সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর দখলে। তিনিই কমিটির সভাপতি। তবে দলের একটি বড় অংশই তাকে সভাপতি হিসেবে স্বীকার করে না। ফলে ৭১ সদস্যের কমিটি এখন ১৮ জনে স্থবির। মন্ত্রী আফছারুল আমীন এবং সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর চরম কোন্দলে নগর আওয়ামী লীগ এখন দিশেহারা। নেতাকর্মীরা কেউ মহিউদ্দিন গ্রুপ, কেউ আফছার বা বিএসসি গ্রুপ পরিচয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন।


যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগেও একই অবস্থা।দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দলের কোন্দল নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রবীণ নেতা আখতারুজ্জামান বাবু, মোশাররফ হোসেন এবং ইসহাক মিয়াকে দায়িত্ব দেন। গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম সফরকালে এ তিনজনকে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা দায়িত্ব দিয়ে যান দীর্ঘদিনের কোন্দল মেটাতে। আট মাসেও তারা একত্রে বসতে পারেননি। কোনো আলোচনা হয়নি। তিনজনই বুঝে গেছেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের কোন্দল মেটাতে হলে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হবে। আখতারুজ্জামান বাবু ও মোশাররফ হোসেন একাধিকবার নিজেদের মধ্যে কথা বললেও কোন পথে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে জোড়া লাগবে তার সূত্র খুঁজে পাননি। কারণ এখানে কেউ কাউকে মানেন না। সবাই যার যার ক্ষেত্রে বড়। সবাই নিজেকে অধিকতর যোগ্য নেতা মনে করেন। এ অবস্থায় কোন্দল নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোন্দলে জড়িত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের বারবার হুশিয়ার করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলাদলি থেকে সরে না এলে তিনি প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবেন বলে সাফ জানিয়ে দেন বিভক্ত নেতাদের। প্রধানমন্ত্রী নগর আওয়ামী লীগের বিভক্ত দু'গ্রুপের সিনিয়র নেতাদের উদ্দেশ করে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিগত মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিপুল ভরাডুবির বিষয়টি ইঙ্গিত করে বলেছেন, 'আপনারা মিলেমিশে না থাকার কারণে কী ক্ষতি হয়েছে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এখন সব ভুলে গিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।'
তিন নেতার বৈঠকের ব্যাপারে মোশাররফ হোসেন বলেন, 'আমি ও বাবুভাই একাধিকবার আলাপ-আলোচনা করেছি। তবে দুই গ্রুপ নিয়ে বসা হয়নি। নেত্রীর সঙ্গে বসলে সব বিষয় খোলাসা করে বলব।'
তিন নেতার বৈঠক অকার্যকর হয়েছে উল্লেখ করে মহিউদ্দিন গ্রুপের নেতা ইনামুল হক দানু সমকালকে জানান, নেত্রীর নির্দেশনা আছে মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতি। তিনিই নগর কমিটির সভাপতি। তাকে যারা মানেন না, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী।
সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, তারা আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বললে তো করার কিছু নেই। নগর কমিটি নিয়ে আমরা বেশ যন্ত্রণায় আছি।
আওয়ামী লীগের কমিটি কোথায়?
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগে গ্রুপের নাম মহিউদ্দিন চৌধুরী বনাম নুরুল ইসলাম বিএসসি। কাগজে-কলমে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০০৬ সালের ২৭ জুন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়। সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ কমিটির সদস্যসংখ্যা ৭১ হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ বছর আগে মাত্র ২১ জনের যে কমিটি করা হয়, সে কমিটির তিন সদস্যই এরই মধ্যে মারা গেছেন। বর্তমানে কমিটির সদস্যসংখ্যা ১৮। এর মধ্যে গ্রুপিংয়ের জের ধরে দু'পক্ষ পাল্টাপাল্টি কমিটির নয় নেতাকে বহিষ্কার করায় এখন কমিটির সদস্যসংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে নয়জনে! ইতিমধ্যে পাল্টাপাল্টি বর্ধিত সভা করে এক পক্ষ আরেক পক্ষের নেতাদের বিদ্যমান পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য লিখিত আকারে সুপারিশও করেছে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। ফলে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের বৈধ কমিটির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
মহিউদ্দিন ও নুরুল ইসলাম বিএসসি
একসময় সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন বর্তমান সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসি। ক্রমে তাদের দূরত্ব বাড়ে। বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছেছে যে, কেউ কারও নাম পর্যন্ত শুনতে পারেন না। দু'জন দু'দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগকে। ফলে বর্তমানে নগর আওয়ামী লীগে দুই গ্রুপ_ মহিউদ্দিন গ্রুপ ও বিএসসি গ্রুপ। এরই ধারাবাহিকতায় চলছে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগও। গ্রুপিংয়ের জের ধরে ব্যাপক মেরুকরণ ঘটে নগর আওয়ামী লীগে। দু'জনই নিজেদের মধ্যে শক্তি বৃদ্ধির তৎপরতায় নামেন। সর্বশেষ মেরুকরণের পর মহিউদ্দিনের সঙ্গে রয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইনামুল হক দানু, সাংসদ এমএ লতিফ, খোরশেদ আলম সুজন ও আ জ ম নাছির উদ্দিন। অন্যদিকে নুরুল ইসলাম বিএসসির সঙ্গে রয়েছেন মন্ত্রী আফছারুল আমীন, সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম, ইব্রাহিম হোসেন বাবুলসহ আরও কয়েক প্রভাবশালী নেতা। এ দুই গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে দলের সব কর্মসূচি পালন করে আসছে পাল্টাপাল্টিভাবে। দলীয় কোন্দল এতই চরম আকার ধারণ করেছে যে, এক গ্রুপ অপর গ্রুপের সিনিয়র নেতাদের পাল্টাপাল্টিভাবে বহিষ্কারও করেছে।
যে কারণে দূরত্ব
দীর্ঘ তিন দশক ধরে মান্নান-মহিউদ্দিন জুটি দিয়েই চলছিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ। ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এমএ মান্নান। ওই কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০০৬ সালের জুনে এ জুটির অবসান ঘটে। এরই মধ্যে প্রবীণ নেতা এমএ মান্নান মারা যান। পরে নবগঠিত কমিটিতে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হন তারই কাছের মানুষ কাজী ইনামুল হক দানু। এ দু'জনকে কেন্দ্র থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে তাদের পছন্দের মানুষদের দিয়ে কমিটি গঠন করার পাঁয়তারা চললে অন্যরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে নগর আওয়ামী লীগে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম বিএসসির মধ্যে দূরুত্ব সৃষ্টি হয় আরও আগে। মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন প্রথম মেয়র হন তখন বিএসসি তার নির্বাচিত হওয়ার পেছনে সাহায্যের হাত বাড়ান। কিন্তু মেয়র হওয়ার পর নুরুল ইসলাম বিএসসির কাছ থেকে দূরে সরতে থাকেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। নগর কমিটিতেও বঞ্চিত হতে থাকেন বিএসসি। ফলে তাদের মধ্যে দূরত্ব চরম আকার ধারণ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত গত কমিটিতে মহিউদ্দিন চৌধুরী সভাপতি হওয়ার পর থেকে তোপের মুখে পড়েন তিনি। বিগত মেয়র নির্বাচনে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিজয় ঠেকাতে বিরোধী গ্রুপ ব্যাপকভাবে সক্রিয় থাকে। ফলে মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজিত হলে গ্রুপিং আরও চরম আকার ধারণ করে। সর্বশেষ নুরুল ইসলাম বিএসসি গত নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের শক্তি নিয়ে মাঠে নামেন। একই সঙ্গে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত মন্ত্রী আফছারুল আমীন, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল ও সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুস ছালামকে নিজের পক্ষে আনতে সমর্থ হন। ফলে তারা সবাই মিলে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামেন। তবে দীর্ঘদিনের রাজনীতিবিদ ও তৃণমূলের সঙ্গে এবিএম মহিউদ্দিনের সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে কোণঠাসা করতে তারা কার্যত কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে নগর আওয়ামী লীগে বিরোধ মিটছে না।
প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের তিন শীর্ষ নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার পরও তারা মহিউদ্দিন এবং বিএসসির নেতাকর্মী-সমর্থকদের এক মঞ্চে আনতে ব্যর্থ হন। কারণ মোশাররফ, বাবুকে তারা নগরের বাইরের নেতা মনে করেন। অপরদিকে বয়সের ভারে ন্যুব্জ ইসহাক মিয়া দলে এখন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। 

No comments

Powered by Blogger.