মন্তব্য প্রতিবেদন : শূন্যকুম্ভের প্রবৃদ্ধির বড়াই by মাহমুদুর রহমান
ক’দিন আগে টেলিভিশনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের এক সংবাদ সম্মেলন দেখছিলাম। উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে অর্থমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ হাসি ধরে রাখতে পারলেও লক্ষ্য করলাম, সেই হাসির জেল্লা বেশ খানিকটা কমে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি করছে এসব গল্পের মাঝে তিনি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করলেন, বর্তমান অর্থবছরে জাতীয় আয়ে প্রবৃদ্ধি নাকি ৮ শতাংশে উন্নীত হবে!প্রবৃদ্ধিবিষয়ক বাক্যটি তিনি শুরু করেছিলেন ৬ শতাংশ দিয়ে আর শেষ করলেন একেবারে ৮ শতাংশে। অবাক হয়ে ভাবলাম, একটি দেশের অর্থমন্ত্রীর পরিসংখ্যানের সততার ওপর কতখানি অবজ্ঞা থাকলে এই ধরনের বক্তব্য
দেয়া সম্ভব! মনে পড়ল সাইফুর রহমান দেশের অর্থনীতিবিষয়ক মন্তব্যে কী পরিমাণ সতর্কতা অবলম্বন করতেন।
এই সরকারের এবারের মেয়াদে সরকারি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। এ বছরও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি—সবাই বলছে প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৬.৫-এর মধ্যেই থাকবে। অথচ অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আগাম ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন। অর্থনীতির সব সূচকেই তিনি নাকি কেবলই অগ্রগতি খুঁজে পাচ্ছেন। আবুল মুহিতের আকাশচুম্বী আশাবাদের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক বাস্তব চিত্রটি এবার দেখার চেষ্টা করব।
১. মূল্যস্ফীতি দিয়েই শুরু করা যাক। এ বছর মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘর অতিক্রম করার পর থেকে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ যথাক্রমে ১০.৯৬, ১১.২৯ এবং ১১.৯৭। খাদ্যে মূল্যস্ফীতির অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেপ্টেম্বর মাসে এই হার ১৩.৭৫। আমাদের অর্থমন্ত্রী সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে মূল্যস্ফীতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়েছেন। অথচ এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্রই একই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছে। গোটা এশিয়ায় একমাত্র ভিয়েতনাম, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান এবং নানাবিধ সঙ্কটে পর্যুদস্ত পাকিস্তান ছাড়া প্রতিটি রাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অনেক নিচে। মূল্যস্ফীতির উচ্চহারে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের স্থান তৃতীয় এবং গোটা এশিয়ায় চতুর্থ। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মূল কারণই হচ্ছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও চরম দুর্নীতি। এ প্রসঙ্গে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছরের মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান পাঠককে জানানো প্রয়োজন। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। এমনকি মইন-ফখরুদ্দীন জমানাতেও মূল্যস্ফীতি দুই অংক অতিক্রম করেনি। তাদের যৌথ শাসনের দুই বছরের মধ্যে ২০০৭-০৮ সালে মূল্যস্ফীতি দশের কাছাকাছি ৯.৯৩-এ উন্নীত হয়েছিল। মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা মানুষ তখন জরুরি সরকারের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর সুদিনের স্বপ্ন দেখেছিল। ডিজিটাল নির্বাচনের পরবর্তী তিন বছরে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর অতিকায় বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে শাসকশ্রেণীর সীমাহীন সম্পদের লোভের কড়ি জোগানোর উদ্দেশ্যে। জনগণের ওপর করের বোঝা ক্রমাগত বাড়িয়েও এসব অতিকায় বাজেটের ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না। কাজেই সরকারকে দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
এদিকে দুর্নীতির অভিযোগ সর্বব্যাপী হওয়ায় বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা ক্রমেই হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। ফলে দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের সব উদ্বৃত্ত অর্থ চলে যাচ্ছে সরকারের জঠরে। জনশ্রুতি রয়েছে, দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংক মিলেও এই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মেটাতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক অতিরিক্ত টাকা ছাপাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বের যে কোনো দেশে এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির নিয়মেই মূল্যস্ফীতি জনগণের নাগালের বাইরে চলে যেতে বাধ্য। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সুতরাং অর্থমন্ত্রী যতই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির দোহাই দেয়ার চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে অর্থনীতি পরিচালনায় দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতার ফলেই অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া আজ এমনভাবে ছুটছে।
২. আমাদের বার্ষিক বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন মেটাতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থ, রফতানি আয় এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণ—এই তিন খাতই মূলত ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে যত্সামান্য বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) যুক্ত হলেও তাতে BOP-তে (Balance of Payment) তেমন একটা হেরফের হয় না। তিন খাতের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থে ভয়াবহ ধস নেমেছে। ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৮-০৯ পর্যন্ত চার অর্থবছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে প্রায় ২৬ শতাংশ। বর্তমান সরকারের প্রথম দুই অর্থবছরে সেই প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৬ এবং ৬ শতাংশে।
মহাজোট সরকারের ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতির ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আমাদের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তারই নেতিবাচক প্রতিফলন আমরা এক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্র সৌদি আরবে কর্মরত তাদের নাগরিকদের ওয়ার্ক পারমিট বা আকামা সমস্যা সমাধানে সফল হলেও বাংলাদেশ সরকার এ কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একাধিকবার আকামা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ অদ্যাবধি দেখা যাচ্ছে না। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে শেখ হাসিনা সরকারের ইসলামবিরোধী নীতি অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রাতৃপ্রতিম ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর শ্রমবাজারে বাংলাদেশী নাগরিকদের কাজ করার সুযোগ ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে বাধ্য। সুতরাং বর্তমান সরকারের বাকি মেয়াদের মধ্যেই প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি (negative growth) ঘটার আশঙ্কা প্রবলতর হচ্ছে।
৩. রফতানি বাণিজ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে আমরা নিঃসন্দেহে ভালো করেছি। এ বছর রফতানিতে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ৪১ শতাংশ। কিন্তু উল্লেখ করা দরকার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে আমরা মাত্র ৪.৩ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সুতরাং দুই অর্থবছরের গড় রফতানি আয় হিসাব করলে আমাদের অতিরিক্ত আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। অন্যদিকে রফতানির বিপরীতে আমদানির বিশাল বৃদ্ধি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে ক্রমেই চাপের মুখে ফেলছে। বিগত দুই অর্থবছরে মোট ৩৯ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের বিপরীতে আমদানির জন্য ৬৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খুলতে হয়েছে। অর্থাত্ বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আরও আশঙ্কার কথা হলো—বর্তমান অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে তৈরি পোশাক খাতে গড়ে ৩১ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি হলেও সেপ্টেম্বর মাসে গত বছরের তুলনায় একই খাতে রফতানি কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। মাত্র একটি মাসের রফতানির পরিসংখ্যান দিয়ে কোনো মন্তব্য করা না গেলেও ইউরোপ ও আমেরিকার চলমান মন্দা বিবেচনায় সেপ্টেম্বর মাসে রফতানির নিম্নগতি নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক।
তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা এর মধ্যে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের কার্যাদেশ হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি অবহিত করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল পত্রিকা হিসেবে বিশেষ পরিচিত দৈনিক ইত্তেফাক এই মাসের ২২ তারিখে যে প্রধান খবরটি (Lead Story) ছেপেছে, তার শিরোনাম : ‘পোশাক শিল্পের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন উদ্যোক্তারা’। আমার সম্পাদিত পত্রিকায় এই খবরটি ছাপা হলে সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদবর্গ হয়তো ষড়যন্ত্রতত্ত্বের খোঁজ করতেন। আশা করি, ইত্তেফাকের ক্ষেত্রে তিনি এমন কোনো অভিযোগ উত্থাপন করবেন না।
৪. বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের তৃতীয় খাতের অবস্থা বর্তমানে সবচেয়ে নাজুক। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাইকা। শুধু তা-ই নয়, সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তারে বিরক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পর্যন্ত এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতি বছর গড়ে আমাদের প্রায় এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তার (Budgetary Support) প্রয়োজন হয়। এ বছর এই অর্থপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অর্থমন্ত্রী ইউরোপ-আমেরিকার সব রাজধানীতে ঘুরে ঘুরে যথাসম্ভব দেন-দরবার করে চলেছেন। বৈদেশিক মুদ্রায় এই ঋণ দ্রুত ছাড় করানো না গেলে বাংলাদেশের পক্ষে তার আন্তর্জাতিক দায়সমূহ মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বিভিন্ন সূত্রে খবর পাচ্ছি, বাংলাদেশ ব্যাংক নানারকম জোড়াতালি দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় দশ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ধরে রেখেছে। বিপুল অংকের এলসি’র দায় পরিশোধে যথাসম্ভব বিলম্বও করছে। কিন্তু আর বেশিদিন এভাবে চললে আমদানিকারকদের পক্ষে নতুন ঋণপত্র খোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ঋণপ্রবাহ শুকিয়ে যাওয়ার জন্য অযৌক্তিকভাবে যতই নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে দায়ী করুন না কেন, স্মরণে রাখা দরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তারই, প্রফেসর ইউনূসের নয়। তিন বছর ধরে কেবল প্রতিহিংসা এবং প্রোপাগান্ডানির্ভর সরকার পরিচালনার অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতার সব দায়ভার শেখ হাসিনা ও তার পরামর্শকদের গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে এখন প্রফেসর ইউনূস, বেগম খালেদা জিয়া এবং মিডিয়াকে দোষারোপ করে কোনোই ফায়দা নেই।
মহাজোট সরকারের মেয়াদের আরও দুই বছর এখনও অবশিষ্ট আছে। এবার অন্তত জিঘাংসা পরিহার করে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করার বদখেয়ালমুক্ত হয়ে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের দিকে নজর দিলে হয়তো পিঠ বাঁচানো যেতে পারে। নইলে আরব বসন্তের (Arab spring) ধাক্কা বাংলাদেশেও লাগা বিচিত্র নয়। গত এক সপ্তাহে টেলিভিশন টকশোগুলোতে বিবেকবান বিশ্লেষকরা কর্নেল গাদ্দাফির পরিণতির কথা বলতে গিয়ে এদেশের সরকারের প্রতি সময় থাকতেই শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
৫. অনেক রাষ্ট্রেই অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অস্থির সময় পাড়ি দেয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের তিন বছরের অপশাসনের ফলে একমাত্র কৃষি ছাড়া সব খাত এক বিপর্যয়কর এবং অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হয়েছে। কৃষি এখনও টিকে আছে এদেশের কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম এবং আল্লাহর রহমতে পরপর তিন বছর প্রকৃতি অনুকূল থাকার কারণে। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, হিন্দু দেবী দুর্গা এ বছর হাতিতে (গজ) সওয়ার হয়ে মর্ত্যে আগমন করাতেই নাকি ফসল ভালো হয়েছে! যাই হোক, তার বিশ্বাস তার কাছে।
শেয়ারবাজারে সরকারি দলের ‘ফান্ড কালেক্টরদের’ কারসাজির ফলে তেত্রিশ লাখ বিনিয়োগকারী চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দু’বার তাদের পকেট কাটার পর সম্প্রতি নানান ফন্দি-ফিকির করে তৃতীয়বার একেবারে নিঃস্ব করার আয়োজন চলছে। যেভাবে দিনের পর দিন শেয়ারবাজারে তেলেসমাতি চলছে, তাতে দেশে আদৌ কোনো সরকার আছে বলেই বোধ হচ্ছে না। জনগণের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়দায়িত্ব এই সরকারের থাকলে অর্থমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে অনেক আগেই বিদায় নেয়ার কথা ছিল। অবশ্য, দিল্লির অনুচরদের কাছ থেকে সুশাসন আশা করার কোনো অর্থ হয় না।
৬. বর্তমান অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ে কোনোরকম আলোচনাই অর্থহীন। সরকারপ্রধানের বদ্ধমূল ধারণা, জনগণ তার আমলে চারবেলা গোগ্রাসে খাচ্ছে বলেই জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়েছে! প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে ক্লু নিয়ে তাই বাণিজ্যমন্ত্রী আমাদের কম খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। আর অর্থমন্ত্রীর থিওরি হচ্ছে সপ্তাহে একদিন বাজারে না যাওয়া। এই সরকারের সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশের মিডিয়ার নব্বই শতাংশ ভারতপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা এ-জাতীয় কাণ্ডজ্ঞানহীন উক্তি করলে মিডিয়া তাদের ওপর কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত, ভাবতেই হৃদকম্প হওয়ার কথা। ২০০৫ সালে দ্রব্যমূল্যের খানিক বৃদ্ধিতে আওয়ামী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাত হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের তত্ত্ব নিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির হয়েছিলেন। তার সব আজগুবি অংক ব্রহ্মজ্ঞান বিবেচনা করে সিংহভাগ মিডিয়া সেই সময় লুফেও নিয়েছিল। সেই সরকার গত হওয়ার পাঁচ বছর পরও আমাদের হাওয়া ভবনের গল্প শুনতে হচ্ছে।
আজকে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি যখন রেকর্ড ১৪ শতাংশ, তখন এসব দলবাজ অর্থনীতিবিদ নতুন সিন্ডিকেট খোঁজা বাদ দিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন তাদের নেত্রীর জন্য নোবেল পুরস্কার আনার তদবিরে। গত এক বছর ধরে এই চিহ্নিত গোষ্ঠী বিশেষ মিশনে ইউরোপ, আমেরিকার শহরগুলোতে চষে বেড়িয়েছেন। এ বছর তিন নারী নোবেল পুরস্কার ভাগাভাগি করে নিলেও তার মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। নানক-বারকাত-বোরহান মিশন অর্থ অপচয় ছাড়া শেষ পর্যন্ত আর কোনো কাজে আসেনি। সেই ব্যর্থ মিশনের অর্থ সরকারের কোন খাত থেকে গেছে, তার হিসাব আশা করি দেশের নিরন্ন জনগণ একদিন ভালো করেই নেবেন। বারকাত সাহেবদের অতি প্রিয় হিউরিস্টিক (Heuristic) তত্ত্ব সেদিন তাদের রক্ষার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।
আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম ২০১০ সালের জুন মাসের ২ তারিখ ভোর রাত তিনটা বেজে তিরিশ মিনিটে। তার দু’দিন আগে ৩০ মে সীমাহীন লুটপাটের অতিকায় সব বাজেটবিষয়ক যে মন্তব্য-প্রতিবেদনটি আমার দেশ পত্রিকায় লিখেছিলাম, তার শিরোনাম ছিল— ‘টাকার পাহাড় যাচ্ছে কোথায়’। তখনও জনগণের এই ভারত-বান্ধব সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ মোহভঙ্গ হয়নি। সেই লেখার বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু অংশ প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে দেড় বছর পর উদ্ধৃত করছি :
“ষ পাঁচ বছরে রাজস্ব ব্যয় আড়াই গুণ বৃদ্ধি করে আর যা-ই হোক সম্পদের সুষম বণ্টন কিংবা দারিদ্র্যবিমোচন—কোনোটাই সাধিত হতে পারে না। জনগণের অর্থের এই অপচয় দেশে বিরাজমান আয়-বৈষম্যকে অধিকতর বিস্তৃত করবে।
ষ আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় ঢাকা এবং চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে এখন যা চলছে, তাকে স্রেফ জুয়া ছাড়া আর কোনো নামে ডাকার উপায় নেই। ফাটকাবাজগোষ্ঠীর কারসাজিতে সৃষ্ট এই বিশালাকায় বেলুন ফুটো হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সম্ভবত বর্তমান সরকারের মেয়াদের বছর খানেক বাকি থাকতে এই বেলুনটি ফাটবে এবং পরিণামে এদেশে অসংখ্য দেউলিয়া মানুষের সঙ্গে আমরা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেউলিয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানও দেখতে পাব।
ষ সাম্প্রতিক বাজেটের বিশালত্বের আলোচনায় ফেরা যাক। লক্ষ-কোটি টাকার রাজস্ব বাজেট প্রণয়নের পেছনে মন্ত্রী, এমপি, আমলাশ্রেণীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিলাসিতার ব্যয়ভার, অপচয়, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধির ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান সরকার বিনা টেন্ডারে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ কেনার যেসব আত্মঘাতী চুক্তি করছে, তার ফলে রাজস্ব খাতে ভর্তুকির বরাদ্দ বৃদ্ধি পেতে বাধ্য।
ষ এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ ক্ষমতাসীনদের মদতপুষ্ট গোষ্ঠীর জন্য বিপুল বিত্তবৈভব অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জনগণ।
ষ প্রতি বছর বাজেটের অঙ্ক বাড়িয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী অবশ্যই আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন। কিন্তু তাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রার মানের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতির অধোগতির চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত এক বছরে ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিবেশের সব সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। দুর্নীতি, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা এবং ক্রয় নীতিমালায় অস্বচ্ছতা ও রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহারে জবাবদিহিতার অভাবে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ষ সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকল্পে জঙ্গি দমনের ধুয়া তুলে সুশাসন জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল পকেট ভর্তির সুযোগ খুঁজে বেড়ালে নিয়তির লিখন পাল্টানো যাবে না। জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ গ্রহণ করে অবাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতির বন্যা ছুটিয়ে রাজসিংহাসনে উপবেশন করা হয়তো যায়, তবে বিপুল জনগোষ্ঠীর আশাভঙ্গজনিত রুদ্ররোষ থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাওয়া যে যায় না, এটাই ইতিহাসের লিখন।”
আমার গত বছরের লেখাটি সরকারি নীতিনির্ধারকরা তখন পড়ার সময় পাননি ধারণা করেই এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। সেই মুহূর্তে তারা আমাকে গ্রেফতারের কৌশল নির্ধারণের শলাপরামর্শে নিশ্চয়ই অধিকতর ব্যস্ত ছিলেন। ভিন্নমতাবলম্বীর লেখা হলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত লেখাটি এখনও পড়লে উপকৃত হতেও পারেন। আমার পাঠকদের মধ্যে যারা শেয়ারবাজারে ব্যবসা করেন, তারাও আমার সাবধানবাণীতে সেদিন কান দেননি। মন্তব্য-প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সাধারণ মূল্যসূচক ৬ হাজারের ধারে-কাছে থাকলেও সে বছর ডিসেম্বরে সূচক ৯ হাজারে ওঠানোর পরই বেলুন ছিদ্র করে দেয় সরকারের অনুগ্রহভাজন গোষ্ঠী। ততক্ষণে শেয়ারবাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকারও অধিক লুটপাট সম্পন্ন হয়েছে।
জাতির কাঁধে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের বহন অযোগ্য বোঝা নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলাম, সেটিও আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমার রিমান্ডকালে টিএফআই সেলে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিনা টেন্ডারে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তে আমার আপত্তির কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। আন্দাজ করছি, প্রশ্নকর্তারা সব বয়সে তরুণ ছিলেন। অর্থনীতির মার-প্যাঁচ তাদের সম্পূর্ণ বোঝারও কথা নয়। সেই প্রশ্নকর্তারা এখন কোথায়, তাও আমার অজানা। আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদনটি পড়লে তারা হয়তো সেদিনের প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। অর্থমন্ত্রী বর্তমান অর্থবছরে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে স্বপ্ন দেখছেন, তার সঙ্গে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার সঙ্গেই কেবল তুলনা হতে পারে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, অর্থমন্ত্রীর কাছে এমন কোনো আলাদিনের চেরাগ রয়েছে যার সাহায্যে এই অলৌকিক কাজটি তিনি করে ফেলবেন, তার পরও কথা থাকে। বিএনপির শেষ বছর যখন মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছিল, তখন প্রবৃদ্ধি ৬.৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। আজ মূল্যস্ফীতি যখন প্রায় দ্বিগুণ, সেই সময় ৬.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমতা বিধানের জন্য জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি কত হওয়া উচিত, এই অঙ্ক কষার দায়িত্ব মাননীয় অর্থন্ত্রীকেই দিলাম। তদুপরি এই সরকারের পরিসংখ্যানের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের যে আজ আর আস্থা নেই, সে বিষয়ে আগেই উল্লেখ করেছি।
বিশ্বব্যাংক তাদের এবারের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অধোগতির চিত্র পুনর্বার তুলে ধরেছে। ব্যবসার সক্ষমতায় বিশ্বে বাংলাদেশ আরও চার ধাপ পিছিয়ে বর্তমানে ১২২ নম্বরে অবস্থান করছে। একটি দেশে ব্যবসার সক্ষমতা হ্রাস পেলে জাতীয় আয় কেমন করে বৃদ্ধি পায়, সেটি আমার অন্তত জানা নেই। অর্থনীতিবিদরা সেই রহস্যের কিনারা করবেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের সাধারণ মানুষ এসব প্রবৃদ্ধির মার-প্যাঁচ বোঝে না। লুটেরারা ছাড়া দেশের সব নাগরিকের জীবনযাত্রার মান গত তিন বছরে নিম্নগামী হয়েছে, সেটাই বাস্তবতা। তাই খেটে খাওয়া মানুষের কাছে প্রবৃদ্ধির বড়াই অর্থমন্ত্রীর আরেকটি রসিকতার মতোই শোনাচ্ছে।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com
এই সরকারের এবারের মেয়াদে সরকারি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। এ বছরও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি—সবাই বলছে প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৬.৫-এর মধ্যেই থাকবে। অথচ অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আগাম ঘোষণা দিয়ে ফেলেছেন। অর্থনীতির সব সূচকেই তিনি নাকি কেবলই অগ্রগতি খুঁজে পাচ্ছেন। আবুল মুহিতের আকাশচুম্বী আশাবাদের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক বাস্তব চিত্রটি এবার দেখার চেষ্টা করব।
১. মূল্যস্ফীতি দিয়েই শুরু করা যাক। এ বছর মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘর অতিক্রম করার পর থেকে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ যথাক্রমে ১০.৯৬, ১১.২৯ এবং ১১.৯৭। খাদ্যে মূল্যস্ফীতির অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেপ্টেম্বর মাসে এই হার ১৩.৭৫। আমাদের অর্থমন্ত্রী সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে মূল্যস্ফীতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়েছেন। অথচ এশিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্রই একই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়েছে। গোটা এশিয়ায় একমাত্র ভিয়েতনাম, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান এবং নানাবিধ সঙ্কটে পর্যুদস্ত পাকিস্তান ছাড়া প্রতিটি রাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অনেক নিচে। মূল্যস্ফীতির উচ্চহারে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের স্থান তৃতীয় এবং গোটা এশিয়ায় চতুর্থ। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মূল কারণই হচ্ছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও চরম দুর্নীতি। এ প্রসঙ্গে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ বছরের মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান পাঠককে জানানো প্রয়োজন। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। এমনকি মইন-ফখরুদ্দীন জমানাতেও মূল্যস্ফীতি দুই অংক অতিক্রম করেনি। তাদের যৌথ শাসনের দুই বছরের মধ্যে ২০০৭-০৮ সালে মূল্যস্ফীতি দশের কাছাকাছি ৯.৯৩-এ উন্নীত হয়েছিল। মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা মানুষ তখন জরুরি সরকারের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর সুদিনের স্বপ্ন দেখেছিল। ডিজিটাল নির্বাচনের পরবর্তী তিন বছরে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর অতিকায় বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে শাসকশ্রেণীর সীমাহীন সম্পদের লোভের কড়ি জোগানোর উদ্দেশ্যে। জনগণের ওপর করের বোঝা ক্রমাগত বাড়িয়েও এসব অতিকায় বাজেটের ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না। কাজেই সরকারকে দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
এদিকে দুর্নীতির অভিযোগ সর্বব্যাপী হওয়ায় বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা ক্রমেই হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন। ফলে দেশীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের সব উদ্বৃত্ত অর্থ চলে যাচ্ছে সরকারের জঠরে। জনশ্রুতি রয়েছে, দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংক মিলেও এই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মেটাতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংক অতিরিক্ত টাকা ছাপাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বের যে কোনো দেশে এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতির নিয়মেই মূল্যস্ফীতি জনগণের নাগালের বাইরে চলে যেতে বাধ্য। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সুতরাং অর্থমন্ত্রী যতই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির দোহাই দেয়ার চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে অর্থনীতি পরিচালনায় দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতার ফলেই অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া আজ এমনভাবে ছুটছে।
২. আমাদের বার্ষিক বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন মেটাতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থ, রফতানি আয় এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঋণ—এই তিন খাতই মূলত ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে যত্সামান্য বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) যুক্ত হলেও তাতে BOP-তে (Balance of Payment) তেমন একটা হেরফের হয় না। তিন খাতের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থে ভয়াবহ ধস নেমেছে। ২০০৪-০৫ থেকে ২০০৮-০৯ পর্যন্ত চার অর্থবছরে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে প্রায় ২৬ শতাংশ। বর্তমান সরকারের প্রথম দুই অর্থবছরে সেই প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৬ এবং ৬ শতাংশে।
মহাজোট সরকারের ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতির ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আমাদের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তারই নেতিবাচক প্রতিফলন আমরা এক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্র সৌদি আরবে কর্মরত তাদের নাগরিকদের ওয়ার্ক পারমিট বা আকামা সমস্যা সমাধানে সফল হলেও বাংলাদেশ সরকার এ কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একাধিকবার আকামা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ অদ্যাবধি দেখা যাচ্ছে না। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে শেখ হাসিনা সরকারের ইসলামবিরোধী নীতি অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রাতৃপ্রতিম ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর শ্রমবাজারে বাংলাদেশী নাগরিকদের কাজ করার সুযোগ ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে বাধ্য। সুতরাং বর্তমান সরকারের বাকি মেয়াদের মধ্যেই প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি (negative growth) ঘটার আশঙ্কা প্রবলতর হচ্ছে।
৩. রফতানি বাণিজ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে আমরা নিঃসন্দেহে ভালো করেছি। এ বছর রফতানিতে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ৪১ শতাংশ। কিন্তু উল্লেখ করা দরকার, ২০০৯-১০ অর্থবছরে আমরা মাত্র ৪.৩ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম, যা বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সুতরাং দুই অর্থবছরের গড় রফতানি আয় হিসাব করলে আমাদের অতিরিক্ত আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। অন্যদিকে রফতানির বিপরীতে আমদানির বিশাল বৃদ্ধি আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে ক্রমেই চাপের মুখে ফেলছে। বিগত দুই অর্থবছরে মোট ৩৯ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের বিপরীতে আমদানির জন্য ৬৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র খুলতে হয়েছে। অর্থাত্ বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আরও আশঙ্কার কথা হলো—বর্তমান অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে তৈরি পোশাক খাতে গড়ে ৩১ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি হলেও সেপ্টেম্বর মাসে গত বছরের তুলনায় একই খাতে রফতানি কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। মাত্র একটি মাসের রফতানির পরিসংখ্যান দিয়ে কোনো মন্তব্য করা না গেলেও ইউরোপ ও আমেরিকার চলমান মন্দা বিবেচনায় সেপ্টেম্বর মাসে রফতানির নিম্নগতি নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক।
তৈরি পোশাক রফতানিকারকরা এর মধ্যে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের কার্যাদেশ হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি অবহিত করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল পত্রিকা হিসেবে বিশেষ পরিচিত দৈনিক ইত্তেফাক এই মাসের ২২ তারিখে যে প্রধান খবরটি (Lead Story) ছেপেছে, তার শিরোনাম : ‘পোশাক শিল্পের ভবিষ্যত্ নিয়ে উদ্বিগ্ন উদ্যোক্তারা’। আমার সম্পাদিত পত্রিকায় এই খবরটি ছাপা হলে সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদবর্গ হয়তো ষড়যন্ত্রতত্ত্বের খোঁজ করতেন। আশা করি, ইত্তেফাকের ক্ষেত্রে তিনি এমন কোনো অভিযোগ উত্থাপন করবেন না।
৪. বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের তৃতীয় খাতের অবস্থা বর্তমানে সবচেয়ে নাজুক। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিত করেছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং জাইকা। শুধু তা-ই নয়, সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তারে বিরক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পর্যন্ত এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতি বছর গড়ে আমাদের প্রায় এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তার (Budgetary Support) প্রয়োজন হয়। এ বছর এই অর্থপ্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অর্থমন্ত্রী ইউরোপ-আমেরিকার সব রাজধানীতে ঘুরে ঘুরে যথাসম্ভব দেন-দরবার করে চলেছেন। বৈদেশিক মুদ্রায় এই ঋণ দ্রুত ছাড় করানো না গেলে বাংলাদেশের পক্ষে তার আন্তর্জাতিক দায়সমূহ মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
বিভিন্ন সূত্রে খবর পাচ্ছি, বাংলাদেশ ব্যাংক নানারকম জোড়াতালি দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় দশ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ধরে রেখেছে। বিপুল অংকের এলসি’র দায় পরিশোধে যথাসম্ভব বিলম্বও করছে। কিন্তু আর বেশিদিন এভাবে চললে আমদানিকারকদের পক্ষে নতুন ঋণপত্র খোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ঋণপ্রবাহ শুকিয়ে যাওয়ার জন্য অযৌক্তিকভাবে যতই নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে দায়ী করুন না কেন, স্মরণে রাখা দরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তারই, প্রফেসর ইউনূসের নয়। তিন বছর ধরে কেবল প্রতিহিংসা এবং প্রোপাগান্ডানির্ভর সরকার পরিচালনার অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতার সব দায়ভার শেখ হাসিনা ও তার পরামর্শকদের গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দিয়ে এখন প্রফেসর ইউনূস, বেগম খালেদা জিয়া এবং মিডিয়াকে দোষারোপ করে কোনোই ফায়দা নেই।
মহাজোট সরকারের মেয়াদের আরও দুই বছর এখনও অবশিষ্ট আছে। এবার অন্তত জিঘাংসা পরিহার করে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করার বদখেয়ালমুক্ত হয়ে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের দিকে নজর দিলে হয়তো পিঠ বাঁচানো যেতে পারে। নইলে আরব বসন্তের (Arab spring) ধাক্কা বাংলাদেশেও লাগা বিচিত্র নয়। গত এক সপ্তাহে টেলিভিশন টকশোগুলোতে বিবেকবান বিশ্লেষকরা কর্নেল গাদ্দাফির পরিণতির কথা বলতে গিয়ে এদেশের সরকারের প্রতি সময় থাকতেই শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
৫. অনেক রাষ্ট্রেই অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অস্থির সময় পাড়ি দেয়ার নজির রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের তিন বছরের অপশাসনের ফলে একমাত্র কৃষি ছাড়া সব খাত এক বিপর্যয়কর এবং অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হয়েছে। কৃষি এখনও টিকে আছে এদেশের কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম এবং আল্লাহর রহমতে পরপর তিন বছর প্রকৃতি অনুকূল থাকার কারণে। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, হিন্দু দেবী দুর্গা এ বছর হাতিতে (গজ) সওয়ার হয়ে মর্ত্যে আগমন করাতেই নাকি ফসল ভালো হয়েছে! যাই হোক, তার বিশ্বাস তার কাছে।
শেয়ারবাজারে সরকারি দলের ‘ফান্ড কালেক্টরদের’ কারসাজির ফলে তেত্রিশ লাখ বিনিয়োগকারী চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দু’বার তাদের পকেট কাটার পর সম্প্রতি নানান ফন্দি-ফিকির করে তৃতীয়বার একেবারে নিঃস্ব করার আয়োজন চলছে। যেভাবে দিনের পর দিন শেয়ারবাজারে তেলেসমাতি চলছে, তাতে দেশে আদৌ কোনো সরকার আছে বলেই বোধ হচ্ছে না। জনগণের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়দায়িত্ব এই সরকারের থাকলে অর্থমন্ত্রী, অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে অনেক আগেই বিদায় নেয়ার কথা ছিল। অবশ্য, দিল্লির অনুচরদের কাছ থেকে সুশাসন আশা করার কোনো অর্থ হয় না।
৬. বর্তমান অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ে কোনোরকম আলোচনাই অর্থহীন। সরকারপ্রধানের বদ্ধমূল ধারণা, জনগণ তার আমলে চারবেলা গোগ্রাসে খাচ্ছে বলেই জিনিসপত্রের দাম এতটা বেড়েছে! প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে ক্লু নিয়ে তাই বাণিজ্যমন্ত্রী আমাদের কম খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। আর অর্থমন্ত্রীর থিওরি হচ্ছে সপ্তাহে একদিন বাজারে না যাওয়া। এই সরকারের সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশের মিডিয়ার নব্বই শতাংশ ভারতপন্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিএনপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা এ-জাতীয় কাণ্ডজ্ঞানহীন উক্তি করলে মিডিয়া তাদের ওপর কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত, ভাবতেই হৃদকম্প হওয়ার কথা। ২০০৫ সালে দ্রব্যমূল্যের খানিক বৃদ্ধিতে আওয়ামী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আবুল বারকাত হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের তত্ত্ব নিয়ে মিডিয়ার সামনে হাজির হয়েছিলেন। তার সব আজগুবি অংক ব্রহ্মজ্ঞান বিবেচনা করে সিংহভাগ মিডিয়া সেই সময় লুফেও নিয়েছিল। সেই সরকার গত হওয়ার পাঁচ বছর পরও আমাদের হাওয়া ভবনের গল্প শুনতে হচ্ছে।
আজকে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি যখন রেকর্ড ১৪ শতাংশ, তখন এসব দলবাজ অর্থনীতিবিদ নতুন সিন্ডিকেট খোঁজা বাদ দিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন তাদের নেত্রীর জন্য নোবেল পুরস্কার আনার তদবিরে। গত এক বছর ধরে এই চিহ্নিত গোষ্ঠী বিশেষ মিশনে ইউরোপ, আমেরিকার শহরগুলোতে চষে বেড়িয়েছেন। এ বছর তিন নারী নোবেল পুরস্কার ভাগাভাগি করে নিলেও তার মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। নানক-বারকাত-বোরহান মিশন অর্থ অপচয় ছাড়া শেষ পর্যন্ত আর কোনো কাজে আসেনি। সেই ব্যর্থ মিশনের অর্থ সরকারের কোন খাত থেকে গেছে, তার হিসাব আশা করি দেশের নিরন্ন জনগণ একদিন ভালো করেই নেবেন। বারকাত সাহেবদের অতি প্রিয় হিউরিস্টিক (Heuristic) তত্ত্ব সেদিন তাদের রক্ষার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।
আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম ২০১০ সালের জুন মাসের ২ তারিখ ভোর রাত তিনটা বেজে তিরিশ মিনিটে। তার দু’দিন আগে ৩০ মে সীমাহীন লুটপাটের অতিকায় সব বাজেটবিষয়ক যে মন্তব্য-প্রতিবেদনটি আমার দেশ পত্রিকায় লিখেছিলাম, তার শিরোনাম ছিল— ‘টাকার পাহাড় যাচ্ছে কোথায়’। তখনও জনগণের এই ভারত-বান্ধব সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ মোহভঙ্গ হয়নি। সেই লেখার বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু অংশ প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে দেড় বছর পর উদ্ধৃত করছি :
“ষ পাঁচ বছরে রাজস্ব ব্যয় আড়াই গুণ বৃদ্ধি করে আর যা-ই হোক সম্পদের সুষম বণ্টন কিংবা দারিদ্র্যবিমোচন—কোনোটাই সাধিত হতে পারে না। জনগণের অর্থের এই অপচয় দেশে বিরাজমান আয়-বৈষম্যকে অধিকতর বিস্তৃত করবে।
ষ আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় ঢাকা এবং চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে এখন যা চলছে, তাকে স্রেফ জুয়া ছাড়া আর কোনো নামে ডাকার উপায় নেই। ফাটকাবাজগোষ্ঠীর কারসাজিতে সৃষ্ট এই বিশালাকায় বেলুন ফুটো হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। সম্ভবত বর্তমান সরকারের মেয়াদের বছর খানেক বাকি থাকতে এই বেলুনটি ফাটবে এবং পরিণামে এদেশে অসংখ্য দেউলিয়া মানুষের সঙ্গে আমরা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেউলিয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানও দেখতে পাব।
ষ সাম্প্রতিক বাজেটের বিশালত্বের আলোচনায় ফেরা যাক। লক্ষ-কোটি টাকার রাজস্ব বাজেট প্রণয়নের পেছনে মন্ত্রী, এমপি, আমলাশ্রেণীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিলাসিতার ব্যয়ভার, অপচয়, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধির ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান সরকার বিনা টেন্ডারে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র থেকে বিদ্যুত্ কেনার যেসব আত্মঘাতী চুক্তি করছে, তার ফলে রাজস্ব খাতে ভর্তুকির বরাদ্দ বৃদ্ধি পেতে বাধ্য।
ষ এ ধরনের স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ ক্ষমতাসীনদের মদতপুষ্ট গোষ্ঠীর জন্য বিপুল বিত্তবৈভব অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি করলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জনগণ।
ষ প্রতি বছর বাজেটের অঙ্ক বাড়িয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী অবশ্যই আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন। কিন্তু তাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাত্রার মানের কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতির অধোগতির চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত এক বছরে ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিবেশের সব সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। দুর্নীতি, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা এবং ক্রয় নীতিমালায় অস্বচ্ছতা ও রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহারে জবাবদিহিতার অভাবে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ষ সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়নকল্পে জঙ্গি দমনের ধুয়া তুলে সুশাসন জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল পকেট ভর্তির সুযোগ খুঁজে বেড়ালে নিয়তির লিখন পাল্টানো যাবে না। জনগণের অজ্ঞতার সুযোগ গ্রহণ করে অবাস্তবায়নযোগ্য প্রতিশ্রুতির বন্যা ছুটিয়ে রাজসিংহাসনে উপবেশন করা হয়তো যায়, তবে বিপুল জনগোষ্ঠীর আশাভঙ্গজনিত রুদ্ররোষ থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাওয়া যে যায় না, এটাই ইতিহাসের লিখন।”
আমার গত বছরের লেখাটি সরকারি নীতিনির্ধারকরা তখন পড়ার সময় পাননি ধারণা করেই এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম। সেই মুহূর্তে তারা আমাকে গ্রেফতারের কৌশল নির্ধারণের শলাপরামর্শে নিশ্চয়ই অধিকতর ব্যস্ত ছিলেন। ভিন্নমতাবলম্বীর লেখা হলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত লেখাটি এখনও পড়লে উপকৃত হতেও পারেন। আমার পাঠকদের মধ্যে যারা শেয়ারবাজারে ব্যবসা করেন, তারাও আমার সাবধানবাণীতে সেদিন কান দেননি। মন্তব্য-প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সাধারণ মূল্যসূচক ৬ হাজারের ধারে-কাছে থাকলেও সে বছর ডিসেম্বরে সূচক ৯ হাজারে ওঠানোর পরই বেলুন ছিদ্র করে দেয় সরকারের অনুগ্রহভাজন গোষ্ঠী। ততক্ষণে শেয়ারবাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকারও অধিক লুটপাট সম্পন্ন হয়েছে।
জাতির কাঁধে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের বহন অযোগ্য বোঝা নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলাম, সেটিও আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমার রিমান্ডকালে টিএফআই সেলে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিনা টেন্ডারে রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তে আমার আপত্তির কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। আন্দাজ করছি, প্রশ্নকর্তারা সব বয়সে তরুণ ছিলেন। অর্থনীতির মার-প্যাঁচ তাদের সম্পূর্ণ বোঝারও কথা নয়। সেই প্রশ্নকর্তারা এখন কোথায়, তাও আমার অজানা। আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদনটি পড়লে তারা হয়তো সেদিনের প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন। অর্থমন্ত্রী বর্তমান অর্থবছরে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে স্বপ্ন দেখছেন, তার সঙ্গে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখার সঙ্গেই কেবল তুলনা হতে পারে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, অর্থমন্ত্রীর কাছে এমন কোনো আলাদিনের চেরাগ রয়েছে যার সাহায্যে এই অলৌকিক কাজটি তিনি করে ফেলবেন, তার পরও কথা থাকে। বিএনপির শেষ বছর যখন মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছিল, তখন প্রবৃদ্ধি ৬.৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। আজ মূল্যস্ফীতি যখন প্রায় দ্বিগুণ, সেই সময় ৬.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমতা বিধানের জন্য জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি কত হওয়া উচিত, এই অঙ্ক কষার দায়িত্ব মাননীয় অর্থন্ত্রীকেই দিলাম। তদুপরি এই সরকারের পরিসংখ্যানের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের যে আজ আর আস্থা নেই, সে বিষয়ে আগেই উল্লেখ করেছি।
বিশ্বব্যাংক তাদের এবারের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অধোগতির চিত্র পুনর্বার তুলে ধরেছে। ব্যবসার সক্ষমতায় বিশ্বে বাংলাদেশ আরও চার ধাপ পিছিয়ে বর্তমানে ১২২ নম্বরে অবস্থান করছে। একটি দেশে ব্যবসার সক্ষমতা হ্রাস পেলে জাতীয় আয় কেমন করে বৃদ্ধি পায়, সেটি আমার অন্তত জানা নেই। অর্থনীতিবিদরা সেই রহস্যের কিনারা করবেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের সাধারণ মানুষ এসব প্রবৃদ্ধির মার-প্যাঁচ বোঝে না। লুটেরারা ছাড়া দেশের সব নাগরিকের জীবনযাত্রার মান গত তিন বছরে নিম্নগামী হয়েছে, সেটাই বাস্তবতা। তাই খেটে খাওয়া মানুষের কাছে প্রবৃদ্ধির বড়াই অর্থমন্ত্রীর আরেকটি রসিকতার মতোই শোনাচ্ছে।
ই-মেইল : admahmudrahman@gmail.com
No comments