আশার সঙ্গী অনিঃশেষ অনিশ্চয়তা by শাহজাহান কবির

কসময় মেয়েরা ছিলেন পুরোপুরি অন্তঃপুরবাসিনী। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে ধীরে ধীরে জয় করে লেখাপড়া, সংস্কৃতিচর্চা, চাকরি, খেলাধুলায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন সেটা বেশ দূরের অতীত। তাই বলে প্রতিবন্ধকতা কি একেবারেই নেই? থাকলে কতটুকু আছে? সেগুলো সঙ্গে নিয়ে কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশে মহিলাদের ক্রীড়াঙ্গন? আরো এগোতে হলে কী কী করার আছে, করা হচ্ছে কতটুকু? এসব জানতে আর জানাতেই তিন পর্বের এই ধারাবাহিক। আজ দ্বিতীয় পর্বে থাকছে ক্রীড়াঙ্গনে এখনকার মেয়েদের অবস্থান ও অর্জনের কথা।২০১০ সালের এসএ গেমস বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসেই অন্যতম উজ্জ্বল ঘটনা।


আয়োজনের সার্থকতায় যেমন তেমনি সাফল্যের মাপকাঠিতেও। সেই সাফল্যের বিচারে আবার এগিয়ে মহিলা ক্রীড়াবিদরা। রেকর্ড ১৮টি সোনার আটটিই এসেছে তাঁদের হাত ধরে। সীমিত সুযোগে আবারও যেন সম্ভাবনার ফুলঝুরি, কারণ, বাকি যে কটি ইভেন্টে সোনা এসেছে অথচ যেখানে মেয়েদের নাম নেই সেগুলোর বেশির ভাগে মেয়েদের অংশগ্রহণই ছিল না।
সর্বশেষ এশিয়ান গেমসের কথা ধরা যাক। সেখান থেকে রুপা নিয়ে ফিরেছে বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেট দল, যারা কিনা প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলেছে ২০০৭ সালে। কাবাডিতে অবদানটা অন্য রকম। ক্রিকেটে পুরুষ দল সোনা নিয়ে ফিরেছিল, কিন্তু কাবাডির ছেলেরা ফিরল খালি হাতে। অথচ এশিয়ান গেমসে বরাবর কোনো না কোনো পদক জিতিয়ে বাংলাদেশের মান বাঁচান তাঁরা। এবার ছেলেদের ব্যর্থতায় ব্রোঞ্জ জিতে মুখ রক্ষা করেন মেয়েরা, অথচ এশিয়াডের বিশাল যজ্ঞে শাহনাজ পারভীন, মালেকা বেগমদের সেটাই ছিল প্রথম অংশগ্রহণ।
স্বল্প বিনিয়োগে ক্রীড়াঙ্গনের মেয়েরা দেশকে বড় সাফল্য আগে দিয়েছেন, দিচ্ছেন এখনো। পৃষ্ঠপোশকতা নিয়ে শাহনাজরা অসন্তুষ্ট নন। সাবেক সফল মহিলা ক্রীড়াবিদদের কাছে বর্তমান ক্রীড়াঙ্গনের হাল-হকিকত জানতে চাইলে উনারা এক নিঃশ্বাসে যে কথাটা বরাবর বলে যান, তা হলো, 'আগে খেলাধুলা করেছে শিক্ষিত মেয়েরা। খেলাধুলাটা তখন একটা প্যাশন ছিল। এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামগঞ্জ থেকে মেয়েরা আসছে পেটের দায়ে। তাদের কাছে টাকা, ভবিষ্যৎ ভাবনা এ সবই বড় হতে বাধ্য।' বাস্তবতা হচ্ছে এই অর্থ কষ্টে পড়া মেয়েদের পরিচর্যা করে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলবে যে প্রতিষ্ঠান বা ফেডারেশন তারাও বেশ দীনহীন। শাহনাজ বেগম পঞ্চগড়ে স্কুল হ্যান্ডবল খেলে খেলে সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশ আনসারে। সেখান থেকে কাবাডিতে নাম লিখিয়ে এখন জাতীয় দলের অধিনায়ক। 'এখন তো আমাদের কাবাডি লিগও হচ্ছে। দলগুলো ১০-১৫ হাজার করে টাকা দিচ্ছে, এটাও তো অনেক। আগে তো এটুকুও ছিল না'_শাহনাজও তাই ক্রীড়াঙ্গন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই। বেশ দীনহীন হলেও আর অগ্রগতিটা ধীরে হলেও হচ্ছে তো। এই বিবেচনায় ফুটবলের কথাটা আসে সর্বাগ্রে। ২০০৫ সালে বেশ ঝড়ঝঞ্ঝা পেরিয়ে পথচলা শুরু হওয়া মহিলা ফুটবলেও এ বছর থেকে লিগ হচ্ছে। মোহামেডান বা শেখ জামালের মতো ক্লাব দল গড়ায় সাবিনা খাতুন, অম্রাচিং মারমারা নিজেদের এখন পেশাদার ফুটবলারও ভাবতে পারেন। অ্যাথলেটিকস, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস বা হ্যান্ডবলের পর ফুটবলের মতো জনপ্রিয় একটা খেলায়ও মেয়েদের এই অবস্থান তৈরি হওয়াটা মহিলা ক্রীড়াঙ্গনে নতুন যুগ আনবে বলেই বিশ্বাস মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহফুজা আক্তার কিরনের, 'ফুটবল লিগ শুরু করতে পারাটা আমাদের অনেক বড় সাফল্য, সামনে আমরা কর্পোরেট লিগও করতে যাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি ইংলিশ মিডিয়ামের মেয়েদেরও ফুটবলে আনতে। স্কুল টুর্নামেন্ট করে তো ভালো সাড়া পেয়েছি আমরা।' ক্রিকেট খেলাটা এ দেশে এগিয়ে গেছে ভিন্ন এক গতিতে। মেয়েদের ক্রিকেটও এগোচ্ছে সেই ধারায়। সালমা খাতুন, সাথিরা জাকিররা এখন বোর্ডের চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়। সব মিলিয়ে একসময়ের প্যাশননির্ভর মহিলা ক্রীড়াঙ্গনটা বদলে গেছে এখন বাস্তবতার তাগিদেই।
এর সঙ্গে স্কুল টুর্নামেন্টকে খুঁটি ধরে কিরন যে আশাবাদের কথা শুনিয়েছেন সেটুকু মেলালে দারুণ সাবলীল একটা ক্রীড়াঙ্গনেরই ইঙ্গিত মেলে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, শুধু ফুটবলে বা হ্যান্ডবলেই না, স্কুল টুর্নামেন্ট গুরুত্ব পাচ্ছে এখন টেবিল টেনিস, কাবাডি, বাস্কেটবল, টেনিস এমনকি কাবাডিতেও। বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের পৃষ্ঠপোষকতায় বছরখানেক ধরেই বেশ মুখরিত কাবাডি অঙ্গন, কারণ টুর্নামেন্ট হচ্ছে নিয়মিত। এসএ গেমসের সময় পাওয়া নতুন ম্যাট, নতুন স্টেডিয়ামে প্রিমিয়ার লিগ, মহিলা লিগ, জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের পাশাপাশি এ বছর দারুণ আমেজ ছড়িয়েছে স্কুল কাবাডিও। কদিন আগেই শেষ হওয়া এ টুর্নামেন্টে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুল বা মতিঝিল আইডিয়ালের মতো সুপরিচিত স্কুলগুলো যেমন ছিল তেমনি ছিল জেবি মেমোরিয়াল একাডেমী, মানিকনগর মডেল হাই স্কুল বা আলী আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো স্বল্প পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোও। তবে লড়াই ময়দানে সবাই কিন্তু একই সমতলে। খিলগাঁওয়ের স্কুল আলী আহমদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া সুমাইয়া আলমের স্বপ্ন বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার। তাই বলে বই-খাতায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকার পাত্রী সে নয়। প্রথমবারের মতো কাবাডি খেলতে এসে তার মনে হয়েছে এর চেয়ে আনন্দের খেলা আর হয় না, 'আমি তো প্রথমে বুঝতেই পারিনি টুর্নামেন্টটা এমন মজার হবে। বান্ধবীরা খেলায় নাম দিচ্ছিল দেখে আমিও ওদের সঙ্গ নিলাম। আর এখানে এসে তো অনেক ভালো লাগছে, খেলাটা খুব মজার।'
অভিযোগ আছে এখনকার অভিভাবকরাই ছেলেমেয়েদের খেলাধুলাতে কোনো উৎসাহ দেন না। এ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ আর অভিভাবক মহলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগও শোনা গেছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু সুমাইয়ার দাবি, তার বাবা-মা কাবাডি খেলতে আসার কথা শুনে একবারও বাধা দেননি। আর ক্রীড়া শিক্ষক আবদুর রশিদের বক্তব্য, 'আসলে আমাদের স্কুলগুলোতে এখন মাঠই নেই। সেভাবে টুর্নামেন্টেরও আমন্ত্রণ আসে না কোথাও থেকে। সব কিছু মিলিয়ে শুধু মেয়েদের কেন, ছেলেদের মধ্যেও তো খেলাধুলার চর্চাটা কমে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় সবার মনের মধ্যেই খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসাটা লুকায়িত আছে ঠিকই।'
সেই ভালোবাসার জোরেই হয়তোবা নারী স্বাধীনতা বা এক অর্থে আধুনিকমনস্ক উন্নয়ন প্রয়াসবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনের মুখেও দমিয়ে রাখা যায়নি মহিলা ফুটবল। এখন এই খেলাটাই যেন পুনরুজ্জীবনের ডাক দিচ্ছে বাকিদের। রত্না-সাদিয়াদের শ্যুটিংটাকে ব্যতিক্রম ধরলে বকুল, সুলতানা কামাল, সুফিয়াদের অ্যাথলেটিকস অঙ্গনে বিউটি, চুমকিরা তো ক্ষয়ে যাওয়া যুগের প্রতিচ্ছবি; রানী হামিদে ধন্য দাবাও তো প্রত্যাশিত পথ খুঁজে পায়নি, অংশগ্রহণ আর সাদামাটা পারফরম্যান্সে একঘেয়ে সাঁতারপুলটাও_ফুটবল তাতে নতুন দিশারি হতেই পারে।

No comments

Powered by Blogger.