বিদ্যুৎ সংযোগ নিতেও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জাল! by আশরাফুল হক রাজীব

প্রধানমন্ত্রীর পর এখন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরও জাল হচ্ছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দেশের এই ভিভিআইপিদের স্বাক্ষর জাল করছেন অবাধে। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের স্বাক্ষর জাল করায় মামলাও হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জাল প্রতারণা ঠেকাতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া থেকে শুরু করে বদলি, নিয়োগ, জমির মালিকানার বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুবিধা নিতে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জাল করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র।


রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জাল করার বিষয়টি আমরা জেনেছি। এরই মধ্যে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'
জানা গেছে, গত সপ্তাহে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে সব বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জালকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির নাম ব্যবহার করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করা হচ্ছে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে_এসবের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি বা তাঁর কার্যালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের কোনো দপ্তরে রাষ্ট্রপতির নাম ব্যবহার করে কোনো সুপারিশ করা হয় না। এ বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। বঙ্গভবনের এ চিঠি পাওয়ার পরপরই সব মন্ত্রণালয় তাদের অধীনস্থ দপ্তরকে চিঠি দিয়ে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জাল করার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলায় রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জাল করায় সরকারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা রাষ্ট্রপতির আত্মীয় পরিচয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর আবেদনপত্রে রাষ্ট্রপতির সুপারিশ সংযোজন করেন। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগে যোগাযোগ করে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন। সেখান থেকে বিষয়টি মিথ্যা হিসেবে জানিয়ে আবেদনকারীর বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জাল করার মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। এ ধরনের স্বাক্ষর জালের ঘটনা আরো ঘটছে। মাঝেমধ্যেই মন্ত্রীদের স্বাক্ষর জালের ঘটনা ঘটে।'
সম্প্রতি পুলিশের এক সহকারী কমিশনার তাঁর বদলির আবেদনে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর জাল করেন। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ডিআইজি (ঢাকা) অফিসে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপতি একজন সহকারী কমিশনারকে বদলির সুপারিশ করেছেন দেখতে পেয়ে বদলির উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হলে তারাও বঙ্গভবনে যোগাযোগ করে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে তাদের জানানো হয়_এ ধরনের কোনো সুপারিশ রাষ্ট্রপতি করেননি। এরপর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
খাদ্য অধিদপ্তর, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পুলিশে লোক নিয়োগসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রায় লক্ষাধিক পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। এসব পদে নিয়োগ পেতে একটি চক্র রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী এমনকি সচিবদের স্বাক্ষর জাল করছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভুয়া সুপারিশ নিয়ে প্রতারক চক্র সরকারি কাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলাচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে এমন একটি দপ্তরের মহাপরিচালক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সুপারিশগুলো যে ভুয়া প্রাথমিকভাবে তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না। রাষ্ট্রপতির বা প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর দেখে মনে হয় কাজটি করে দেই। কিন্তু কয়েকটি স্বাক্ষর একসঙ্গে করলেই স্বাক্ষরগুলো যে ভুয়া তা বোঝা যায়।'
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে। সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে তাঁর সুপারিশ বিভিন্ন সংস্থায় পেশ করে। এর মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে তারা ফায়দা হাসিল করে নেয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী কখনোই কোনো লিখিত সুপারিশ করেন না। যদি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কোনো নির্দেশনা দিতে হয় সেটাও তিনি দেন টেলিফোনে। তবে এ ধরনের নির্দেশনা অবশ্যই দেশ ও সরকারের স্বার্থে দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করার প্রশ্নই ওঠে না। প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে মানুষকে হয়রানির অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে থাকলে ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবকে সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান। বিষয়টি সারা দেশের সরকারি অফিসে জানিয়ে দেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে জানান মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান। তিনি বলেন, 'সারা দেশে একটি চক্র গড়ে উঠেছিল যারা প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে সরকারি দপ্তরে বিভ্রান্তি ছড়াত। সাধারণ মানুষকে হয়রানি করত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নতুন কোনো অভিযোগ পাইনি।'

No comments

Powered by Blogger.