মিলন কেন দুষ্টু?ঃহুমায়ূন আহমেদ

লেখার শিরোনামের জন্য আমি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের কাছে হাত পাতি। বিরক্ত হলেও তাঁর কিছু করার নেই, তিনি যেখানে আছেন সেখান থেকে বিরক্তি প্রকাশ করা বেশ কঠিন।এবারের লেখার শিরোনামের জন্য আমি অবশ্য মূলধারার বাংলা ছায়াছবির কাছে হাত পেতেছি। আমার প্রেরণা 'বাবা কেন চাকর?' 'শান্ত কেন মাস্তান?' অর্থাৎ 'কেন' সিরিজ।মিলন দুষ্ট হওয়ার নানা চেষ্টা আমার বাংলাদেশ ছাড়ার পরপরই শুরু করেছে। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় আমাকে নিয়ে সাপ্তাহিক হাহাকার করেই যাচ্ছে।


আমি যে মহৎ এবং অতি বিরল প্রজাতির লেখক, তা মিলনের সাপ্তাহিক হাহাকারের কল্যাণে জানতে পারছি। সে আবার আমার একটা করে ইন্টারভিউ ছাপাচ্ছে। এই ইন্টারভিউ 'ডেট এক্সপায়ারি জিনিস'।
আমেরিকার প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যে ডেট অব ম্যানুফ্যাকচার ও ডেট অব এক্সপায়ারি দেওয়া থাকে। ইন্টারভিউ এক ধরনের খাদ্যদ্রব্য। পাঠক এই খাদ্য মুখ দিয়ে না খেয়ে চোখ দিয়ে খেয়ে থাকে। কাজেই এই খাদ্যদ্রব্যে ডেট অব ম্যানুফ্যাকচার ও ডেট অব এঙ্পায়ারি থাকা বাঞ্ছনীয়। আমার সব ইন্টারভিউর এক্সপায়ারি ডেট এক সপ্তাহ মাত্র। আমার মুডনির্ভর চিন্তা-ভাবনা এক সপ্তাহের মধ্যে বদলায়।
কাজেই আশা করছি, মিলন তার হাহাকার ও ইন্টারভিউ বন্ধ করবে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত লাইন আছে-
"নিজেকে করিতে গৌরব দান
নিজেকে কেবলই করি অপমান..."
লাইনটি অন্যের জন্যও প্রযোজ্য।
"অন্যে রে করিতে গৌরব দান
অন্যে রে কেবলই করি অপমান"
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক ঘনিষ্ঠজন প্রধানমন্ত্রীকে গৌরব দান করতে গিয়ে তাঁকে অনেক অপমান করেন। একটি উদাহরণ দেই। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনদের একজন বুদ্ধিমান (?) রাজনীতিবিদ এক বক্তব্যে বলেছেন, ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন শেখ হাসিনার বদান্যতায় এবং সুপারিশে।
শেখ হাসিনার এই ঘনিষ্ঠজন কে? নাম বলে বিপদে পড়তে রাজি নই। এমনিতেই ক্যান্সারনামক বিপদে আছি। তবে হিন্টস্ দিচ্ছি_
এই রাজনীতিবিদ সৈয়দ বংশের মানুষ। মাশাল্লাহ কিয়া বাত হায়।
যাই হোক, আমি গৌরবসূচক পালক (তা আমার নিজের পালক হলেও) মাথায় পরতে রাজি না। পালক হলো মেডেলের মতো। মেডেল গায়ে লাগিয়ে কেন ঘুরব? রসায়নশাস্ত্রে আমেরিকান ইউনিভার্সিটির গতরখাটা পিএইচডি ডিগ্রি আমার আছে। কখনোই এই ডিগ্রিও ব্যবহার করিনি।
মিলন! ভাই, তোমার এই লেখাগুলো আমার মৃত্যুর পরে ছাপার জন্য রেখে দাও। ঘটনা ঘটে গেলে নতুন 'ম্যাটেরিয়াল' পাওয়া কঠিন হবে। সবই তো এখন লিখে ফেলছ।
তোমার পত্রিকার পাতা ভরানোর লেখা আমি পাঠাতে শুরু করছি। 'পায়ের তলায় খড়ম'-এর নতুন কিস্তি। এখন লিখতে পারছি। এবং প্রতি সন্ধ্যায় লিখতে বসতে ইচ্ছা করছে। 'নিভিবার আগে প্রদীপ জ্বলিয়া উঠে' টাইপ কিছু কি না কে জানে!

পাদটীকা
সম্প্রতি গাজী কাশেম নামের এক প্রবাসী লেখকের একটি উপন্যাস পড়লাম। উপন্যাসটির নামকরণ করেছেন প্রয়াত কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রবন্ধকার অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ। বইটির নাম 'ও আমার আমেরিকা রে'।
বইটিতে লেখক তাঁর জীবনের অতি ভয়ংকর এক আমেরিকার দুঃস্বপ্নের ব্যক্তিগত গল্প বলেছেন। বই পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, একটি ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ছি। যে উপন্যাসে কোনো ডিটেকটিভ নেই।
বইটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত। আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, বেশির ভাগ প্রবাসী লেখকের বই কেউ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে না। দুই-তিন শ বই লেখকের টাকায় ছাপা হয়। তার প্রায় সব কপি লেখক কিনে বন্ধুবান্ধবদের উপহার দেন। বাকিগুলো উইপোকার খাদ্যের জন্য গুদামে রেখে দেওয়া হয়। উইপোকাদের তো বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে।
যাই হোক, আমি চাই বিদেশ নামের স্বপ্নের দেশে যারা আসার জন্য পাগল হয়ে থাকে, তারা যেন বইটি পড়ে।
মিলন, তোমার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কি লেখাটা ছাপবে?
বইটি এডিট করতে হবে। ভাষা ঠিকঠাক করতে হবে। শুরু ও শেষ ঠিক করতে হবে। গাজী কাশেমের গল্প এবং গল্পের বুনন এতই চমৎকার যে, কোনো কিছু ঠিকঠাক না করলেও হয়। তারপরও আমি অন্যদিন-এর মাজহারকে বলেছি, তার এডিটিং গ্রুপ থেকে কাটাকুটির কাজটা করে দিতে। সে আগ্রহের সঙ্গে রাজি হয়েছে।
গাজী কাশেমের জন্য দুঃসংবাদ। আমি যে কজন লেখককে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি, তাঁরা দ্রুত গর্তে ঢুকে গেছেন। কোমরে রশি বেঁধে টেনেও তাঁদের তোলা যায়নি।
একজীবনে যাদের 'উকিল বাপ' হয়েছি তারা সবাই ডিভোর্স নিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ তাদের কারো সঙ্গে দেখা হলে তারা কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। হায় রে কপাল!

No comments

Powered by Blogger.