ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট : উপঢৌকন ও অর্থের বিনিময়ে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক লেখার অভিযোগ by নেসার উদ্দিন আহাম্মদ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের গরিব রোগীরা কয়েকজন চিকিত্সকের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। চিকিত্সকরা রোগীর চিকিত্সাই শুরু করছেন ফোর্থ জেনারেশনের উচ্চমাত্রা অ্যান্টিবায়োটিক মেরুপেনাম ও ইমিপেনাম ইনজেকশন দিয়ে। একটি ইনজেকশনের দাম ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। ফলে রোগীরা পুরোপুরি চিকিত্সা নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বার্ন ইউনিটের চিকিত্সকরা ওষুধ কোম্পানির উপঢৌকন ও টাকার বিনিময়ে চিকিত্সার শুরুতেই এই দামি উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকগুলো লিখছেন।


এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুতেই ফোর্থ জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে রোগীদের চিকিত্সা শুরু করলে অন্য কোনো প্রতিষেধক কাজে লাগছে না। আর এই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করলে রোগীর রোগ সারানোর কোনো ওষুধ নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বার্ন ইউনিটে ৪ মাস ধরে কোনো ওষুধপথ্য সরবরাহ নেই। রোগীদের বাইরে থেকে গজ-ব্যান্ডেজ কিনে আনতে হচ্ছে।
রোগীদের দেয়া হচ্ছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক : সোমবার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অধিকাংশ রোগীর চিকিত্সাপত্রে দেয়া হয়েছে ‘মেরুপেনাম’ ‘আই-পেনাম’ নামে হাই অ্যান্টিবায়োটিক। বার্ন ইউনিটের দোতলার হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিত্সাধীন রোগী আবুল কালামের (৩০) ভাই আমার দেশ-কে জানান, গত ২০ অক্টোবর তার ভাইকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। গত তিনদিনে তার ভাইয়ের চিকিত্সায় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে, কিন্তু এখনও কোনো উন্নতি হয়নি। আবুল কালাম রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। একটি দোতলা ভবনের ছাদ পরিষ্কার করতে গিয়ে তিনি ইলেক্ট্রিক বার্নে আহত হন। তার সারা শরীর ঝলসে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার বাবার নাম ফজলুল হক মিয়া। বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানার গাউছিয়া গ্রামে। আবুল কালামের চিকিত্সা ব্যবস্থাপত্রে দেখা গেছে ‘মেরুপেনাম’ ইনজেকশন দেয়া হয়েছে ৮ ঘণ্টা পরপর।
তিনি এই ইনজেকশন কিনছেন হাজার টাকা করে। অধিকাংশ রোগীর আত্মীয়স্বজন এ অভিযোগ করলে তাদের নাম না প্রকাশ করার জন্য এ প্রতিবেদকের কাছে অনুরোধ করেন। কারণ হিসেবে জানান, চিকিত্সকের বিরুদ্ধে লেখা হলে রোগীকে দেখতে চিকিত্সকরা আসবেন না।
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে, বার্ন ইউনিটের কয়েকজন চিকিত্সক বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপঢৌকন ও অর্থ নিয়ে শুরুতেই ফোর্থ জেনারেশনের দামি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে ‘মেরুপেনাম’ ‘আই-পেনাম’ ‘সিসপেনাম’ ‘ইরোপেন’ লিখছেন। এই ওষুধগুলোর সর্বোচ্চ খুচরামূল্য হচ্ছে ১২০০ থেকে ১৩৫০ টাকা। ওষুধগুলো হাসপাতালের আশপাশের ফার্মেসি থেকে কিনতে গেলে ডিসকাউন্টে ৮০০ থেকে ৯৫০ টাকা দিয়ে আনতে পারে রোগীর স্বজনরা। কিন্তু ওই চিকিত্সকরা রোগীর স্বজনদের বলে দেন হাসপাতালে অবস্থানরত সংশ্লিষ্ট ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছ থেকে নেয়ার জন্য। তারা রোগীর কাছ থেকে ওই সর্বোচ্চ মূল্যই নিচ্ছেন। এই অ্যান্টিবায়োটিক লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিত্সকদের রুম সাজিয়ে দিচ্ছেন ওষুধ কোম্পানিগুলো। এমনকি একজন চিকিত্সককে নতুন একটি গাড়ি কিনে দেয়ার মতো অভিযোগও পাওয়া গেছে।
ফোর্থ জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক লেখার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ফার্মাকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান আমার দেশ-কে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমানে সিপ্রোফ্লুক্সাসেলিন, সেফটাজেরিন, সেফট্রিক্সন অ্যান্টিবায়োটিকগুলো শতকরা ৫০ ভাগ অকার্যকারী হয়ে পড়েছে। চিকিত্সা ক্ষেত্রে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক রিজার্ভে রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো ইমিপেনাম, মেরুপেনাম, এমিকাসিম, নেটিলমাইসিন ও ভেন্টমাইসিন। এসব অ্যান্টিবায়োটিক সচরাচর ব্যবহার না হলেও কিছু চিকিত্সক এই ওষুধগুলো প্রেসক্রাইব করছেন। যার ফলে এখান থেকেও শতকরা ১০ ভাগ রেজিস্ট্যান্ট হয়েছে বলে গবেষণায় বেরিয়ে আসে। চিকিত্সকের ভুল প্রেসক্রাইবের কারণে এই অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা বাড়ছে। শুরুতেই রিজার্ভে রাখা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে যদি অকার্যকর হয়ে যায় তাহলে রোগীকে চিকিত্সার আর কোনো অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে না।
চারমাস ধরে ওষুধপথ্য সরবরাহ বন্ধ : অভিযোগ মিলেছে, বার্ন ইউনিটে চারমাস ধরে গজ-ব্যান্ডেজসহ ওষুধপথ্য সরবরাহ নেই। রোগীদের সাধারণ গজ-ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে দামি ওষুধ পর্যন্ত সবই বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। বার্ন ইউনিট সূত্র জানায়, প্রকল্পের অনুদান বন্ধ থাকায় চারমাস ধরে ভুগতে হচ্ছে দেশের একমাত্র ঢাকা মেডিকেলে বার্ন ইউনিটের রোগীদের। ৫০ শয্যার এই বার্ন ইউনিটে প্রায় ৩০০ রোগী প্রতিনিয়ত চিকিত্সা নেন।
প্রকল্প সমন্বয়কারী বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. সামন্ত লাল সেন আমার দেশ-কে বলেন, জুনের পর থেকেই এ প্রকল্পে অনুদান বন্ধ রয়েছে। ফলে রোগীদের জন্য ওষুধ কেনা যাচ্ছে না। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গজ-ব্যান্ডেজসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু তা রোগীর প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য বললেই চলে।
বর্তমানে বার্ন ইউনিটের জনবল : বর্তমানে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জনবলের মধ্যে অর্ধেকের বেশিই ডেপুটেশনে। সূত্র জানায়, ৫০ জন চিকিত্সকের মধ্যে ডেপুটেশনে রয়েছেন ৪০ জন চিকিত্সক। ৪০ জন নার্সের মধ্যে ৩০ জন ডেপুটেশনে। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে ১০ জন ডেপুটেশনে কাজ করছে বার্ন ইউনিটে। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বার্ন ইউনিটে দেয়া হয়। তবে ৩৭ জন কর্মচারী বিনাবেতনে ৭ বছর ধরে কাজ করছে বলে জানা যায়। এছাড়া তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন একজন অফিস সহকারী, একজন রেকোর্ড কিপার, একজন ড্রাইভার, একজন মেডিকেল টেকনোলোজিস্ট, দু’জন অ্যানেসথেশিয়া টেকনেশিয়ান এবং একজন ফিজিও থেরাপিস্ট। চিকিত্সকরা বলছেন, বার্ন ইউনিট চালানোর জন্য যে জনবলের প্রয়োজন তার অর্ধেকও বর্তমানে নেই।
বেতন বন্ধ চারমাস : প্রকল্প নিয়ে জটিলতায় রোগীদের পাশাপাশি সমস্যায় পড়েছেন চিকিত্সক-কর্মচারীরাও। বার্ন ইউনিটের ১০ চিকিত্সকসহ মোট ২৪ জনের বেতন বন্ধ রয়েছে চারমাস ধরে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট প্রকল্পের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হয়েছে অনেক আগে। এটি সরকারের রাজস্ব খাতেও যায়নি, ফলে নতুন করে আবার ৫ বছরের প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। অর্থ পেলে সমস্যার সমাধান হবে।
ঢাকা মেডিকেলের পরিচালকের বক্তব্য : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল হক মল্লিক আমার দেশ-কে জানান, রোগীদের প্রথম অবস্থাতেই উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার কথা নয়। বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে বার্ন ইউনিটে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে ঢাকা মেডিকেল থেকে সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকল্পের অর্থ পেলে সমস্যা মিটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.