শুভর উড়ন্ত সূচনা by খায়রুল বাসার নির্ঝর

কয়েকদিন আগেও বেশ অসুস্থ ছিলেন আরেফিন শুভ। নতুন চলচ্চিত্রের শূটিং শুরু হবে চরিত্র আর সংলাপ নিয়ে ভাবছিলেন খুব করে। টানা একটা পরিশ্রম যাবে ভেবে শরীরটা বোধহয় বেঁকেই বসতে চেয়েছিল। কিন্তু আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠেছেন তিনি। এই ছবির মধ্যদিয়েই বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে নাম লেখাচ্ছেন শুভ।


হয়ে যাচ্ছেন নাচ-গান আর ঢিসুম-ঢিসুম এ পারদর্শী এ্যাকশন হিরো। তবে শুভর এ সূচনা মোটেও প্রচলিত ধারায় ভেসে যাওয়ার জন্য নয়, বরং পাল্টে দেয়ার শপথ নিয়েÑ বোদ্ধাদের সবারই এ রকম ধারণা। অসুস্থতার ওই সময়টায় দিনের অর্ধেক বেলায়ই তার কেটে যাচ্ছিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। এদিকে অফিস থেকে তাগাদাÑ যে করেই হোক আরেফিন শুভকে নিয়ে একটা লেখা চাই-ই। যেমন-তেমন হলে হবে না, বর্তমান আর ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা। তার জন্য একটা সাক্ষাতকার দরকার। ছবিও তুলতে হবে বেশ কয়েকটা। কারণ শুভ মানুষটা বেশ খুঁতখুঁতে ধরনের। যা-ই করেন সর্বোচ্চ যতেœর ছাপ রাখতে চান। পত্রিকায় পুরনো ছবি ছাপা হবে, এটা মোটেই তাঁর সহ্য হবে না। হাতে সময় বেশি নেই, কিন্তু সিডিউল মিলছিল না কিছুতেই। জানালেন, ৬ তারিখে পুবাইল জায়গাটা তার জন্য মোক্ষম, কিন্তু সেটা আমার জন্য মোটেই পোয়াবারো নয়। ‘আজ দু’জনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে’ গানটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, দু’জনের সময়ের ঘড়ি আসলেই দু’প্রান্তে বেঁকে গেছে। দু’দিকে ঘুরছে বিপরীতভাবে। অনেক চিন্তা মাথায় নিয়ে অগত্যা মোবাইল যন্ত্রটার ওপর শেষ ভরসা। বিকেলে মোবাইল ডিসপ্লেতে যখন আরেফিন শুভর নম্বরটি ভেসে উঠল, ভাবনা এলো হয়ত একটা কিনারা বোধহয় পাওয়াই যাবে। হলোও তাই, দীর্ঘ আলাপচারিতার মাধ্যমে যোগাড় হলো লেখার মালমসলা। শুভর ভরাট গলার কথাগুলো আবৃত্তির মতো বাজছিল কানে, অনেকের মতো নিজেরও উপলদ্ধি হলোÑ ‘এই ছেলেটা না পারলে কে পারবে বিগত ১৫ বছর ধরে ক্রমেই ধ্বংস হতে থাকা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে তার স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে দিতে?’ তবে এত বড় দায়িত্ব একা কাঁধে নিতে তিনি মোটেও রাজি নন। যুক্তি হিসেবে যে ব্যাখ্যাটা দিলেন তাতে বেশ একটা বাহবা দেয়াই যায়, ‘যে দীর্ঘ সময়টাতে বাংলা ছবি সম্পূর্ণ উল্টোদিকে চলে গেছে, ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দু’একটি ছবি দিয়ে সেটি পুষিয়ে দেয়া কখনও সম্ভব নয়। এ রকমটি আশা করাও যৌক্তিক হবে না। আগামীতে বাংলা ছবিতে দীর্ঘস্থায়ী একটা উন্নতি নিয়ে আসতে গেলে ধীরে ধীরে এগুতে হবে।’
টিভি পর্দায় অথবা র‌্যাম্পে যারা আরেফিন শুভকে দেখছেন, বিশেষ করে সুন্দরীরা ‘ফিদা’ হয়েছেন তার সুঠাম দেহের জাদুতে। দীর্ঘদেহী অথচ মানানসই চালচলনে অনেকেই ধরে নেন এ মানুষটা নিশ্চয় ইন্ডিয়ান। প্রসঙ্গ টানতেই তিনিও হেসে উঠলেন। ঝুলি থেকে অভিজ্ঞতাও ছুড়ে দিলেন একটা। মুস্তফা কামাল রাজের ‘ছায়াছবি’র ইউনিটে আরেফিন শুভ তখন কক্সবাজারে। পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে কাহিনীর সমুদ্রে উত্তাল জোয়ার। ‘দ্বিতীয় ভালবাসা’ নামে একটি গানের শূটিং চলছে। বিরতিতে বিশ্রাম নিচ্ছেন, এমন সময় একজন প্রোডাকশন বয় এসে জানাল, আশপাশে এলাকার মানুষ জড়ো হয়েছে, সবাই জিজ্ঞেস করছে, এ হিরোটা ইন্ডিয়ান কিনা? বলেই আরও এক ঝলক হেসে শুভ যোগ করলেন, এ ব্যাপারটি আমাকে খুবই ভাবিয়েছে। যারা ছবির মূল দর্শক, শুধু দূর থেকে দেখে তাদের এমন কমপ্লিমেন্ট অনেকখানিই প্রেরণা দিয়েছে আমাকে। কিছুদিন আগেই শেষ হলো এ ছবির শূটিং। বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া তরুণ প্রেমের গল্প নিয়ে নির্মিত এর কাহিনীটা আপাতদৃষ্টিতে অতি সাধারণ মনে হলেও নির্মাণ, অভিনয় আর সম্পর্কের টানাপোড়েনের জটিলতা দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে বলে মনে করছেন সবাই। কিন্তু দেশে এবং বাইরে এ রকম কাহিনী নিয়ে নাটক, চলচ্চিত্র হরমামেশাই হচ্ছে। জানতে ইচ্ছা করছিল, অভিনয়ের জন্য আরেফিন শুভ কেন এ রকম একটি সাধারণ কাহিনীর চলচ্চিত্র বেছে নিলেন? দ্বিধা কাটল তার সুচতুর উত্তর শুনে, ‘ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই আমি সবসময় চেয়েছি ভিন্ন কিছু করতে। দর্শকদের পরিপূর্ণ বিনোদন দিতে চেষ্টা করেছি, সিনেমা হলে বসে যে ছবি দেখে দর্শককে হাই তুলতে হয়, সেটা নয়, বরং সে ছবিই জনপ্রিয়তা পাবে যার কাহিনী মানুষের পরিচিত, অনেকটা বাস্তব।’ উদাহরণ হিসেবে টানলেন মনের মাঝে তুমি, হঠাৎ বৃষ্টি, মনপুরাসহ আরও একগাদা ব্যবসা সফল ছবির কথা। ‘য়ায়াছবি’তে শুভর বিপরীতে আছেন পূর্ণিমা। আরেফিন শুভ যেখানটায় শুরু করছেন, পূর্ণিমার সেখানে একচ্ছত্র সাম্র্রাজ্য। দু’জনের মাঝখানের ব্যবধানটা অনেক। একসঙ্গে কাজ করতে নানান সমস্যা থাকার কথা। ‘ছায়াছবি’র সেটেও নিশ্চয় এ রকম অনেক সমস্যা হজম করতে হয়েছে? আশা করছিলাম এ প্রশ্নের অনুকূলে কোন উত্তর, কিন্তু শুভর কণ্ঠে সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু। গলা দিয়ে ঝরে পড়ল পূর্ণিমার জন্য একগাদা স্তুতি বাক্য, তিনি যে এত সহজে মানুষকে বন্ধু করে নিতে পারেন ভাবতেই পারিনি। পূর্ণিমার মতো এত বড় পর্দার মানুষের মাটির কাছাকাছি মিশে যাওয়া দেখে যারপরনাই বিস্মিত শুভ। ফলাফল, কাজ করতে যে রকম অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল তা তো হয়নি, বরং শূটিংয়ের পুরো সময়টা অনেক আনন্দে কেটেছে। বোঝাই যাচ্ছে, ‘ছায়াছবি’ নিয়ে খুব আশাবাদী শুভ। তার সেই আশার গনগনে চুল্লিতে ঘি নাকি জল কোনটা পড়বে তা টের পাওয়ার জন্য দর্শককে অপেক্ষা করতে হবে সামনের কোরবানির ঈদ পর্যন্ত।
মূল চরিত্রে ‘ছায়াছবি’ প্রথম চলচ্চিত্র হলেও আরেফিন শুভর জন্য এটিই প্রথম সিনেমা নয়, ফুটবলকেন্দ্রিক একটি ছবিতে আগেই দেখা গেছে তাঁকে। খিজির হায়াত খানের পরিচালনায় সেটি ছিল খেলা নিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। ‘জাগো’ নামের ওই ছবিটিতে শুভ দেশের ছোট্ট একটি শহরের উঠতি ফুটবলার। আনন্দ-বেদনার কাব্য আর ভালবাসার রং করা গল্পের মাঝখানে খেলা কিভাবে জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠতে পারে সেটা আরেফিন শুভর অভিনয়ের কল্যাণে দর্শক জেনেছে অনেক আগে। জানার এখনও বাকি আছে অনেক কিছুই। প্রত্যাশাও অনেক। বিশেষ করে প্রতিবছর যে তরুণ মুখগুলো উঠে আসে, সিনেমা নাটক অথবা গানে শ্রোতা দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণের অনেক বড় একটা ভারও তাদের ওপর গিয়ে পড়ে। কিন্তু সময়ের আবর্তনে যে চাহিদায় ঘুণ পড়ে। নবাগত মুখগুলো ভেসে যায় প্রচলিত ধারার প্রবল স্রোতে। আরেফিন শুভও কি সে দলে মিশে যাবেন? সময়ের প্রতিশ্রুতি ভুলে শুধু বড় পর্দা আর গ্ল্যামারের লোভে ছাইপাশ কাহিনী গলাতে চেষ্টা করবেন দর্শকদের? এমন প্রশ্ন অনেক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সাফিউদ্দিন সাফির ‘একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ চলচ্চিত্রে নাম লেখানোর পর থেকে এ প্রশ্নগুলো আরও ঘোরালো হতে শুরু করেছিল। এ ছবিতে আছেন ঢালিউডের কিং শাকিব খান। ভয়টা ওখানেই। তবে অনেক বোদ্ধাই বলছেন, এ ছবির মাধ্যমে শাকিব মূলত প্রচলিত ধারার বাইরে আসার চেষ্টা করবেন। শাকিব খান পুবাইলে তার নিজস্ব বাড়ি ‘জান্নাত’ দিয়ে দিয়েছেন এ ছবির শূটিংয়ের জন্য। ৬ আগস্ট থেকে কাজও শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। আরেফিন ভক্তরা অনেকটা সান্ত¡না পাচ্ছেন, এ চলচ্চিত্রে থাকা আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসানের কারণে। নাম শুনে বোঝাই যাচ্ছে জমজমাট প্রেমের হবে ছবিটি। তবে এটা যে প্রচলিত ঘরানা থেকে ভিন্ন হবে এটা আঁচ করা গেল শুভর কথায়, চৌধুরী সাহেব নায়িকার বাবার বাড়িতে গিয়ে থ্রেট করছে, বিপরীতপ্রান্ত থেকেও জন্ম নিচ্ছে কঠিন কঠিন ডায়ালগ; এ রকম ছবি আর চলবে না। এখনকার সময়ের গল্প নিয়ে ছবি করলে তা অবশ্যই দর্শকপ্রিয়তা পাবে। ফেসবুক হলে এ কমেন্টটার নিচে হাজার হাজার লাইক পড়ত নিঃসন্দেহে। তবে পুরো ভার আপাতত ছেড়ে দেয়া যাক আরেফিন শুভর হাতে। মিডিয়াতে তিনি অনেকটা সময়জুড়ে আছেন এবং তার জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছেন অনেক, অবশ্যই তাঁর ভক্তদের নিরাশ করার মতো কিছু করবেন না তিনি। যদি সেটাই বিশ্বাস করেন তাহলে, দর্শক! এবার প্রস্তুতি নিতে থাকুন সিনেমা হলের অন্ধকার সিটে বসে সিটি বাজিয়ে আরেফিন শুভর জমজমাট দু’-দুটো প্রেমকাহিনী উপভোগ করার।

No comments

Powered by Blogger.