পাঠ্যবই চক্রের দাবি মেনে এবার গচ্চা এক শ’ কোটি টাকা- মিল মালিকদের সঙ্গে গোপন আঁতাত ফাঁস by বিভাষ বাড়ৈ

সেই অসাধু পাঠ্যবই সিন্ডিকেটের দাবি মেনে কাগজ ও বইয়ের আলাদা টেন্ডার করাতে গিয়ে এবার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হলো সরকার। কেবল মাধ্যমিক স্তরের সব পাঠ্যবই মুদ্রণে কাগজসহ দরপত্র (টেন্ডার) আহ্বান না করায় এবার প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)।


অন্যদিকে কাগজসহ দরপত্র আহবান করে এবতেদায়ী ও দাখিল স্তরের তিন কোটি ৬১ লাখ ৯৪ হাজার ৯২০ কপি পাঠ্যবই মুদ্রণে সরকারের সাশ্রয় হয়েছে অন্তত ৩০ কোটি টাকা। বইয়ের খরচ কমেছে ১৩ শতাংশ। বই মুদ্রণে সময় কম লেগেছে অন্তত চার মাস। সিন্ডিকেটের কবল থেকে কাগজ কেনার ঝামেলাও বন্ধ হয়েছে। এমন অবস্থায় বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে অবিলম্বে সকল বই মুদ্রণেই কাগজসহ দরপত্র আহ্বান করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও মূল পাঠ্যবই ব্যবসায়ীরা। এদিকে আগামী বছর থেকে সাধারণ শিক্ষা স্তরের সহায়ক বই বিনামূল্যে দেয়ার কাজ চললেও মাদ্রাসার দাখিল স্তরের সহায়ক বই পাওয়া এখনও অনিশ্চিত।
এদিকে বই সিন্ডিকেটের সঙ্গে কাগজ মিল মালিকদের গোপন ঐক্য প্রকাশ হয়ে গেছে কাগজের দামের তারতম্যে। কাগজ মিল মালিকরা আলাদা দরপত্রে যে যে কাগজ সরকারের কাছে বিক্রি করেছে টনপ্রতি ৮৪ হাজার টাকায়, সেই একই কাগজ বই ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছে মাত্র ৬৮ হাজার টাকায়। এ ক্ষেত্রে কেবল কাগজ ও বই ছাপার আলাদা দরপত্র দিতে গিয়ে শুধু কাগজেই সরকারকে টনপ্রতি ১৬ হাজার টাকা বেশি ঢালতে হয়েছে। যেখানে মোট বইয়ে কাগজ লাগে প্রায় ৫০ হাজার টন। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোস্তফা কামালউদ্দিন বলেছেন, কাগজসহ দরপত্র আহ্বান করলে খরচ অনেক কম হয়। কাগজ কিনে দেয়ার ঝামেলা থেকেও মুক্তি পায় সরকার। এতে করে দু’দফা দরপত্র আহ্বান করতে হয় না। নির্ধারিত সময়ে সব বই সরবরাহের ঝামেলাও থাকে না। অথচ সময় ও অর্থ অপচয় রক্ষায় সকল বই মুদ্রণে কাগজসহ দরপত্র আহ্বান করার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে নানা বাধা এসে হাজির হয়। তার পরও চলতি বছর এবতেদায়ী ও দাখিল স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণে সরকারের সাশ্রয় হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এ সময় বইয়ের খরচ কমেছে ১৩ শতাংশ। কিন্তু এখনও সাধারণ মাধ্যমিক স্তরের বইয়ে কাগজ ও বই মুদ্রণের জন্য আলাদা আলাদা দরপত্র আহ্বান করতে হচ্ছে। প্রথমে কাগজের দরপত্র আহ্বান করতে হয়। নানা প্রক্রিয়া শেষ করে সরকার প্রথমে কাগজ কিনতে পারলেও আবার বই ছাপার জন্য দরপত্র আহ্বান করতে হয়। অথচ কাগজসহ হলে দরপত্র হয় মাত্র একবার। যে কার্যাদেশ পায় সে ই কাগজ কিনে সরকারের নির্দেশনা অনুসারে বই ছাপার কাজ করে। পাঠ্যবই ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কাগজসহ দরপত্র আহ্বান করলে গড়ে প্রতি কপি বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের জন্য সরকারের সাশ্রয় হয় ৬ টাকা। এরপরও অতি মুনাফালোভী ও অসাধু মুদ্রাকরদের চাপে এবার সকল বই মুদ্রণের জন্য কাগজসহ টেন্ডার আহবান করেনি এনসিটিবি। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মাধ্যমিক স্তরের সকল বইয়ের জন্য কাগজসহ দরপত্র আহ্বান করা হবে। এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণে অর্থ অনেক সাশ্রয় হওয়ায় এবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মাধ্যমিক স্তরের সব বই মুদ্রণের জন্য কাগজসহ দরপত্র আহ্বানের। কিন্তু চড়া দামে বাজারে কাগজ সরবরাহকারী কিছু নীতিভ্রষ্ট ব্যবসায়ী এবং তাদের কাছ থেকে অনৈতিক পন্থায় কমিশন ভোগকারীদের নানা রকম হুমকি-ধমকিতে এই উদ্যোগ থেকে সরে আসে এনসিটিবি। পরবর্তীতে মাদ্রাসার এবতেদায়ী ও দাখিল স্তরের তিন কোটি ৬১ লাখ ৯৪ হাজার ৯২০ কপি পাঠ্যবই মুদ্রণের দরপত্র আহবান করা হয় কাগজসহ। এতে দেখা গেছে, ২০১২ ও ২০১১ শিক্ষাবর্ষের বই মুদ্রণের খরচের তুলনায় বইপ্রতি এনসিটিবির ছয় টাকা করে সাশ্রয় হয়েছে। অর্থাৎ এবার এসব বই ছাপতে এনসিটিবির প্রায় ৩০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
২০১৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য সাধারণ শিক্ষা বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের মোট বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে আট কোটি ৩২ লাখ ৮ হাজার ৭১৫ কপি। এসব বইয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে কাগজ ছাড়া। এনসিটিবি আলাদা দরপত্র আহ্বান করে কাগজ কিনে এসব প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও দেশী মাফিয়া চক্রের একচেটিয়া প্রভাবের কারণে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি কখনও ন্যায্য দামে কাগজ কিনতে পারেনি। পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় টনপ্রতি ২০/২৫ হাজার টাকা বেশি দিয়ে দেশী মাফিয়া চক্রের কাছ থেকে কাগজ কিনতে হয় এনসিটিবিকে। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী এবার এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে এবার কেবল মাধ্যমিক স্তরের আট কোটি ৩২ লাখ কপি পাঠ্যবই ছাপতে এনসিটিবিকে প্রায় অর্ধ শত কোটি (বইপ্রতি ৬ টাকা) টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত সময়ে সব ছাত্রছাত্রীর হাতে উন্নতমানের পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়া, ঝামেলা এড়ানো এবং সরকারের অর্থ অপচয়ের লক্ষ্যে এবার এবতেদায়ী এবং দাখিল স্তরের পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র (টেন্ডার) কাগজসহ আহ্বান করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু এতে ক্ষুব্ধ এনসিটিবিকে বেশি দামে নিম্নমানের কাগজ কিনে দেয়া কিছু বিতর্কিত নেতা, যারা এ ব্যবসা থেকে অনৈতিক কমিশন ভোগ করে থাকেন। নিজেরা কাজ না করলেও ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে কমিশন নেন অনেকে। আর এই গোষ্ঠীই কাগজসহ দরপত্র আহ্বানে সরকারকে বিভিন্নভাবে চাপ ও হুমকি দিয়ে দিনের পর দিন ফায়দা লুটছে।
অন্যদিকে সরকারের হচ্ছে কোটি কোটি টাকা অপচয়। এদিকে আগামী বছর থেকে সাধারণ শিক্ষা স্তরের সহায়ক বই বিনামূল্যে দেয়ার কাজ চললেও মাদ্রাসার দাখিল স্তরের সহায়ক বই পাওয়া এখনও অনিশ্চিত বলে জানা গেছে। কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্পন্ন এই সহায়ক গ্রামার বই বিনামূল্যে দেয়ার জন্য এনসিটিবির কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিষয়টির নিয়ে আলোচনা চলছে। শীঘ্রই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। উল্লেখ্য, চলতি বছর থেকে আরও উন্নত এবং আকর্ষণীয় হবে আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের পাঠ্য বইয়ের গুণগতমান। সকল বইয়ের মলাট হবে চার রঙের মোটা কাগজে। মাধ্যমিক ও কারিগরির স্তরের সাধারণ বইগুলো একই কভারে ছাপানো হবে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত দেশের সকল শিক্ষার্থী হাতে পাবে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই। চলতি বছর তিনটি বিষয় নতুন শিক্ষাক্রমে ছাপার পর আগামী বছর মাধ্যমিকে চালু হবে ‘পরিবেশ পরিচিতি’ ও ‘কর্মমুখী শিক্ষা’ নামে আরও দু’টি নতুন বিষয়। কেবল তাই নয়, আগামী বছর থেকে সাধারণ মধ্যমিকের সহায়ক বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজী গ্রামার বইও পাঠ্য বইয়ের মতো বিনামূল্যে বিতরণ করবে সরকার।
এনসিটিবি জানিয়েছে, প্রতিবছর পাঠ্য বই বিতরণের পর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত ১১ বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের লেখা সহায়ক বইয়ের অনুমোদন দেয় সরকার। অনুমোদনের আগে একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটি বই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকে। বইয়ের তালিকা চূড়ান্ত করে অনুমোদন দেয়া বইগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে দেয় এনসিটিবি। পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণীতে এসব বই পড়ে থাকে শিক্ষার্থীরা। ১১টি বিষয়ের বইয়ের মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার ও র‌্যাপিড রিডার। সপ্তম শ্রেণীতে বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার ও র‌্যাপিড রিডার। অষ্টম শ্রেণীতেও বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার ও র‌্যাপিড রিডার নামে সহায়ক বইয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। এ ছাড়া নবম শ্রেনীর সহায়ক বইয়ের মধ্যে আছে বাংলা ব্যাকরণ, ইংলিশ গ্রামার।

No comments

Powered by Blogger.