বাংলাদেশে নির্ধারিত সময়ে সাধারণ নির্বাচন কি হতে পারবে? by আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

টু বি অর নট টু বি? সেক্সপিয়র শাশ্বতকালের জন্য একটা প্রশ্ন রেখে গেছেন। বাংলাদেশের মানুষের মনেও বহুদিন ধরে একটা প্রশ্ন গেঁথে আছে, আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে কি হবে না? আওয়ামী লীগ সরকার যদি তাদের অবস্থানে অটল থাকেন যে, বিরোধী দল বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি তারা মানবেন না এবং বিএনপি যদি গোঁ ধরে


থাকে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবে না, তাহলে নির্বাচন হবে কি? আর নির্বাচন হলেও সেই নির্বাচন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে কি?
এত সব সংশয় সন্দেহের মধ্যে যেটুকু ভাল খবর, তাহলো, বিএনপি নাকি এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি বিকল্প ব্যবস্থার প্রস্তাব দেয়ার কথা ভাবছে? সরকার এতদিন ধরে বলে এসেছে, উচ্চ আদালতের রায়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা না থাকা এবং সংসদে তা বাতিল হওয়ার পরে বিরোধী দলের যদি অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থার প্রস্তাব দেয়ার থাকে, তাহলে তাঁরা সংসদে এসে তা দিন।
বিএনপি তাতে রাজি হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছেন, বিএনপি চাইলে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে পারে, বিএনপি তাতেও না বলেছে। তাদের দাবি ছিল, ক্ষমতাসীন দলকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে কিভাবে বিকল্প ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় তার প্রস্তাব দিতে হবে।
এখন সংবাদপত্রের খবর যদি সত্য হয় যে, বিএনপি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প ব্যবস্থায় কথা নিজেরাই ভাবছে এবং হয়ত নিজেরাই তা উত্থাপন করবে, তাহলে এটাকে গাঢ় মেঘের কোলে আশায় আলোর সামান্য ঝিলিক সম্ভবত বলা যায়।
তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র সোহেল তাজের সংসদ থেকে পদত্যাগের ফলে যে আসনটি শূন্য হয়েছে, তাঁর উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী দেবে না বলে জানা গেছে। তাতেই মনে হয়, আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা কোন বিকল্প প্রস্তাব দিক বা না দিক, তাদের মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা মেনে নেয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ তাঁরা অব্যাহত রাখতে চান। আমার ধারণা, এক্ষেত্রে তাদের কৌশলটি হবে, তাঁরা উপনির্বাচনে প্রার্থী দেবেন না; কিন্তু তাদের অঘোষিত প্রার্থী হিসেবে হান্নান শাহ বা আর কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। যদি দেখা যায় বিএনপির এই স্টকিং ধর্মটি নির্বাচনে জিতে গেছে, তাহলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে নিজেদের জয় নিশ্চিত জেনে দলটি নির্বাচনে যোগ দেয়ার পন্থা হিসেবে কিছুটা নমনীয় হয়ে নরম প্রস্তাব দেবে।
আর যদি এই অঘোষিত প্রার্থী হেরে যান, তাহলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচন-জালিয়াতির দামামা তো আবার বাজানো হবেই, সেই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অটল থাকার কথা আরও জোরে ঘোষণা করা হবে এবং জোরদার আন্দোলন দ্বারা সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করা হবে বলে দলটিতে পেপার টাইগারদের চিৎকার শুরু হয়ে যাবে। কপাল গুণে বিএনপির কখনও পেপার টাইগার বা কাগজের বাঘ সংগ্রহে অসুবিধা হয় না। এখন বিএনপির এই প্রধান পেপার টাইগার হলেন চখামিয়াপুত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম, দলের ভারবাহী মহাসচিব।
আমাকে বিএনপিরাই চেনাজানা কোন কোন বন্ধু বলেন, তাদের দলের ততটা গায়ের জোর নেই, কিন্তু গলার জোর আছে। গলার জোর দিয়ে যে গণআন্দোলন গড়ে তোলা যায় না, তার প্রমাণ এই বছরের অর্ধেকের বেশিজুড়ে বিএনপির একটার পর একটা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করা এবং তা ফ্লপ হওয়া। এখন রমজানের পর দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার কাগুজে হুঙ্কার দেয়া হচ্ছে। আন্দোলনের নামে দেশের মানুষকে আরেকটি সার্কাস হয়ত উপহার দেয়া হবে।
আমাকে আবার আওয়ামী লীগেরই শুভাকাক্সক্ষী কোন কোন বন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিচ্ছেন না? মেনে নিলে তো বিএনপির আর কিছু বলার থাকে না। আর আওয়ামী লীগ যদি বড় সিটি কর্পোরেশনগুলোর মেয়রের তাদের নির্বাচনেই পরাজয় মেনে নিতে পারে, তাহলে আসন্ন সাধারণ নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয় এবং তাতে আওয়ামী লীগের পরাজয় হয় তা মেনে নিতে আপত্তি কোথায়? অন্তত দেখত তাতে একটি অচলাবস্থা এবং তজ্জনিত অরাজকতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা থেকে বেঁচে যাবে।
আমি তাদের বলেছি, ব্যাপারটা যদি এত সরল হতো তাহলে আমরা অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ দিতাম। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি তো আওয়ামী লীগেরই এক সময়ের ব্রেইন-চাইল্ড। কিন্তু এই শিশুটিকে বিএনপি পরবর্তীকালে নিজেদের পোষ্য পক্ষে নিয়ে কিভাবে দুর্বৃত্তে পরিণত করে তার প্রমাণ আমরা লতিফুর রহমান ওরফে শান্তি মিয়ার এবং ইয়াজউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেখেছি।
মিসেস খালেদা জিয়া এখন প্রত্যেক ডুবেই মুক্তা পাবেন ভাবছেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে ইয়াজউদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো ম্যানুপুলেট করে নির্বাচনে সহজেই জয়ী হওয়ার আশা করছেন। যে ব্যবস্থাটিকে বিএনপি একাধিকবার ‘রেপ’ করতে পেয়েছে, ভবিষ্যতেও তা করতে পারবে বলে আশা করছে। ক্রিমিনাল চরিত্র সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরাধীরা একবার যে অপরাধ করে সফল হয়, তা বার বার করার জন্য উৎসাহিত হয়।
তারপরও কথা আছে। আওয়ামী লীগ সরকার মহানুভবতা দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার সংসদে পাস করে না হয় মেনে নিলেন। এর পরও যদি বিএনপি দেখে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও তাদের জেতার আশা নেই, তাহলে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা কে হবেন তা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অজুহাত খুঁজবেন। আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা হিসেবে যতো নিরপেক্ষ লোকেরই নাম প্রস্তাব করুন না কেন, তারা নিরপেক্ষ নন বলে বিএনপি চেঁচামেচি শুরু করবে।
ধরে নেয়া যাক, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের মনোপূত তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিলেন এবং নির্বাচন হলো। তারও পরিণাম কী দাঁড়াবে? যদি বিএনপি জেতে, তাহলে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ। না জিতলেই চিৎকার শুরু হবে, এ নির্বাচন কারসাজির, আমাদের জয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, এ নির্বাচনের ফল মানি না।
১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল। খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনের ফলও মানতে প্রথমে রাজি হননি। আন্তর্জাতিক চাপে পরে মানতে রাজি হয়েও নানা ছল ছুতোয় সংসদ বর্জন শুরু করেন এবং অনৈতিকভাবে সংসদের বেতনভাতা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে থাকেন। আগামী সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও যদি বিএনপি পরাজিত হয়, সেই নির্বাচনের তারা ফল মানবে না, এবারের মতো তুচ্ছ ছুতো তুলে সংসদ বর্জন করবে এবং দেশের সংসদীয় রাজনীতিকে অচল করে রাখার চেষ্টা করবে।
এক কথায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েও আওয়ামী লীগ বিএনপির তুষ্টি সাধন করতে পারবে না এবং দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সুস্থ স্বাভাবিক ও সচল করে তুলতে ব্যর্থ হবে। তাহলে এই সমস্যার সমাধান কোথায়? সমাধান আছে। মানুষ যদি কোন সমস্যার সমাধান করতে না পারে, প্রকৃতি যেমন সেই সমস্যা সমাধানের পথে এগোয়, আমার যেন মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতিও তেমন একটি প্রকৃতি নির্দিষ্ট স্বাভাবিক সমাধানের দিকে এগুচ্ছে। তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে বিএনপির দলত্যাগী প্রবীণ নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা কর্তৃক দলের নামটা একটু ভাড়িয়ে (বিএনএফ বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট) পাল্টা বিএনপি গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণে।
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা জিয়াউর রহমানের ‘আদর্শেই’ বিএনএফ গঠন করবেন বলেছেন। এটা মিসেস জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ এবং পাল্টা বিএনপি গঠনের উদ্যোগই বলা চলে। অনেকেই নাজমুল হুদার উদ্যোগ সফল হবে বলে আশা করছেন না এবং অতীতে একাধিক পাল্টা বিএনপি গঠিত হওয়ার মতো এটারও পরিণতি ঘটবে বলে মনে করছেন।
আমার হিসাবটা একটু আলাদা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি আগের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাল্টা বিএনপি গঠনের চেষ্টাটি এবার বাইরে থেকে উস্কে দেয়া হচ্ছে না, যেমন হয়েছিল এক এগারোর সময়। এবারের উদ্যোগ দলের ভেতর থেকে এবং জিয়াউর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ সহচরের প্রচেষ্টায়। জিয়াউর রহমানের অপর দু’জন ঘনিষ্ঠ সহচর এবং বিএনপির সদস্য ডা. বি. চৌধুরী এবং কর্নেল (অব) অলিও এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে মিসেস জিয়ার সঙ্গে নেই। তারা আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে বিএনপি জোটে ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে বটে, কিন্তু নাজমুল হুদা যদি পাল্টা বিএনপি গঠনে সামান্য সাফল্য দেখান তাহলে তারা এই নতুন উদ্যোগে যুক্ত হয়ে নতুন জোট গঠনেও উদ্বুদ্ধ হতে পারেন।
ইতোমধ্যেই খবর প্রকাশিত হয়েছে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রবীণ নেতাদের অনেকেই, যেমন খুলনায় আবদুর রাজ্জাক ও অন্যান্য নেতা নাজমুল হুদার সঙ্গে হাত মেলাবেন বলে সম্ভাবনা রয়েছে।
ডা. বি. চৌধুরীসহ এরা অনেকেই। তারেক রহমানের দুর্বৃত্তপনা দ্বারা অপমানিত হয়েছেন ও দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ভবিষ্যতে আবার দলে ঢুকে তারেক রহমানকে কুর্নিশ করে তাদের মতো প্রবীণ নেতাদের রাজনীতি করতে হবে, এই আশঙ্কা তাদের মন থেকে এখনও দূর হয়নি। সুতরাং সুযোগ থাকলে তারা বিএনপির রাজনীতিই করবেন, কিন্তু তারেক রহমানের নেতৃত্বে নয়, এই সম্ভাবনাটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটা প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে।
তা যদি হয় তাহলে বিএনপির ভাঙা পালে নতুন করে হাওয়া লাগবে মনে হয় না এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি ক্রেডিবল নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী দল গড়ে উঠবে। নির্বাচনকালে তারা মোর্চা গঠন করলে তাদের সঙ্গে অনেক ছোট দল স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হবে, চাই কি, ঘোমটা খুলে ড. কামাল হোসেনও তাঁর গণফোরামসহ এই জোটে শরিক হতে পারবেন। কারণ, তার সরাসরি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিতে যোগ দিতে চক্ষুলজ্জায় বাঁধবে। তাছাড়া, তারেক রহমান সম্পর্কে তার এলার্জি তো আছেই।
এটা যে ঘটবেই, তা আমি বলছি না। বলছি সম্ভাবনা আছে। যদি ঘটে তাহলে হয় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অথবা বিকল্প কোন ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হতে বাধা থাকবে না। বিএনপির আন্তর্জাতিক মুরুব্বীরাও তাতে কোন প্রকার বৈধতার প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আমার ধারণা, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে বেশি বাড়াবাড়ি করলে স্বখাত সলিলেই তাদের সমাধি হবে।

লন্ডন : ৮ আগস্ট, বুধবার ॥ ২০১২ ॥

No comments

Powered by Blogger.