সংবাদ বিশ্লেষণ- বিচারক নিয়োগে কমিশন নাকচ করা বিস্ময়কর by মিজানুর রহমান খান
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আলাদা কমিশন গঠনের প্রস্তাবকে ‘ব্যাপক বিতর্কিত’ বিষয় বলে বিস্ময়করভাবে নাকচ করে দিয়েছে আইন কমিশন। তবে আইন কমিশন প্রথমবারের মতো হাইকোর্টের আইনজীবী ও জেলা জজদের বাইরে আইনের অধ্যাপক ও গবেষকদের বিচারক নিয়োগের মতো একটি নতুন ধারণা উপস্থাপন করেছে।
ড. এম জহির ও ড. শাহ্দীন মালিক আইনের অধ্যাপকদের অন্তর্ভুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। জহির প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রেও অধ্যাপকেরা বিচারপতি হতে পারেন। বিচারপতি সৈয়দ আমীর-উল ইসলাম অবশ্য ভিন্নমত দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, আইনের অধ্যাপকদের প্রায়োগিক জ্ঞান সীমিত থাকে।
বর্তমান সরকার শুরু থেকেই কমিশন গঠনের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অধ্যাদেশ সংসদে পাস করেনি। আর এখন কমিশন বিচারক নিয়োগকে ‘নির্বাহী এখতিয়ার’ বলেছে। কিন্তু উন্নত গণতন্ত্রে বিচারক বাছাই ও নিয়োগে মৌলিক পার্থক্য করা হয়। নির্বাহী বিভাগ শুধু নিয়োগপত্রই লেখে। পরামর্শটা স্বাধীন কমিশন বা কমিটির কাছ থেকে আসে। সরকার স্বচ্ছ ও খোলাখুলি প্রক্রিয়ায় বাছাই করা ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেয়।
আইন কমিশন বলেছে, বিচারক নিয়োগে কমিশন শুধু যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানে আছে। এটি সঠিক তথ্য নয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এম শাহ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠনের বিরোধিতা করা আইন কমিশনের নীতিগত অবস্থান নয়। আমরা শুধু কমিশন গঠনের জটিলতার কারণেই সতর্কতার সঙ্গে “অন্তত বর্তমান পর্যায়ে” কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে অভিমত দিয়েছি।’ তিনি অবশ্য ‘যদি সংসদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে আমরা কমিশন গঠনকে স্বাগত জানাব’ বলেও উল্লেখ করেন।
শাহ্দীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যক্তি বাছাইয়ের জন্য একটি কমিশন বা কমিটি অত্যাবশ্যক। কারণ, সংবিধানমতে, এই ক্ষমতা বর্তমানে শুধু প্রধান বিচারপতির। গণতন্ত্রে কোনো বাছাই-প্রক্রিয়া এক বা দুজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার হতে বাধ্য। যার নজির আমরা সাম্প্রতিক কালের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় লক্ষ করি।’ ড. জহির মনে করেন, নিজেদের না শোধরালে কমিশন করেও লাভ হবে না। সেখানেও নিজেদের লোক ঢোকানো হবে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বে বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠনের ধারা বেগবান হচ্ছে। ব্রিটেন ২০০৬ সাল থেকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে জুডিশিয়াল কমিশনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল ও স্পেনের কমিশন আছে।
আইন কমিশন প্রতিবেদনে বলেছে, ‘অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ পুরোপুরি নির্বাহী ক্ষমতার অন্তর্গত।’ এও ঠিক নয়। কানাডায় ফেডারেল বিচারক বাছাইয়ে আট সদস্যের জুডিশিয়াল উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। কানাডীয় সুপ্রিম কোর্ট বিচারকদের বাছাই করে পাঁচ সদস্যের একটি সংসদীয় প্যানেল। তাদের পরামর্শে নিয়োগই রেওয়াজ হয়ে উঠেছে। ২০১১ সালে অস্ট্রেলীয় অ্যাটর্নি জেনারেল গ্রেগ স্মিথ বলেন, ‘একটি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন গঠন করা এমন একটি বিষয়, যার দিকে আমরা তাকিয়ে আছি।’ ভারতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিল লোকসভায় বিবেচনাধীন।
নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে প্রণীত দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন সংবিধানে কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। সেখানে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিচারক প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার মিডিয়ার সামনে নিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এমন রীতি ভাবতেই পারে না।
সামরিক ফরমান দিয়ে পঞ্চম সংশোধনীতে ৯৫(২) অনুচ্ছেদে গ দফা যুক্ত করে বিচারক নিয়োগে ‘অন্য শর্তাবলি’ ঠিক করতে আইন করার বিধান করা হয়। কিন্তু এটা কখনো করা হয়নি। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এটি বাতিল করা হয়েছে গণ্য করে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে এটি বাদ দিয়েছিল। ১৫তম সংশোধনীতে ‘অন্যান্য’ শব্দটি বাদ দিয়ে বিধানটি পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, দুই বছর আগে সংসদীয় কমিটির একটি পত্রের ভিত্তিতে সংবিধানের ওই বিধানের আওতায় তাঁরা এই প্রতিবেদন দিয়েছেন। তবে আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও এ নিয়ে তাঁর মৌখিক আলাপ হয়েছিল।
বিচারক নিয়োগে ১০ বিচারকের মামলায় হাইকোর্টের রায় উল্লেখ পেলেও প্রতিবেদনে আপিল বিভাগের রায়ের কথা বলা নেই। অথচ এই রায়ে বিচারক বাছাইয়ে প্রধান বিচারপতিকে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা ও এ-সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়ার লিখিত রেকর্ড রাখা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে। ওই দুটি রায়ে আইনজীবী ও জেলা জজদের ১০ বছরের অভিজ্ঞতার বিষয়ে যেসব শর্ত দেওয়া হয়, সে কথা আইন কমিশনের সুপারিশে এসেছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচাতে হলে একটি কমিশন গঠন করে বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু করাই বাঞ্ছনীয়। কমিশন গঠনে ব্যাপক বিতর্ক থাকার মন্তব্য আমাকে অবাক করেছে।’
আইনের অধ্যাপক বা নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের নিয়োগ করার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, আইনমন্ত্রীও নারাজ। শাহ্দীন মালিক তাঁর নীতিগত সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, এ বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. বোরহান উদ্দিন মনে করেন, নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের হাইকোর্টের বিচারক হওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হতে বাধ্য।
বর্তমান সরকার শুরু থেকেই কমিশন গঠনের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। তারা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অধ্যাদেশ সংসদে পাস করেনি। আর এখন কমিশন বিচারক নিয়োগকে ‘নির্বাহী এখতিয়ার’ বলেছে। কিন্তু উন্নত গণতন্ত্রে বিচারক বাছাই ও নিয়োগে মৌলিক পার্থক্য করা হয়। নির্বাহী বিভাগ শুধু নিয়োগপত্রই লেখে। পরামর্শটা স্বাধীন কমিশন বা কমিটির কাছ থেকে আসে। সরকার স্বচ্ছ ও খোলাখুলি প্রক্রিয়ায় বাছাই করা ব্যক্তিদেরই নিয়োগ দেয়।
আইন কমিশন বলেছে, বিচারক নিয়োগে কমিশন শুধু যুক্তরাজ্য ও পাকিস্তানে আছে। এটি সঠিক তথ্য নয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এম শাহ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠনের বিরোধিতা করা আইন কমিশনের নীতিগত অবস্থান নয়। আমরা শুধু কমিশন গঠনের জটিলতার কারণেই সতর্কতার সঙ্গে “অন্তত বর্তমান পর্যায়ে” কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে অভিমত দিয়েছি।’ তিনি অবশ্য ‘যদি সংসদ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে আমরা কমিশন গঠনকে স্বাগত জানাব’ বলেও উল্লেখ করেন।
শাহ্দীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যক্তি বাছাইয়ের জন্য একটি কমিশন বা কমিটি অত্যাবশ্যক। কারণ, সংবিধানমতে, এই ক্ষমতা বর্তমানে শুধু প্রধান বিচারপতির। গণতন্ত্রে কোনো বাছাই-প্রক্রিয়া এক বা দুজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার হতে বাধ্য। যার নজির আমরা সাম্প্রতিক কালের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় লক্ষ করি।’ ড. জহির মনে করেন, নিজেদের না শোধরালে কমিশন করেও লাভ হবে না। সেখানেও নিজেদের লোক ঢোকানো হবে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বে বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠনের ধারা বেগবান হচ্ছে। ব্রিটেন ২০০৬ সাল থেকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে জুডিশিয়াল কমিশনের মাধ্যমে বিচারক নিয়োগ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল ও স্পেনের কমিশন আছে।
আইন কমিশন প্রতিবেদনে বলেছে, ‘অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় বিচার বিভাগীয় নিয়োগ পুরোপুরি নির্বাহী ক্ষমতার অন্তর্গত।’ এও ঠিক নয়। কানাডায় ফেডারেল বিচারক বাছাইয়ে আট সদস্যের জুডিশিয়াল উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। কানাডীয় সুপ্রিম কোর্ট বিচারকদের বাছাই করে পাঁচ সদস্যের একটি সংসদীয় প্যানেল। তাদের পরামর্শে নিয়োগই রেওয়াজ হয়ে উঠেছে। ২০১১ সালে অস্ট্রেলীয় অ্যাটর্নি জেনারেল গ্রেগ স্মিথ বলেন, ‘একটি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন গঠন করা এমন একটি বিষয়, যার দিকে আমরা তাকিয়ে আছি।’ ভারতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিল লোকসভায় বিবেচনাধীন।
নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে প্রণীত দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন সংবিধানে কমিশন গঠনের বিধান করা হয়। সেখানে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিচারক প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার মিডিয়ার সামনে নিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ এমন রীতি ভাবতেই পারে না।
সামরিক ফরমান দিয়ে পঞ্চম সংশোধনীতে ৯৫(২) অনুচ্ছেদে গ দফা যুক্ত করে বিচারক নিয়োগে ‘অন্য শর্তাবলি’ ঠিক করতে আইন করার বিধান করা হয়। কিন্তু এটা কখনো করা হয়নি। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এটি বাতিল করা হয়েছে গণ্য করে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে এটি বাদ দিয়েছিল। ১৫তম সংশোধনীতে ‘অন্যান্য’ শব্দটি বাদ দিয়ে বিধানটি পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, দুই বছর আগে সংসদীয় কমিটির একটি পত্রের ভিত্তিতে সংবিধানের ওই বিধানের আওতায় তাঁরা এই প্রতিবেদন দিয়েছেন। তবে আইনমন্ত্রীর সঙ্গেও এ নিয়ে তাঁর মৌখিক আলাপ হয়েছিল।
বিচারক নিয়োগে ১০ বিচারকের মামলায় হাইকোর্টের রায় উল্লেখ পেলেও প্রতিবেদনে আপিল বিভাগের রায়ের কথা বলা নেই। অথচ এই রায়ে বিচারক বাছাইয়ে প্রধান বিচারপতিকে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা ও এ-সংক্রান্ত পুরো প্রক্রিয়ার লিখিত রেকর্ড রাখা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে। ওই দুটি রায়ে আইনজীবী ও জেলা জজদের ১০ বছরের অভিজ্ঞতার বিষয়ে যেসব শর্ত দেওয়া হয়, সে কথা আইন কমিশনের সুপারিশে এসেছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচাতে হলে একটি কমিশন গঠন করে বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু করাই বাঞ্ছনীয়। কমিশন গঠনে ব্যাপক বিতর্ক থাকার মন্তব্য আমাকে অবাক করেছে।’
আইনের অধ্যাপক বা নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের নিয়োগ করার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, আইনমন্ত্রীও নারাজ। শাহ্দীন মালিক তাঁর নীতিগত সমর্থন ব্যক্ত করে বলেন, এ বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. বোরহান উদ্দিন মনে করেন, নিম্ন আদালতের আইনজীবীদের হাইকোর্টের বিচারক হওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হতে বাধ্য।
No comments