রাজনীতি- নির্বাচন না হয় হবে, প্রার্থী হবেন কারা? by এ কে এম জাকারিয়া
তত্ত্বাবধায়ক, না অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন—এ নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্ক এখন শুরু হয়েছে, তার সুরাহা শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদেরাই করবেন, সেটাই সবার আশা। তবে রাজনীতিবিদেরা এ ব্যাপারে একমত না হলে ভিন্ন যে পথেই হোক, তার কোনো না কোনো সমাধান যে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে, সেটাকেও নিশ্চিত বলে মানেন অনেকে।
অভিজ্ঞতাই অনেককে এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। তবে নির্বাচনের যেহেতু এখনো বছর দেড়েক সময় আছে, তাই আমাদের মতো সাধারণ জনগণের এ নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলছে। কিন্তু যদি আমরা মেনে নিই, যেভাবেই হোক একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ বের হবে—তাহলে কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের, মানে জনগণের এখনই চিন্তাভাবনা শুরু করা দরকার। ভাবনাটি হচ্ছে, নির্বাচন না হয় হবে, কিন্তু এই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন কারা? আমরা আগামী নির্বাচনে কাদের ভোট দেব?
‘এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে, যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানেন। তাঁদের “এ” কিংবা “বি”-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুও হবে না, নিরপেক্ষও হবে না।’ এই মন্তব্য ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের (পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া, ২০০৩)। ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে এখন তত্ত্বাবধায়ক না অন্তর্বর্তী—এর সুরাহাই সবচেয়ে জরুরি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রার্থীদের ইতিহাস বা তাঁদের সম্পর্কে তথ্য জানা যে জনগণের জন্য জরুরি—সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর বিচার-বিবেচনার মধ্যে আগেও কখনো ছিল না, সামনে থাকবে—এমন আশা করাও কঠিন।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় আদালতের এ ধরনের একাধিক রায় বিবেচনায় নিয়ে জনগণের জানার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। খুব সহজে বিষয়টি হয়েছে, তা নয়। এ জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই দাবির পক্ষে নাগরিক সমাজ পালন করেছে এক সক্রিয় ভূমিকা। এসব কিছুর ধারাবাহিকতায় ‘আব্দুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায়ে ২৪ মে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী থেকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আট ধরনের তথ্য হলফনামা আকারে সংগ্রহ এবং এগুলো গণমাধ্যমের সহায়তায় জনগণের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। এ তথ্যগুলোর মধ্যে সনদসহ শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা ফৌজদারি মামলার ইতিহাস, নিজের ও পোষ্যদের আয়ের উৎস, সম্পদ, দায়-দেনা থেকে ঋণ—সবই হলফনামা আকারে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জনগণের মধ্যে তেমনভাবে প্রচার করা না গেলেও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আমাদের যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সেখানে প্রার্থীরা হলফনামা আকারে এ তথ্যগুলো দিয়েছেন। এ তথ্যগুলো নিয়ে বদিউল আলম মজুমদারের সম্পাদনায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮, অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি শিরোনামে একটি বই বের হয়েছে। প্রথমা প্রকাশনী ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) যৌথভাবে এ বইটি প্রকাশ করেছে। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এক হাজার ৫৬৬ জন। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত নোয়াখালী-১ আসন, ১২টি উপনির্বাচন (দুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন) ও সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনের প্রার্থীসহ মোট এক হাজার ৬৫৩ জনের তথ্য আছে প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এ বইয়ে।
বইটিতে এক মুখবন্ধ লিখেছেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে কিংবদন্তিতে রয়েছে: রাজা গোপাল ও সুলতান হোসেন শাহ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে দুটি স্বর্ণযুগের সূত্রপাত করেন।’ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে যে ‘স্বর্ণযুগের’ একটা সম্পর্ক রয়েছে, সেটাই শুরুতে পরিষ্কার করেছেন তিনি। তবে স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটাতে কাদের নির্বাচিত করতে হবে, সেটা জনগণের জানা থাকতে হবে। মুখবন্ধটি তিনি শেষ করেছেন এভাবে, ‘বাংলাদেশ অতীতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সাধারণভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে আগামী নির্বাচন সমস্যাপূর্ণ হতে পারে—এই উদ্বেগের অবসান হওয়া উচিত। একই সঙ্গে মানুষকে জানাতে হবে ভোটের শক্তি ও মহিমা কী। আমাদের জানতে হবে, কার পক্ষে কিসের ভিত্তিতে এবং কেন আমরা ভোট দেব। নির্বাচিত ব্যক্তির অপকার করার ক্ষমতা অশেষ।’
নির্বাচিত ব্যক্তিরা একদিকে যেমন দেশে ‘স্বর্ণযুগের সূচনা’ করাতে পারেন, আবার তাঁদের ‘অপকার’ করার ক্ষমতাও অশেষ। আগামী নির্বাচনে আমরা কাকে ভোট দেব, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় নিশ্চয়ই এসে গেছে। এই বই এ ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, যে এক হাজার ৬৫৩ জন প্রার্থীর তালিকা এ বইয়ে রয়েছে, তাঁদের একটি বড় অংশই আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য দলগুলোর মনোনয়ন চাইবেন। হলফ করে দেওয়া প্রার্থীদের এ তথ্যগুলো যদি এখন থেকেই এলাকায় প্রচার করা যায়, তবে জনগণ তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীকে আগে থেকে যাচাই করার সুযোগ পাবে। এ বইয়ের তথ্যগুলো ধরে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে গবেষণা হতে পারে। হলফনামায় দেওয়া তথ্যগুলো কতটুকু সত্য, তা যাচাই-বাছাই শুরু করে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, এ তথ্যগুলো দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও নির্বাচন কমিশন তা যাচাই-বাছাই করে দেখে না। নির্বাচনে যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁরা হলফনামায় সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাঁদের ও তাঁদের পরিবারে সম্পত্তি ও ব্যবসা কতটুকু বেড়েছে, নতুন কয়টা ফ্ল্যাট হয়েছে—এসব নিয়ে অনুসন্ধান হতে পারে। পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যম এ ব্যাপারে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আসন ধরে প্রার্থীদের নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে যে কাজটি হবে তা হচ্ছে, জনগণ সচেতন হতে পারবে। আগামী নির্বাচনে ভোটটি যাতে সঠিক প্রার্থীর বাক্সে পড়ে, সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হতে পারেন, সে পরিস্থিতি তৈরি হবে। যাঁরা আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, তাঁরাও তাঁদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর হলফ করে দেওয়া তথ্যগুলো যাচাই করে দেখতে পারবেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কোনো তথ্য মিথ্যা হলে, সেটাকে তিনি কাজে লাগাতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনে শুরুতেই নালিশ করতে পারবেন।
এখন গণমাধ্যম না হয় প্রার্থীদের তথ্য প্রচার করে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করল, নাগরিক সমাজ ও সুজনের মতো সংগঠনগুলোও না হয় এ নিয়ে মাঠে নামল, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কি এ নিয়ে কিছু করার নেই! হলফ করে দেওয়া তথ্যগুলো গ্রহণ করাই কি নির্বাচন কমিশনের কাজ? বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের দেওয়া তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করতে কোনো উদ্যোগ নেয় না। এ নিয়ে কথা বলেছিলাম সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন তখন আমরা কমিশন শুধু করদাতা প্রার্থীদের দেওয়া সম্পদের হিসাব ও বিবরণী যাচাই করতে জাতীয় রাজস্ব বিভাগের সাহায্য নিয়েছিলাম। কিন্তু হলফ করে কোনো প্রার্থী অসত্য তথ্য দিলে এবং সে প্রার্থী নির্বাচিত হলে তাঁর বিহিত কী হবে? এর কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় আগের নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে এ ব্যাপারে একটি নতুন ধারা (৯১ এফ) সংযোজনের প্রস্তাব করেছে। এই ধারার মূল বিষয়টি হচ্ছে কোনো প্রার্থী হলফনামার আকারে কোনো অসত্য তথ্য দিলে এবং পরবর্তীকালে তা প্রমাণিত হলে, তিনি নির্বাচনের অযোগ্য ও সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ফলে প্রস্তাবিত ধারা গ্রহণ করা হলে কেউ হলফ করে অসত্য তথ্য দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও পরে নির্বাচন কমিশনের তদন্তে তা প্রমাণিত হলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে পারবে। এই বিধানটি খুবই যৌক্তিক। কারণ, হলফ করে অসত্য তথ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য। এখন যিনি প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য এবং সেটা যদি নির্বাচনের আগে প্রমাণ করা না যায়, তবে তিনি নির্বাচিত হলেও সংসদ সদস্য থাকার অযোগ্য হবেন—এটাই যুক্তিযুক্ত। বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগের নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের অনেক প্রস্তাবই গ্রহণ করতে কেন অনাগ্রহী, সেটা সত্যিই বিস্ময়ের।
‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্রে এবং উপহাসে বা প্রহসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি। বিভ্রান্তিকর তথ্য, ভুল তথ্য, তথ্যের অনুপস্থিতি—এসবই নাগরিকের অসচেতনতার জন্য দায়ী, যার কারণে গণতন্ত্র গুন্ডাতন্ত্র ও প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য।’ প্রার্থীদের ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার বিষয়টি গণতন্ত্রের জন্য কতটা জরুরি তা এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন ভারতীয় আদালত। প্রার্থীদের তথ্যগুলো ভোটারদের যেমন জানাতে হবে, তেমনি ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য, ভুল তথ্য, তথ্যের অনুপস্থিতি’ ঘটলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়টি এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া জরুরি।
গণতন্ত্র আমাদের লাগবেই, এর কোনো ভালো বিকল্পের উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। আমরা গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র হিসেবেই পেতে চাই, এটা যাতে ‘গুন্ডাতন্ত্রে এবং উপহাসে বা প্রহসনে’ পরিণত হতে না পারে, তাই প্রার্থীদের সম্পর্কে জেনেই আমাদের ভোট দিতে হবে। আমরা চাই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা রাজা গোপাল ও সুলতান হোসেন শাহের মতো ‘স্বর্ণযুগের সূত্রপাত’ করবেন। এলাকা ধরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্য, তাঁদের অতীত ইতিহাস—এসব নিয়ে এখন থেকেই সামাজিক ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে কাজ শুরু করে দিতে হবে। এখন থেকে নড়াচড়া শুরু হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। প্রার্থীর টাকা ও পেশির জোর থাকলে বা দলকে টাকা দিলেই মনোনয়ন দেওয়ার যে সংস্কৃতি চলে আসছে, তা অনেকটাই ধাক্কা খাবে। ‘নির্বাচিত লোকের অনিষ্ট করার ক্ষমতা অসীম’—এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমাদের অতীতে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আমরা কাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করব—আমাদের কাছে এখন এটাই হওয়া উচিত সবচেয়ে জরুরি বিবেচনা।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
‘এ কথা সত্য যে রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তবে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে, যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভোটাররা না জানেন। তাঁদের “এ” কিংবা “বি”-এর পক্ষে ভোট দেওয়ার কোনো ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের নির্বাচন সুষ্ঠুও হবে না, নিরপেক্ষও হবে না।’ এই মন্তব্য ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের (পিইউসিএল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া, ২০০৩)। ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কাছে এখন তত্ত্বাবধায়ক না অন্তর্বর্তী—এর সুরাহাই সবচেয়ে জরুরি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রার্থীদের ইতিহাস বা তাঁদের সম্পর্কে তথ্য জানা যে জনগণের জন্য জরুরি—সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর বিচার-বিবেচনার মধ্যে আগেও কখনো ছিল না, সামনে থাকবে—এমন আশা করাও কঠিন।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় আদালতের এ ধরনের একাধিক রায় বিবেচনায় নিয়ে জনগণের জানার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। খুব সহজে বিষয়টি হয়েছে, তা নয়। এ জন্য অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই দাবির পক্ষে নাগরিক সমাজ পালন করেছে এক সক্রিয় ভূমিকা। এসব কিছুর ধারাবাহিকতায় ‘আব্দুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ’ মামলার রায়ে ২৪ মে ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী থেকে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আট ধরনের তথ্য হলফনামা আকারে সংগ্রহ এবং এগুলো গণমাধ্যমের সহায়তায় জনগণের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। এ তথ্যগুলোর মধ্যে সনদসহ শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা ফৌজদারি মামলার ইতিহাস, নিজের ও পোষ্যদের আয়ের উৎস, সম্পদ, দায়-দেনা থেকে ঋণ—সবই হলফনামা আকারে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জনগণের মধ্যে তেমনভাবে প্রচার করা না গেলেও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আমাদের যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সেখানে প্রার্থীরা হলফনামা আকারে এ তথ্যগুলো দিয়েছেন। এ তথ্যগুলো নিয়ে বদিউল আলম মজুমদারের সম্পাদনায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮, অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি শিরোনামে একটি বই বের হয়েছে। প্রথমা প্রকাশনী ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) যৌথভাবে এ বইটি প্রকাশ করেছে। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে ২৯৯টি আসনে নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে চূড়ান্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এক হাজার ৫৬৬ জন। পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত নোয়াখালী-১ আসন, ১২টি উপনির্বাচন (দুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন) ও সংরক্ষিত ৫০টি নারী আসনের প্রার্থীসহ মোট এক হাজার ৬৫৩ জনের তথ্য আছে প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এ বইয়ে।
বইটিতে এক মুখবন্ধ লিখেছেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। শুরুতেই তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে কিংবদন্তিতে রয়েছে: রাজা গোপাল ও সুলতান হোসেন শাহ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে দুটি স্বর্ণযুগের সূত্রপাত করেন।’ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে যে ‘স্বর্ণযুগের’ একটা সম্পর্ক রয়েছে, সেটাই শুরুতে পরিষ্কার করেছেন তিনি। তবে স্বর্ণযুগের সূচনা ঘটাতে কাদের নির্বাচিত করতে হবে, সেটা জনগণের জানা থাকতে হবে। মুখবন্ধটি তিনি শেষ করেছেন এভাবে, ‘বাংলাদেশ অতীতে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সাধারণভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে আগামী নির্বাচন সমস্যাপূর্ণ হতে পারে—এই উদ্বেগের অবসান হওয়া উচিত। একই সঙ্গে মানুষকে জানাতে হবে ভোটের শক্তি ও মহিমা কী। আমাদের জানতে হবে, কার পক্ষে কিসের ভিত্তিতে এবং কেন আমরা ভোট দেব। নির্বাচিত ব্যক্তির অপকার করার ক্ষমতা অশেষ।’
নির্বাচিত ব্যক্তিরা একদিকে যেমন দেশে ‘স্বর্ণযুগের সূচনা’ করাতে পারেন, আবার তাঁদের ‘অপকার’ করার ক্ষমতাও অশেষ। আগামী নির্বাচনে আমরা কাকে ভোট দেব, সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় নিশ্চয়ই এসে গেছে। এই বই এ ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করতে পারে। এটা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, যে এক হাজার ৬৫৩ জন প্রার্থীর তালিকা এ বইয়ে রয়েছে, তাঁদের একটি বড় অংশই আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য দলগুলোর মনোনয়ন চাইবেন। হলফ করে দেওয়া প্রার্থীদের এ তথ্যগুলো যদি এখন থেকেই এলাকায় প্রচার করা যায়, তবে জনগণ তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীকে আগে থেকে যাচাই করার সুযোগ পাবে। এ বইয়ের তথ্যগুলো ধরে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে গবেষণা হতে পারে। হলফনামায় দেওয়া তথ্যগুলো কতটুকু সত্য, তা যাচাই-বাছাই শুরু করে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, এ তথ্যগুলো দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও নির্বাচন কমিশন তা যাচাই-বাছাই করে দেখে না। নির্বাচনে যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁরা হলফনামায় সম্পদের যে হিসাব দিয়েছেন, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তাঁদের ও তাঁদের পরিবারে সম্পত্তি ও ব্যবসা কতটুকু বেড়েছে, নতুন কয়টা ফ্ল্যাট হয়েছে—এসব নিয়ে অনুসন্ধান হতে পারে। পত্রপত্রিকা বা গণমাধ্যম এ ব্যাপারে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। আসন ধরে প্রার্থীদের নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে যে কাজটি হবে তা হচ্ছে, জনগণ সচেতন হতে পারবে। আগামী নির্বাচনে ভোটটি যাতে সঠিক প্রার্থীর বাক্সে পড়ে, সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হতে পারেন, সে পরিস্থিতি তৈরি হবে। যাঁরা আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, তাঁরাও তাঁদের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর হলফ করে দেওয়া তথ্যগুলো যাচাই করে দেখতে পারবেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কোনো তথ্য মিথ্যা হলে, সেটাকে তিনি কাজে লাগাতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনে শুরুতেই নালিশ করতে পারবেন।
এখন গণমাধ্যম না হয় প্রার্থীদের তথ্য প্রচার করে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করল, নাগরিক সমাজ ও সুজনের মতো সংগঠনগুলোও না হয় এ নিয়ে মাঠে নামল, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কি এ নিয়ে কিছু করার নেই! হলফ করে দেওয়া তথ্যগুলো গ্রহণ করাই কি নির্বাচন কমিশনের কাজ? বর্তমান অবস্থায় নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের দেওয়া তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাই করতে কোনো উদ্যোগ নেয় না। এ নিয়ে কথা বলেছিলাম সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন তখন আমরা কমিশন শুধু করদাতা প্রার্থীদের দেওয়া সম্পদের হিসাব ও বিবরণী যাচাই করতে জাতীয় রাজস্ব বিভাগের সাহায্য নিয়েছিলাম। কিন্তু হলফ করে কোনো প্রার্থী অসত্য তথ্য দিলে এবং সে প্রার্থী নির্বাচিত হলে তাঁর বিহিত কী হবে? এর কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান না থাকায় আগের নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে এ ব্যাপারে একটি নতুন ধারা (৯১ এফ) সংযোজনের প্রস্তাব করেছে। এই ধারার মূল বিষয়টি হচ্ছে কোনো প্রার্থী হলফনামার আকারে কোনো অসত্য তথ্য দিলে এবং পরবর্তীকালে তা প্রমাণিত হলে, তিনি নির্বাচনের অযোগ্য ও সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ফলে প্রস্তাবিত ধারা গ্রহণ করা হলে কেউ হলফ করে অসত্য তথ্য দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও পরে নির্বাচন কমিশনের তদন্তে তা প্রমাণিত হলে তাঁর সংসদ সদস্যপদ নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে পারবে। এই বিধানটি খুবই যৌক্তিক। কারণ, হলফ করে অসত্য তথ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য। এখন যিনি প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য এবং সেটা যদি নির্বাচনের আগে প্রমাণ করা না যায়, তবে তিনি নির্বাচিত হলেও সংসদ সদস্য থাকার অযোগ্য হবেন—এটাই যুক্তিযুক্ত। বর্তমান নির্বাচন কমিশন আগের নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের অনেক প্রস্তাবই গ্রহণ করতে কেন অনাগ্রহী, সেটা সত্যিই বিস্ময়ের।
‘গণতন্ত্র যাতে গুন্ডাতন্ত্রে এবং উপহাসে বা প্রহসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভোটারদের তথ্য পাওয়া জরুরি। বিভ্রান্তিকর তথ্য, ভুল তথ্য, তথ্যের অনুপস্থিতি—এসবই নাগরিকের অসচেতনতার জন্য দায়ী, যার কারণে গণতন্ত্র গুন্ডাতন্ত্র ও প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য।’ প্রার্থীদের ব্যাপারে তথ্য পাওয়ার বিষয়টি গণতন্ত্রের জন্য কতটা জরুরি তা এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন ভারতীয় আদালত। প্রার্থীদের তথ্যগুলো ভোটারদের যেমন জানাতে হবে, তেমনি ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য, ভুল তথ্য, তথ্যের অনুপস্থিতি’ ঘটলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে বিষয়টি এখন আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া জরুরি।
গণতন্ত্র আমাদের লাগবেই, এর কোনো ভালো বিকল্পের উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। আমরা গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র হিসেবেই পেতে চাই, এটা যাতে ‘গুন্ডাতন্ত্রে এবং উপহাসে বা প্রহসনে’ পরিণত হতে না পারে, তাই প্রার্থীদের সম্পর্কে জেনেই আমাদের ভোট দিতে হবে। আমরা চাই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা রাজা গোপাল ও সুলতান হোসেন শাহের মতো ‘স্বর্ণযুগের সূত্রপাত’ করবেন। এলাকা ধরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্য, তাঁদের অতীত ইতিহাস—এসব নিয়ে এখন থেকেই সামাজিক ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে কাজ শুরু করে দিতে হবে। এখন থেকে নড়াচড়া শুরু হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ বাড়বে। প্রার্থীর টাকা ও পেশির জোর থাকলে বা দলকে টাকা দিলেই মনোনয়ন দেওয়ার যে সংস্কৃতি চলে আসছে, তা অনেকটাই ধাক্কা খাবে। ‘নির্বাচিত লোকের অনিষ্ট করার ক্ষমতা অসীম’—এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আমাদের অতীতে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আমরা কাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করব—আমাদের কাছে এখন এটাই হওয়া উচিত সবচেয়ে জরুরি বিবেচনা।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments