বিশেষ সাক্ষাৎকার : কাজী ফিরোজ রশীদ-আগামী নির্বাচনে পদ্মা সেতুর প্রভাব পড়বে
প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী দল। সংকট নিরসনে সংলাপ অনুষ্ঠানের তাগিদ সব দিক থেকে। দেশের রাজনীতির নানা দিক নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব
কালের কণ্ঠ : সাড়ে তিন বছর পার করল মহাজোট সরকার। জাতীয় পার্টি এই মহাজোটের শরিক। সরকারের এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কাজী ফিরোজ রশীদ : সাড়ে তিন বছরে মহাজোট সরকারের যেমন অনেক ভালো অর্জন আছে, ব্যর্থতার পাল্লা তার চেয়েও অনেক বেশি ভারী। মানুষের মনে অসন্তোষের শেষ নেই। গণতন্ত্রে জনগণের রায়ই শেষ কথা। জনগণ আজ সরকারের প্রায় সব কাজেরই সমালোচনা করছে। কোনো সরকারই কখনো নিজের ব্যর্থতা উপলব্ধি করতে পারে না- এটাই সরকারের ট্র্যাজেডি।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
কাজী ফিরোজ রশীদ : প্রতিদিন বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট বেহাল, তীব্র যানজট, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সংকটে নগরবাসী অতিষ্ঠ। সরকার কঠোর মনিটর করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সরকারের সামনে অনেক পথ খোলা ছিল। টিসিবি এ ক্ষেত্রে হতে পারত সরকারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। একটি বিকল্প বাজার ব্যবস্থা টিসিবির মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারত সরকার। সুযোগ্ ছিল। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগানো হয়নি।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
কাজী ফিরোজ রশীদ : সরকারের ভেতরের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা এরই মধ্যে অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। যাঁরা কোনো দিন আওয়ামী লীগ করেননি, 'জয় বাংলা' স্লোগান দেননি; এমনকি বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করেননি, তাঁরাই মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। প্রতিনিয়ত যারা বঙ্গবন্ধুকে কুরুচিপূর্ণ গালমন্দ করেছে, আজ তারা বড় আওয়ামী লীগার সেজেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এমন অনেকেরই দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয় মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে বা হচ্ছে?
কাজী ফিরোজ রশীদ : সবার নয়, কিছু কিছু মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাই যায়। এর পাশাপাশি আছে দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নও। অযোগ্য-ব্যর্থ ও দুর্নীতিবাজ অনেক মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হচ্ছে। এ জন্য সরকারকে মূল্য দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সফল না ব্যর্থ? যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে ব্যর্থতার সূচকগুলো কী?
কাজী ফিরোজ রশীদ : সরকারের ব্যর্থতার দিকেই জনগণের চোখ বেশি থাকে। তার পরও বলব, তথ্যপ্রযুক্তি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তুলনামূলক সাফল্য দেখিয়েছে।
পক্ষান্তরে শেয়ার কেলেঙ্কারি, দ্রব্যমূল্যের বেপরোয়া ঊর্ধ্বগতি, পদ্মা সেতু করতে না পারা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় নিয়ন্ত্রণহীন মাদক ব্যবসা, খাদ্যে বিষ মিশিয়ে তিলে তিলে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, সাংবাদিক নির্যাতন, সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হওয়া- এসবই সরকারের ব্যর্থতা। সাড়ে তিন বছরে সরকারও ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করেনি। শুরু থেকেই কাজটি করলে আজ সরকারের সাফল্যের অনেক কিছুই চোখে পড়ত।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে? সেই দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন কোথায়? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় বিএনপি কি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে?
কাজী ফিরোজ রশীদ : বিগত সাড়ে তিন বছরে বিএনপি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। শেয়ার কেলেঙ্কারি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যা, সাংবাদিক নির্যাতন, সাগর-রুনি হত্যাসহ জাতীয় কোনো ইস্যু নিয়ে বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। শুধু নিজেদের রক্ষায় তারা ব্যস্ত। এর প্রধান কারণ বিএনপির বেশির ভাগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী দুর্নীতির মামলায় জর্জরিত। তাই তাঁরা কোনো আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। মনে হচ্ছে, আন্দোলনের নামে বিএনপি সরকারের সঙ্গে কানামাছি খেলছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা যথার্থ কি না, সেটা জনগণই বিচার করবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?
কাজী ফিরোজ রশিদ : বিরোধী দলের সংসদ বর্জন নতুন কিছু নয়। যারা যখন বিরোধী দলে থাকে, তারাই সংসদ বর্জন করে। এটা এখন গণতন্ত্রের নিয়মে পরিণত হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কি যথার্থ?
কাজী ফিরোজ রশীদ : আমি মনে করি, জাতীয় পার্টি মহাজোটের প্রধান শরিক দল হিসেবে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এর অনেক কারণ আছে। নতুন করে সেসব কথা আর বলার প্রয়োজন নেই। জাতীয় পার্টির তৃণমূল থেকে শুরু করে দলীয় কোনো নেতা-কর্মী সরকারের কোনো ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নেবেন না।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। এই জোট দেশের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করেন আপনি? এই জোট কি মহাজোটের জন্য হুমকি হতে পারে?
কাজী ফিরোজ রশিদ : বিরোধী দল আজও জনগণের কোনো ইস্যু নিয়ে রাজপথে নামতে পারেনি। শীর্ষ নেতারা টিভি পর্দা ও টক শোতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তাই সরকার বিরোধী দলকে আমলে নিচ্ছে না। বিএনপি কিছু নামসর্বস্ব জনবিচ্ছিন্ন দুর্বল দল নিয়ে বিশাল সংখ্যার জোট গঠন করলেও রাজপথে তাদের দেখা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
কালের কণ্ঠ : রোজার পর আন্দোলন নতুন এক মাত্রা নিতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বিরোধী দল আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে আন্দোলনে জনগণের কতটুকু সমর্থন থাকবে বলে মনে করেন আপনি?
কাজী ফিরোজ রশিদ : ঈদের পর বিএনপির পক্ষে নতুন আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা খুবই কঠিন হবে। কারণ জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল কিছুই করেনি। এরা সবাই ক্ষমতায় এসে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। যাদের কোনো দিন টিআইএন নম্বর ছিল না- তারা রাতারাতি ব্যাংক-বীমার মালিক হয়ে বসেছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তাই রাজনীতি তার সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচার প্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
কাজী ফিরোজ রশিদ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবার দাবি। কিন্তু যেভাবে ধীরগতিতে এই বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাতে জনগণ খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছে না। যাঁরা এই বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত, দু-একজন বাদ দিলে তাঁরা কেউই তারকা আইনজীবী নন। প্রতিদিন টিভিতে কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন। এ বিচারের শেষ দেখতে হলে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
কাজী ফিরোজ রশিদ : আমি জ্যোতিষী নই। রাজনীতির ভবিষ্যৎ বলা খুবই কঠিন। তবে এক কথায় বলা যায়, রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। 'গণতন্ত্র আজ অন্ধকার গলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে।' জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে আবার বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবে- এমনটা ভাবাও ভুল। তাই অনিবার্য কারণেই রাজনীতির গতি ভিন্নপথে মোড় নিতে পারে।
কালের কণ্ঠ : আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসন্ন- এমন কথা আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়। এই নতুন ওয়ান-ইলেভেন সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
কাজী ফিরোজ রশিদ : নো কমেন্ট! সময়ই বলে দেবে কী হবে।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরব। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
কাজী ফিরোজ রশিদ : তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান দেশে নির্বাচন না হওয়ার অশনি সংকেত। সামনে সংঘাত অনিবার্য। ফলে গণতন্ত্র অন্ধকারে হাবুডুবু খাবে।
কালের কণ্ঠ : দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে সংলাপের বিকল্প নেই- এমন কথা বলছেন অনেকেই। আপনার কী মত?
কাজী ফিরোজ রশিদ : সংলাপে কোনো ফল হবে বলে মনে হয় না। দুই দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে সব সংলাপই ব্যর্থ হবে।
কালের কণ্ঠ : দেশের সাধারণ মানুষ কেমন আছে বলে মনে হয় আপনার?
কাজী ফিরোজ রশিদ : সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না শোনার কেউ নেই। এক শ্রেণীর লুটেরার কাছে শেয়ার ব্যবসায় সর্বস্বান্ত হয়ে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী মাতম করছে। দেখার কেউ নেই। খাদ্যে বিষ মিশিয়ে খাওয়াচ্ছে। মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে- এসব দেখার কেউ নেই। মন্ত্রীরা আখের গোছাতে ব্যস্ত। প্রতিবাদের ভাষাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। জনগণের আল্লাহ ছাড়া কোনো ভরসা নেই।
কালের কণ্ঠ : পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা বাতিল নিয়ে যে ঘটনাপ্রবাহ, এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
কাজী ফিরোজ রশিদ : পদ্মা পারের মানুষের স্বপ্ন পদ্মা সেতু। সময় থাকতে প্রয়োজনে সব আবুলকে কোরবানি দিয়ে হলেও এই স্বপ্ন পূরণ করা উচিত ছিল। এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু না হওয়ায় আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু না হলে তার প্রভাব হবে আরো ভয়াবহ।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
কাজী ফিরোজ রশিদ : আগামী দেড় বছর সরকারের জন্য খুবই কঠিন সময়। বিরোধী দল আন্দোলনে নামলে সরকার বেসামাল হয়ে পড়বে। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, শেয়ারবাজারের টাকা লুটপাট করেছে- তারা কেউই দেশে থাকবে না। ওই ধান্দাবাজরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে বিরোধী দলের সঙ্গে আঁতাত করবে। কারণ আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের কোনো কমিটমেন্ট নেই।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
কাজী ফিরোজ রশিদ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শিতার অভাবে আস্তে আস্তে আমরা বন্ধুহীন হয়ে পড়ছি। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমরা শক্ত অবস্থা নিতে পারিনি। তিস্তা চুক্তি আমরা করতে পারিনি। পদ্মা সেতুর ব্যাপারেও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সীমান্তে গুলি করে মানুষ মারা বন্ধ হয়নি। তাই বলা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্জন চোখে পড়ার মতো নয়।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে কী অবস্থায় দেখতে চান? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলুন।
কাজী ফিরোজ রশিদ : ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এমন করে দেখতে চাই, যেখানে দুর্বলের ওপর সবলের অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম চলবে না। ক্ষমতায় এসেই সম্পদের পাহাড় গড়বে না। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটবে। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় যারা অবাধে মাদকের নেশা সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে, খাদ্যে বিষ মিশিয়ে যারা জাতিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে- কঠোর আইন করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এটাই হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গড়া স্বপ্নের বাংলাদেশ।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
কাজী ফিরোজ রশিদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
কাজী ফিরোজ রশীদ : সাড়ে তিন বছরে মহাজোট সরকারের যেমন অনেক ভালো অর্জন আছে, ব্যর্থতার পাল্লা তার চেয়েও অনেক বেশি ভারী। মানুষের মনে অসন্তোষের শেষ নেই। গণতন্ত্রে জনগণের রায়ই শেষ কথা। জনগণ আজ সরকারের প্রায় সব কাজেরই সমালোচনা করছে। কোনো সরকারই কখনো নিজের ব্যর্থতা উপলব্ধি করতে পারে না- এটাই সরকারের ট্র্যাজেডি।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
কাজী ফিরোজ রশীদ : প্রতিদিন বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট বেহাল, তীব্র যানজট, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সংকটে নগরবাসী অতিষ্ঠ। সরকার কঠোর মনিটর করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সরকারের সামনে অনেক পথ খোলা ছিল। টিসিবি এ ক্ষেত্রে হতে পারত সরকারের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। একটি বিকল্প বাজার ব্যবস্থা টিসিবির মাধ্যমে গড়ে তুলতে পারত সরকার। সুযোগ্ ছিল। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগানো হয়নি।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
কাজী ফিরোজ রশীদ : সরকারের ভেতরের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা এরই মধ্যে অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। যাঁরা কোনো দিন আওয়ামী লীগ করেননি, 'জয় বাংলা' স্লোগান দেননি; এমনকি বঙ্গবন্ধুর নামও উচ্চারণ করেননি, তাঁরাই মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। প্রতিনিয়ত যারা বঙ্গবন্ধুকে কুরুচিপূর্ণ গালমন্দ করেছে, আজ তারা বড় আওয়ামী লীগার সেজেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এমন অনেকেরই দোর্দণ্ড প্রতাপ। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয় মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে বা হচ্ছে?
কাজী ফিরোজ রশীদ : সবার নয়, কিছু কিছু মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন তোলাই যায়। এর পাশাপাশি আছে দুর্নীতি সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নও। অযোগ্য-ব্যর্থ ও দুর্নীতিবাজ অনেক মন্ত্রীর কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হচ্ছে। এ জন্য সরকারকে মূল্য দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সফল না ব্যর্থ? যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে ব্যর্থতার সূচকগুলো কী?
কাজী ফিরোজ রশীদ : সরকারের ব্যর্থতার দিকেই জনগণের চোখ বেশি থাকে। তার পরও বলব, তথ্যপ্রযুক্তি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তুলনামূলক সাফল্য দেখিয়েছে।
পক্ষান্তরে শেয়ার কেলেঙ্কারি, দ্রব্যমূল্যের বেপরোয়া ঊর্ধ্বগতি, পদ্মা সেতু করতে না পারা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় নিয়ন্ত্রণহীন মাদক ব্যবসা, খাদ্যে বিষ মিশিয়ে তিলে তিলে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া, সাংবাদিক নির্যাতন, সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হওয়া- এসবই সরকারের ব্যর্থতা। সাড়ে তিন বছরে সরকারও ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করেনি। শুরু থেকেই কাজটি করলে আজ সরকারের সাফল্যের অনেক কিছুই চোখে পড়ত।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারছে? সেই দায়িত্বশীলতার প্রতিফলন কোথায়? বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় বিএনপি কি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে?
কাজী ফিরোজ রশীদ : বিগত সাড়ে তিন বছরে বিএনপি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। শেয়ার কেলেঙ্কারি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, বিদ্যুৎ-গ্যাস সমস্যা, সাংবাদিক নির্যাতন, সাগর-রুনি হত্যাসহ জাতীয় কোনো ইস্যু নিয়ে বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। শুধু নিজেদের রক্ষায় তারা ব্যস্ত। এর প্রধান কারণ বিএনপির বেশির ভাগ নেতা, সাবেক মন্ত্রী দুর্নীতির মামলায় জর্জরিত। তাই তাঁরা কোনো আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। মনে হচ্ছে, আন্দোলনের নামে বিএনপি সরকারের সঙ্গে কানামাছি খেলছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভূমিকা যথার্থ কি না, সেটা জনগণই বিচার করবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি?
কাজী ফিরোজ রশিদ : বিরোধী দলের সংসদ বর্জন নতুন কিছু নয়। যারা যখন বিরোধী দলে থাকে, তারাই সংসদ বর্জন করে। এটা এখন গণতন্ত্রের নিয়মে পরিণত হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কি যথার্থ?
কাজী ফিরোজ রশীদ : আমি মনে করি, জাতীয় পার্টি মহাজোটের প্রধান শরিক দল হিসেবে তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এর অনেক কারণ আছে। নতুন করে সেসব কথা আর বলার প্রয়োজন নেই। জাতীয় পার্টির তৃণমূল থেকে শুরু করে দলীয় কোনো নেতা-কর্মী সরকারের কোনো ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নেবেন না।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দলের জোট সম্প্রসারিত হয়েছে। এই জোট দেশের রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করেন আপনি? এই জোট কি মহাজোটের জন্য হুমকি হতে পারে?
কাজী ফিরোজ রশিদ : বিরোধী দল আজও জনগণের কোনো ইস্যু নিয়ে রাজপথে নামতে পারেনি। শীর্ষ নেতারা টিভি পর্দা ও টক শোতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তাই সরকার বিরোধী দলকে আমলে নিচ্ছে না। বিএনপি কিছু নামসর্বস্ব জনবিচ্ছিন্ন দুর্বল দল নিয়ে বিশাল সংখ্যার জোট গঠন করলেও রাজপথে তাদের দেখা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
কালের কণ্ঠ : রোজার পর আন্দোলন নতুন এক মাত্রা নিতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। বিরোধী দল আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে আন্দোলনে জনগণের কতটুকু সমর্থন থাকবে বলে মনে করেন আপনি?
কাজী ফিরোজ রশিদ : ঈদের পর বিএনপির পক্ষে নতুন আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা খুবই কঠিন হবে। কারণ জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কোনো রাজনৈতিক দল কিছুই করেনি। এরা সবাই ক্ষমতায় এসে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। যাদের কোনো দিন টিআইএন নম্বর ছিল না- তারা রাতারাতি ব্যাংক-বীমার মালিক হয়ে বসেছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। তাই রাজনীতি তার সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। এই বিচার প্রক্রিয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
কাজী ফিরোজ রশিদ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবার দাবি। কিন্তু যেভাবে ধীরগতিতে এই বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাতে জনগণ খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছে না। যাঁরা এই বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত, দু-একজন বাদ দিলে তাঁরা কেউই তারকা আইনজীবী নন। প্রতিদিন টিভিতে কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছেন। এ বিচারের শেষ দেখতে হলে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
কাজী ফিরোজ রশিদ : আমি জ্যোতিষী নই। রাজনীতির ভবিষ্যৎ বলা খুবই কঠিন। তবে এক কথায় বলা যায়, রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। 'গণতন্ত্র আজ অন্ধকার গলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে।' জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে আবার বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবে- এমনটা ভাবাও ভুল। তাই অনিবার্য কারণেই রাজনীতির গতি ভিন্নপথে মোড় নিতে পারে।
কালের কণ্ঠ : আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন আসন্ন- এমন কথা আজকাল অনেককেই বলতে শোনা যায়। এই নতুন ওয়ান-ইলেভেন সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
কাজী ফিরোজ রশিদ : নো কমেন্ট! সময়ই বলে দেবে কী হবে।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরব। এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
কাজী ফিরোজ রশিদ : তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থান দেশে নির্বাচন না হওয়ার অশনি সংকেত। সামনে সংঘাত অনিবার্য। ফলে গণতন্ত্র অন্ধকারে হাবুডুবু খাবে।
কালের কণ্ঠ : দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে সংলাপের বিকল্প নেই- এমন কথা বলছেন অনেকেই। আপনার কী মত?
কাজী ফিরোজ রশিদ : সংলাপে কোনো ফল হবে বলে মনে হয় না। দুই দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকলে সব সংলাপই ব্যর্থ হবে।
কালের কণ্ঠ : দেশের সাধারণ মানুষ কেমন আছে বলে মনে হয় আপনার?
কাজী ফিরোজ রশিদ : সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না শোনার কেউ নেই। এক শ্রেণীর লুটেরার কাছে শেয়ার ব্যবসায় সর্বস্বান্ত হয়ে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী মাতম করছে। দেখার কেউ নেই। খাদ্যে বিষ মিশিয়ে খাওয়াচ্ছে। মাদক সারা দেশে ছড়িয়ে জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে- এসব দেখার কেউ নেই। মন্ত্রীরা আখের গোছাতে ব্যস্ত। প্রতিবাদের ভাষাও মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। জনগণের আল্লাহ ছাড়া কোনো ভরসা নেই।
কালের কণ্ঠ : পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা বাতিল নিয়ে যে ঘটনাপ্রবাহ, এ প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
কাজী ফিরোজ রশিদ : পদ্মা পারের মানুষের স্বপ্ন পদ্মা সেতু। সময় থাকতে প্রয়োজনে সব আবুলকে কোরবানি দিয়ে হলেও এই স্বপ্ন পূরণ করা উচিত ছিল। এই স্বপ্নের পদ্মা সেতু না হওয়ায় আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু না হলে তার প্রভাব হবে আরো ভয়াবহ।
কালের কণ্ঠ : আগামী দেড় বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
কাজী ফিরোজ রশিদ : আগামী দেড় বছর সরকারের জন্য খুবই কঠিন সময়। বিরোধী দল আন্দোলনে নামলে সরকার বেসামাল হয়ে পড়বে। সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি করে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, শেয়ারবাজারের টাকা লুটপাট করেছে- তারা কেউই দেশে থাকবে না। ওই ধান্দাবাজরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে বিরোধী দলের সঙ্গে আঁতাত করবে। কারণ আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের কোনো কমিটমেন্ট নেই।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
কাজী ফিরোজ রশিদ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শিতার অভাবে আস্তে আস্তে আমরা বন্ধুহীন হয়ে পড়ছি। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমরা শক্ত অবস্থা নিতে পারিনি। তিস্তা চুক্তি আমরা করতে পারিনি। পদ্মা সেতুর ব্যাপারেও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। সীমান্তে গুলি করে মানুষ মারা বন্ধ হয়নি। তাই বলা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্জন চোখে পড়ার মতো নয়।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে কী অবস্থায় দেখতে চান? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের কথা বলুন।
কাজী ফিরোজ রশিদ : ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে এমন করে দেখতে চাই, যেখানে দুর্বলের ওপর সবলের অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম চলবে না। ক্ষমতায় এসেই সম্পদের পাহাড় গড়বে না। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটবে। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় যারা অবাধে মাদকের নেশা সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে, খাদ্যে বিষ মিশিয়ে যারা জাতিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে- কঠোর আইন করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এটাই হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গড়া স্বপ্নের বাংলাদেশ।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
কাজী ফিরোজ রশিদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments