আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস আজ- আদিবাসীদের ওপর সহিংসতা বাড়ছে by পার্থ শঙ্কর সাহা

আদিবাসীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার কোনো আইনি প্রতিকার পাচ্ছেন না আদিবাসীরা। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত তিনজন নারীসহ আটজন আদিবাসী খুন হয়েছেন। ১০টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ২৩ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন।


গত বছর খুন হয়েছিলেন তিনজন নারীসহ সাত আদিবাসী। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ২৮টি। আদিবাসীদের পরিচালিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশন সূত্রে এ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে।
প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সাল থেকে আদিবাসীদের মানবাধিকার-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কাপেংয়ের সমন্বয়ক মং সিং নিও জানান, গত ছয় মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি আদিবাসী পরিবারকে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ জনকে। একটি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস, সাতটি আদিবাসী পরিবারের বসতবাড়ি ভস্মীভূত এবং ১৬ জনকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে।
এ বছর সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে নওগাঁয়। জেলার মান্দা উপজেলার চকগোপাল গ্রামে গত ৪ মে খুন হন চারজন আদিবাসী দিনমজুর। কাপ্তাইয়ে ৭ এপ্রিল এক কিশোর নিহত হয় বনরক্ষীদের হাতে। লংগদু উপজেলায় ৯ মে সুজাতা চাকমাকে ধর্ষণের পর খুন করে ইব্রাহীম নামের এক পুনর্বাসিত বাঙালি। নওগাঁর বদলগাছিতে ১৯ মে নান্নুমিয়া নামের এক অটোরিকশাচালক সাত বছর বয়সী সাগরী ওঁরাওকে ধর্ষণের পর খুন করে।
রাঙামাটি পৌর এলাকার উলুছড়ায় ৭ জুলাই বলিমালা চাকমা (৪৫) নামের এক গৃহবধূ খুন হন। তাঁকে ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সোহেল (২৬) নামের একজনকে ৯ জুলাই পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
বিচার হচ্ছে না: টাঙ্গাইলের মধুপুরের আদিবাসী নেতা চলেশ রিছিলকে ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ খুন করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত হত্যা মামলাটি পুলিশ রেকর্ড করেনি। ঘটনা তদন্তে ওই বছরের ৫ মে এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এখন পর্যন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।
মধুপুরে ২০০৩ সালের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষীদের গুলিতে নিহত হন পীরেন স্লান। আজ পর্যন্ত ওই হত্যা মামলারও সুরাহা হয়নি।
আদিবাসীদের ওপর নির্যাতনের বিচার যে হচ্ছে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনেও তার প্রমাণ মেলে। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৫ জুলাই জানানো হয়, ২০১০ ও ২০১১ সালে তিন পার্বত্য জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ৫৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৮টি ছিল ধর্ষণের ঘটনা। মোট মামলার মধ্যে ৩৮টির অভিযোগপত্র এবং ১৩টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। রায় হয়েছে ছয়টি মামলার। কোনো মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জানতে চাইলে জাতীয় সংসদের আদিবাসীবিষয়ক ককাসের আহ্বায়ক রাশেদ খান মেনন বলেন, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে আদিবাসীদের ওপর সহানুভূতিশীল নয় এমন একটি অংশ আছে। আদিবাসীদের ওপর যখন সহিংসতার ঘটনা ঘটে তখন তারা তা নিরসনের চেষ্টা না করে বরং অপরাধীদের বাঁচাতে চেষ্টা করে। এভাবে অপরাধ করেও দায়মুক্তি পেয়ে অপরাধীরা উৎসাহিত হয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু মুঠোফোনে বলেন, ‘যেকোনো মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা দায়বদ্ধ। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারেও আমরা যথেষ্ট সচেতন।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদিবাসীদের রক্ষায় কোনো গাফিলতি করে না বলেও দাবি করেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, এখন সরকারিভাবেই আদিবাসীদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যারা আদিবাসীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে তারা বুঝে গেছে, এদের ওপর নিপীড়ন চালালে সরকার কোনো শক্ত অবস্থান নেবে না। তাই প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে।

No comments

Powered by Blogger.